রাজনীতি কী? মূল: ক্রিস্টনা বসওয়েল, অনুবাদ: মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম
আমরা যখন কোনোকিছু রাজনৈতিকভাবে উল্লেখ করি কিংবা রাজনীতি সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের অবতারণা করি, তখন আসলে মানুষে মানুষে বা কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের উত্তপ্ততাকে বুঝি। রাজনীতির ধারনা হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে স্বার্থ আদায়ের একটা কলাকৌশলগত প্রক্রিয়া। স্বার্থ বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই রাজনীতির ধারণা অবশ্যই দলীয় রাজনীতির সাথে খুবই আনুষঙ্গিক। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির সংজ্ঞায়নে আমরা বুঝি, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো কর্তৃক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দাবি উত্থাপনের প্রক্রিয়া এবং সেই দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রবাহমান জনমানুষের গণসমর্থন আদায় করা। রাজনীতির এই চওড়া সংজ্ঞার বাইরে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কী, কীভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে এটা তার ভূমিকা পালন করবে, তার খোলসমুক্ত করা একান্ত আবশ্যক। এই উভয় প্রশ্নই রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সহায়তা করবে।
[caption id="attachment_91200" align="alignnone" width="1600"] মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম[/caption]
প্রথমত রাজনীতি বিষয়টা কী? এ প্রশ্নের বিশুদ্ধ জবাব হলো রাজনীতি এমন একটা বিশেষ বিষয় কে কী, কখন ও কীভাবে লাভ করবে। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনুমেয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে বস্তুগত সম্পদ বণ্টনের উপর ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায়ই মূলত রাজনীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এটাকেই রাজনীতির স্বচ্ছ ও চলনসই দিক মনে করা হচ্ছে। এ যুগে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র কর্তৃক বর্ধনশীল করারোপ ও সমৃদ্ধির জন্য কল্যাণকর ব্যবস্থা আপেক্ষিকভাবে অবলোকন করা যেতো; আর দলীয় রাজনীতির পদ্ধতি ও বলয়ে প্রথাগত বামপন্থী-ডানপন্থীর আদর্শিক ফাটলের প্রকটতাও দেখা যেতো। গত তিন বা চার দশক পরে বণ্টন পদ্ধতির রাজনীতির ধারণা সম্পূর্ণভাবে কিংবা বহুলাংশে বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। জীবনাচরণ ও মূল্যবোধে আদর্শগত লড়াইয়ের বর্ধনশীল প্রধান্য এমন ধারণা প্রোথিত করে যে রাজনীতি বস্তুগত সম্পদ বণ্টন প্রক্রিয়ার চেয়েও অনেকাংশে নিজ পরিচিতি ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। সমসাময়িক রাজনৈতিক বিতর্কে অধিকাংশ ইস্যু ডান-বামের আদর্শিক লড়াইয়ের মধ্যেই শুধুই আবর্তিত হয়না; সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ, লিঙ্গ, যৌনাধিকার, অভিবাসন ও নিরাপত্তাবিষয়ক বিষয়গুলোও আবর্তিত হয়।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বস্তুগত সম্পদ বণ্টন বিষয়ের চেয়েও অধিক সাংস্কৃতিক পরিচয় ও স্বীকৃতি বহন করে।
রাজনীতির পাঠপরিক্রমায় কল্পনা ও ধারনাগত বিষয়ের উদ্ভব রাজনীতির প্রথাগত ও ধ্রুপদী দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা নতুন বাধার অনুষঙ্গ যুক্ত করেছে। পণ্ডিতেরা দেখিয়েছেন যে, কিভাবে রাজনীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আইন ও নীতি বা পদ্ধতিগত সমস্যার বিশ্লেষণের পথ তৈরি করে; যেমন রাজনীতি বস্তুগত সম্পদ বণ্টন প্রক্রিয়ার ক্ষমতার রথের রশিটি হস্তগত করার দ্বন্দ্বে সদাব্যস্ত। অবশ্যই বস্তগত সম্পদ বণ্টনের লড়াই ও আদর্শিক লড়াই সহজভাবে পৃথকীকরণ অসম্ভব। ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে সমস্যা বিশ্লেষণে, বণ্টন প্রক্রিয়ায় অনেক জটিল প্রতিক্রিয়া থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। কিন্তু মূল বিষয় রাজনীতি হলো একটা আদর্শিক যুদ্ধ, চেতনার লড়াই; নিজ স্বার্থ হাসিলের আকাঙ্ক্ষা বাদ দিয়ে, সুপ্রোথিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাধ্যমে রাজনৈতিক অংশীজনরা রাজনীতির এ বদ্ধমূল কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাজনীতির কাঠামোয় ভুয়া সংবাদগুলোকে অপসারণের লক্ষ্যে বিতর্কের তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে যাচাই-বাছাই করে মতৈক্যে পৌঁছা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নীতিমালা ও কার্য-পরিকল্পনার তৈরির পথকে প্রশস্তকরণ ও এর বৈধতালাভের গুরুত্বই রাজনীতিতে তাৎপর্য বহন করে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো রাজনীতির প্রায়োগিক ও প্রক্রিয়াগত দিক। প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দাবিগুলো কিভাবে নীতিমালাতে রূপান্তরিত হবে? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হল; বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে যে কোনো দল তার নীতি,পদ্ধতি ও কার্যপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বৈধ অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু ভোটপ্রয়োগের এই লেনদেনজনিত হিসাবনিকাশের জয়-পরাজয় অনেক সময় রাজনীতিকে বিভ্রান্তিকর ও ভুল পথে চালিত করে। রাজনীতিতে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা নিলাম নামক যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রবল ঝোঁক তৈরি করে। যেখানে সব প্রতিদ্বন্দ্বী দল চমকপ্রদ ও লোভনীয় কার্যক্রমের অঙ্গীকার করে। ফলে ভোটারা মনে করে এ সকল কার্যক্রম সহজভাবে বাস্তবায়নযোগ্য, মনে হয় তারা (ভোটাররা) ভোক্তা এবং পছন্দসই পণ্য বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু সম্পদের স্বল্পতা, বাস্তবোপযোগিতা বা রাজনৈতিক অনাস্থা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে ইশতেহারের দাবিগুলো প্রায়ই বাদ পরে এবং অবাস্তবায়নের নদীতে ডুবে যায়। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ফলাফল হিসেবে হতাশা চেপে ধরে ও কাল্পনিক মোহভঙ্গ ঘটিয়ে রূঢ় বাস্তবতায় নিয়ে আসে।
রাজনীতির গতি-প্রকৃতির মধ্যে এই যে পরিবর্তন ও সংযোজন সেগুলো স্পষ্টকরণ ও অনুধাবন করা রাষ্ট্র বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে অন্যতম। আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহুলাংশে সাংস্কৃতিক পরিচায়ক ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি। পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি ও উৎকট বাস্তবতার মধ্যে যে বিশাল ফারাক সেটা রাজনীতির বস্তুগত সম্পদ বণ্টন প্রক্রিয়ায় হতাশার অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই ধারাগুলিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মাধ্যমে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সুসংহত করে, রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনা ও একে অপরের প্রতি আস্থাশিলতার পরিমণ্ডলকে নতুন করে সাজাতে পারি। বর্তমান রাজনৈতিক আবহে কোনো কৃতিত্বের উপযোগিতা নেই যদি না আমরা আমাদের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টার সঠিক প্রয়োগকে মূল্যায়িত না করতে পারি।
ক্রিস্টিনা বসওয়েল
অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান
ডীন, গবেষণা, কলেজ অব আর্টস
কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো, বৃটিশ একাডেমি
অনুবাদ: মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com