রমজান মাসে স্কুল-কলেজ খোলা রেখে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে করে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের ভোগান্তি বাড়বে বলে জানান তারা। তাদের মতে, একদিকে গরমের তীব্রতা, নানা ধরনের রোগব্যাধির প্রকোপ বেড়ে গেছে, এর মধ্যে আবার রোজা রেখে দিনভর ক্লাস নেওয়াটা অমানবিক।
রোজায় স্কুল-কলেজ খোলা রাখার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে ঈদের পর বাড়তি ক্লাস করে ঘাটতি মেটানোর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-অভিভাবকরা। তবে রমজানে ক্লাস কমিয়ে ছুটি বাড়ানোর কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, আগামী ৩ এপ্রিল থেকে পবিত্র মাহে রমজান শুরু হতে পারে। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেই ঘাটতি মেটাতে ২৩ রমজান (সম্ভাব্য) অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল-কলেজে ক্লাস নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ রমজানে নিয়মিত স্বাভাবিক ক্লাস করাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে মোতাবেক দেশের সব স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা মহসিন হোসেন। তার এক ছেলে নটর ডেম কলেজে ও আরেকজন মগবাজার বিটিসিএল স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। তিনি বলেন, রমজান মাসে ঢাকায় তীব্র যানজট থাকে। তার ওপর এ সময় স্কুল-কলেজ খোলা রাখলে মানুষের আর চলাফেরার উপায় থাকবে না।
তিনি বলেন, বর্তমানে গরমের তীব্রতা বাড়ছে। তার সঙ্গে শিশুসহ সব বয়সী মানুষের রোগব্যাধি বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমার ছেলেরা রোজা রেখে কীভাবে দিনভর ক্লাস করবে? কষ্ট করে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তাতে অমনোযোগী হয়ে উঠবে। সে কারণে রমজানে ছুটি দিয়ে পরবর্তী সময়ে বাড়তি ক্লাস করানোর দাবি জানান এই অভিভাবক।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ জান্নাতুল মাওয়া মাদরসায় পড়ে গাজী আনোয়ারুল হকের তিন মেয়ে। যাত্রাবাড়ী একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তারা। তিনি বলেন, প্রতিদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ গিয়ে আমার মেয়েরা ক্লাস করে। তারা রোজা রেখে কীভাবে এত দূর গিয়ে সারাদিন ক্লাস করবে? সে কারণে ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে ১৫ রোজার মধ্যে স্কুল-কলেজ ছুটি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
কাজল আহমেদের দুই মেয়ে পড়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। একজন একাদশে, আরেকজন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তিনি বলেন, রোজায় শিশুদের ক্লাস করার কোনো প্রয়োজন নেই। এতে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হবে না। তার বদলে অনলাইনে ক্লাস করানো যেতে পারে।
তিনি বলেন, গত দুই বছরের ঘটতি রোজায় ক্লাস করিয়ে কাটানো সম্ভব হবে না। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। তার বদলে ঈদের পর পরবর্তী পাঁচ মাস শনিবারও ক্লাস নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, অনেকে নিয়মিত রোজা রাখেন। রোজায় স্কুল বন্ধ থাকায় তেমন সমস্যা হয় না। রোজা রেখে স্কুলে আসতে অনেক কষ্ট হবে। গরমে রাস্তায় তীব্র যানজটে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। রোজা রেখে পড়ায় মনোযোগ দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ কারণে রমজান মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার অনুরোধ তাদের।
মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ বলেন, শিখন ঘাটতি মেটাতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বাড়তি কষ্ট করতে হবে। তবে পুরো রমজান মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না রেখে মাঝামাঝি পর্যন্ত খোলা রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
মিরপুরের মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষক মোস্তফা আহমদুল হক বলেন, রোজার অধিকাংশ সময় শিক্ষার্থীদের পক্ষে নিয়মিত ক্লাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। এর বদলে কিছুদিন খোলা রাখা যেতে পারে। নতুবা ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা কমবে, শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদের জোর করে পড়িয়ে শিখন ঘাটতি কাটানো সম্ভব হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খাইরুন নাহার লিপি বলেন, করোনার কারণে অনেকদিন আমরা বাসায় বসে ছিলাম। এখন রমজানে ক্লাস নিতে সমস্যা হবে না। এতে পিছিয়েপড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মজিত (সুজন) বলেন, করোনাকালে গত দুই বছর ক্লাসরুমে পাঠদান বন্ধ ছিল। তাতে কিছুই হয়নি। অথচ রমজান মাসে শিক্ষার্থীদের জোর করে ক্লাসে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে দেশে যানজটের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে। অভিভাবকরাও রমজান মাসে ক্লাস বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, রমজান মাসে স্কুল-কলেজ খোলা রাখলে সবার কষ্ট বেড়ে যাবে। যেহেতু দীর্ঘদিন ক্লাস বন্ধ ছিল, সে কারণে আগামী ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক আপত্তি জানান।
তিনি বলেন, রোজার মধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করাটা যেমন কষ্ট, তারচেয়ে বেশি কষ্ট সিলেবাস না পড়িয়ে পরীক্ষার হলে পাঠিয়ে দেওয়া। চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করাতে হবে। সব শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি মেটাতে রমজান মাসে স্কুল-কলেজ খোলা রাখা হচ্ছে। তবে আগামী ২৬ এপ্রিলের পরিবর্তে এসময় কিছুটা কমিয়ে ছুটি বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একমত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিকের (স্কুল-কলেজ) সঙ্গে মাদারাসা ও কারিগরি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও রমজান মাসে নিয়মিত ক্লাস চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ক্লাস নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।