যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষার ব্যবহার: পরিবর্তন বনাম বিকৃতি

:
: ২ years ago

মানব সম্প্রদায়ের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। স্থানিক পরিবেশের ভিন্নতা এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনের নিরিখে ভাষার প্রয়োগ ভিন্নতর হয়ে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভাষার সঙ্গে হাট-বাজারে ব্যবহৃত ভাষার ভিন্নতা যেমন থাকে; তেমনি অফিস-আদালতের ভাষার সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় ভাষার প্রয়োগ ভিন্নতর হয়ে থাকে।

আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহার ও সগর্বে স্বীকৃত। কিন্তু সব অঞ্চলে বোধগম্য যোগাযোগের জন্য ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য রূপ দরকার। এ ধরনের প্রয়োজন থেকেই প্রমিত ভাষা বা মান ভাষার উদ্ভব। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রমিত ভাষার ব্যবহার যেন প্রায় নির্বাসনে যেতে বসেছে।

অফিস-আদালতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রেডিও- টেলিভিশন, নাটক, সিনেমা কোথাও যেন মান ভাষার চর্চা নেই। পঁচিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনের এই প্রান্তে এসে দেখছি পরীক্ষার উত্তরপত্রে ও ইদানিং প্রমিত ভাষা অনুপস্থিত। শুধুমাত্র স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদ উপস্থাপনে, এবং মুদ্রিত সংবাদপত্রে প্রমিত ভাষা এখন স্থান করে নিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ভাষা ব্যবহারের এই অবস্থা কি ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তনের ফল , নাকি এক ধরনের বিকৃতি!

বাংলা ভাষা ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে বেশ কিছু প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রমিত বাংলার প্রতি প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অনুষ্ঠানগুলোতে আঞ্চলিক বাংলার পুনঃ পুনঃ এবং অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ, ইংরেজি-হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার মিশ্রণে নতুন শব্দের ব্যবহার, বাংলা শব্দকে সংক্ষিপ্তকরণ, ইংরেজি শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার, ক্রিয়াপদের অদ্ভুত ব্যবহার, বিকৃত উচ্চারণ, বানান বিকৃতি প্রভৃতি।

এসবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে এফএম রেডিওর ভাষা, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং ফেসবুকের ভাষা। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এবং ভাষা দূষণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানভাষা বা প্রমিত ভাষা সবসময়ই একরৈখিক বা কেন্দ্রমুখী। নানা অঞ্চলের আঞ্চলিক উপভাষা কে অগ্রাহ্য করেই তাকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। প্রমিত ভাষা বিষয়ে রুশ সাহিত্য সমালোচক মিখাইল বাখতিনের ধারণা ও অনুরূপ।

উনিশ শতকে যখন বাংলার মান ভাষা তৈরি হচ্ছিল, তখন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়ার উপভাষা কে অগ্রাহ্য করে নদীয়া- শান্তিপুর অঞ্চলের ভাষাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশেও এটিকে মান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের স্বকীয় মান ভাষার প্রশ্নটি একটু একটু করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং প্রচলিত প্রমিত ভাষাকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমানে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আপনি প্রমিত ভাষায় কথা বললে অনেকেই আপনার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে। প্রশ্ন করবে, আপনার বাড়ি যেন কোথায়? অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শিক্ষিত তরুণ সমাজের সামনে প্রমিত চলিত ভাষায় কথা বললে আপনি তাচ্ছিল্যের শিকার হতে পারেন।

প্রশ্ন করা যেতে পারে বাংলাদেশে পৃথক কোনো প্রমিত ভাষা আদৌ তৈরি হয়েছে কি? এ প্রসঙ্গে ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমির উদ্বোধনী ভাষণে প্রদত্ত পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে, ‘রংপুর হইতে চট্টগ্রাম, যশোহর হইতে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলে নানারকম কথ্য ভাষা আছে। কিন্তু সারা পূর্ববাংলায় কোন স্ট্যান্ডার্ড বা সাধারণ কথ্যভাষা এখনো গড়িয়া উঠে নাই।’

এখনো এটিই বাংলাদেশের বাস্তবতা । তাই বলা যেতেই পারে মৃত্তিকা ঘনিষ্ঠতার নামে প্রমিত বাংলার প্রচলিত রূপকে অস্বীকারের প্রবণতা সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধি জাত। অনেকটা ব্রিটিশ-আমেরিকান ইংরেজির মতো আরোপিত এবং তা সাংস্কৃতিক রূপান্তরের স্বাভাবিক নিয়মের ও পরিপন্থী।

জানুয়ারি মাসজুড়ে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। তাদের নতুন ধারাবাহিকে অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রয়োজন। অভিনয় প্রত্যাশীকে শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। বিজ্ঞাপনটি দুটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রথমত, বাংলাদেশের কোন চ্যানেলে ধারাবাহিকের প্রয়োজনে অভিনেতা বাছাইয়ের উন্মুক্ত ঘোষণা অভিনব। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- উচ্চারণের শুদ্ধতার বিষয়ে দেয় ঘোষণা।

প্রশ্ন করা যেতেই পারে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যেসব নাটক প্রচারিত হয় তার মধ্যে কতগুলো প্রমিত ভাষায়; আর কতগুলো আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত হয়? প্রমিত ভাষায় দু’এক শতাংশ নাটক ও কি প্রচারিত হয়? আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত অসংখ্য নাটকের বিষয়বস্তুর সঙ্গে ভাষার কতটুকু সম্পর্ক রয়েছে তা গবেষণা সাপেক্ষ।

জনপ্রিয়তার দোহায় দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত এসব নাটকের মাধ্যমে আমরা দেশের কোন অঞ্চলের ভাষাকে প্রমোট করছি তা ভেবে দেখার বিষয়। সম্প্রচার নীতিমালায় ভাষা বিষয়ক সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলে এবং চ্যানেলগুলোতে প্রিভিউ কমিটি বলে কিছু থাকলে হয়তো ভাষার এ ধরনের বিশৃঙ্খলা থাকতো না।

অথচ এসব দেখে তরুণসমাজ প্রভাবিত হচ্ছে এবং যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ধীরে ধীরে প্রমিত ভাষা নির্বাসনে যাচ্ছে। ফলে মেধাবী শিক্ষিত তরুণ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পর্যন্ত শুদ্ধ ভাষায় নিজেকে উপস্থাপন করার দক্ষতা হারিয়ে ফেলছে।

বাংলা ভাষায় প্রচলিত অসংখ্য সমার্থক শব্দ থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি, হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার মিশ্রণে নতুন নতুন শব্দের অদ্ভুতুড়ে ব্যবহার তরুণ সমাজের কাছে বর্তমানে স্মার্টনেসের প্রকাশ। এখন জন্মদিনে ‘ট্রিট’ দিতে হয়, ফাস্টফুড খেয়ে ‘চিল’ করতে হয়, খাবার খুব ভালো হলে ‘জোস’ বলতে হয়, কোক-পেপসি খেয়ে ‘Sweag’ করতে হয়, নেশা করে ‘পিনিক’ তুলতে হয়, সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছালে ‘চরম’ অথবা ‘ব্যাপক’ বলতে হয়।

সুন্দর ছবি দেখলে আপনি ‘অসাম’ বলতে পারেন নিদেনপক্ষে ‘অস্থির’ ও হতে পারেন, ‘মাগার’ এই ‘বিন্দাস’ জীবনে বাবা-মা কখনো কখনো ‘প্যারা’ দিতে পারে, তাই তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের সঙ্গে ‘প্রাঙ্ক’ করতে পারেন, আর অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ’হ্যালো ভিউয়ার্স’ বা ‘হ্যালো লিসনার্স’ বলতে পারেন। এ ধরনের শব্দবন্ধ প্রচারে এফএম রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের জকি/ উপস্থাপকগণ মূল ভূমিকা পালন করে থাকেন।

ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্মার্টনেসের আরেকটি বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বাংলা ও ইংরেজি শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ এবং ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা। এক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মেসেজিং অপশন। এসব মাধ্যমে লিখতে গিয়ে কোন ব্যাকরণ, বানানরীতি এমনকি সংক্ষিপ্তকরণের ক্ষেত্রে কখনো কখনো মূল শব্দের প্রথম ও শেষ অক্ষরের ও প্রয়োজন হয় না।

এখানে মেরে ফেলা কে অবলীলায় ‘মাইরালা’, খারাপকে  ‘খ্রাপ’, সেই রকমকে ‘সেইরাম’, ভালো লেগেছেকে ‘ভাল্লাগছে’, আমরাকে ‘আম্রা’, একটাকে ‘এক্টা’,  কেমনকে ‘kmn’, একদমকে ‘ekdm’, ভাইকে ‘Bay/Bai’ , বন্ধুকে ‘Bndu’  লেখা যায়। একইভাবে দোস্ত হয়ে যায় Dst ,  Cute-Cut/Quite ,   Thanks- Tnxq,   Right- R8 ,   Welcome- Wlc/Wcm, Girlfriend-Gf,   Boyfriend-Bf,   Good morning-Gm/Gd mng,   Happy birthday-Hbd,  Happy new year-Hny,    Knock-Knk,   Same-Sm, Keno-Knu,   Seriously-Srsly,   Nice-Nc/Nyc/Ncy/Ncce/Nic/Nicy  ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও সাধারণ আলাপচারিতায় কান পাতলেই ওএমজি, ব্রো, লোল জাতীয় শব্দ আপনি যখন তখন শুনতে পাবেন।

ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ও এক ধরনের বিশৃঙ্খলা এবং চ ও ছ এর অদ্ভুত উচ্চারণ তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়। এখানে করছি হয়ে যায় ‘করতেছি’, যাচ্ছি হয়ে যায় ‘যাইতেছি’ প্রভৃতি। এছাড়াও করতাছোস, খাইছোস, বলছোস, জানোছ না, যাইসনা, খাইসনা, কস না, বলোস না এর প্রভাবে ক্রিয়াপদ জনিত মূল শব্দগুলো যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

শব্দের বিকৃত ও ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপন ও বর্তমানে দারুণ জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার জোয়ারে বেসম্ভব, নাইচ, মুন্চায়, আজিব, হপ্পে, হেব্বি, বিনূদুন, হুদাই, টাস্কি খাওয়া, পল্টি খাওয়া, ঠ্যাক দেওয়া, মাঞ্জামারা, তারছিড়া জাতীয় শব্দগুলো যেন মূলধারায় স্থান পেতে চলেছে। অনেকটা মুদ্রা সংক্রান্ত গ্রেশামের তত্ত্বের মত, ‘খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে বিতাড়িত করে’।

ফেব্রুয়ারি আসলে আমাদের ভাষাপ্রেম যেন হঠাৎ করে জেগে ওঠে আমরা বানানের বিকৃতি নিয়ে কথা বলি। বানান সহজীকরণ নিয়ে বাংলা একাডেমি অনেক কাজ করলেও সর্বসাধারণের কাছে সেটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত নয়; সহজে বোধগম্য ও নয় । এ কারণে হ্রস্ব-ই’কার ও দীর্ঘ-ই ’কার জনিত সমস্যা, র, ড় ও ঢ় এর ব্যবহার, এবং শ, স,ও ষ এর ব্যবহার বিষয়ে এখনো আমরা উদাসীন।

এসবের সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো সংবাদপত্র আবার নিজস্ব বানান রীতি প্রচলন করেছে। এটিও এক ধরনের সমস্যা। আবার এ মাসেই অফিস আদালতে বাংলার ব্যবহার এবং সাইনবোর্ডে বাংলার ব্যবহার নিয়ে আমরা সোচ্চার হয়ে উঠি। কিন্তু ৮ ফাল্গুন যখন ২১ ফেব্রুয়ারি হয়ে যায়, বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান যখন বাংলা একাডেমি হয়ে যায় তখন আমাদের ভাষাপ্রেম নিয়ে সন্দেহ জাগতে পারে বৈকি।

এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইংরেজিতে নামকরণ ও কৌতুকপ্রদ। এক্ষেত্রে বিআরটিসি, টেলিটক, বিটিআরসি, বিটিএমসি, বিটিসিএল, বিজেএমসি, র্যা ব, বিজিবি, পিবিআই, ডিপিডিসি প্রভৃতি নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে ভাষা ব্যবহারের সর্বক্ষেত্রেই যেন এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এর কতটুকু ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন; আর কতটুকু আরোপিত বিকৃতি সেসব ভেবে দেখার সময় এসেছে। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার দাবিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। তার ধারাবাহিকতায় দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ আজও আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি।

বাংলা ভাষার বিকৃতি ও দূষণ রোধে হাইকোর্টের দুটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ২০১২ এবং ২০১৪ সালে প্রদত্ত সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চালুর হাইকোর্টের আদেশের বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো ভাষা দূষণ ও বিকৃতির হাত থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। ভাষা আন্দোলনের মাসে এটাই হোক আমাদের সবার চাওয়া।

লেখক: অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।