'আবদুল বারীর ভাগ্য ফুরিয়ে আসছিল। পূর্ব বাংলার আরও হাজারো মানুষের মতো তিনিও বড় একটি ভুল করেছেন- তিনি পালাচ্ছেন। কিন্তু পালাচ্ছেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টহল দলের সামনে দিয়ে। তার বয়স ২৪। সৈন্যরা তাকে ঘিরে ফেলেছে। তিনি কাঁপছেন, কারণ তিনি এখনই গুলির শিকার হতে যাচ্ছেন।'
১৯৭১ সালের মার্চে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়, মাসকারেনহাস তখন করাচির একজন নামী সাংবাদিক। স্থানীয় গোয়ান-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তিনি একজন সদস্য। তার ও ইভোনের পাঁচটি সন্তান রয়েছে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী, হিন্দু সম্প্রদায়সহ সাধারণ বাঙালিদের বিরুদ্ধে পূর্ব পরিকল্পিত সহিংস অভিযান শুরু করে। আরও অনেক যুদ্ধাপরাধের মতো সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে, ছাত্র-শিক্ষকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে। ঢাকা থেকে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের তাণ্ডব ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগুলোতেও।
তাদের এই পরিকল্পনা কিছুটা সাফল্য পাওয়ার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন সাংবাদিককে এনে ঘুরিয়ে দেখানো হবে যে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তারা কতোটা সফলতা পেয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলায় যে তাদের ভাষায় সব কিছুই স্বাভাবিক সেটি তুলে ধরা।
ঢাকায় অবস্থান করা বিদেশি সাংবাদিকদের অবশ্য এর আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে। এরপর আট জন সাংবাদিককে দশ দিনের একটি সফরে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়, যাদের মধ্যে ছিলেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস।
যখন তারা আবার পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান, তখন তাদের মধ্যে সাতজন সাংবাদিক পাকিস্তানি সরকারের চাহিদা অনুযায়ী রিপোর্ট করেন। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে করাচির মর্নিং নিউজের সাংবাদিক ও ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ক্ষেত্রে।
ইভোন মাসকারেনহাস স্মৃতিচারণা করে বলেন, 'আমি কখনোই আমার স্বামীর এ রকম চেহারা দেখিনি আগে। তিনি ছিলেন খু্বই ক্ষুব্ধ, চিন্তিত, বিষণ্ণ আর আবেগী। তিনি বলেছিলেন, আমি যা দেখেছি, সেটা যদি আমি লিখতে না পারি, তাহলে আমি আর কখনোই অন্য কোনো কিছু লিখতে পারবো না।'
তবে পাকিস্তানে সেটা লেখা সম্ভব নয়। কারণ গণমাধ্যমের সব প্রতিবেদনই সেখানে সেন্সর করা হয়। এবং তিনি যদি সেই চেষ্টা করেন, তাকে হয়তো গুলি করে মারা হবে। অসুস্থ বোনকে দেখার নাম করে মাসকারেনহাস তখন লন্ডনে চলে যান। এরপর সরাসরি লন্ডন টাইমসের সম্পাদকের দপ্তরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন।
তিনি তাকে বলেন, 'আমি পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পিত গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আর্মি কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি যে, এটাই একমাত্র সমাধান।' হ্যারল্ড ইভান্স প্রতিবেদনটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু বলেন যে তার আগে করাচি থেকে ইভোন আর তার সন্তানদের বের করে আনতে হবে। তারা সিদ্ধান্ত নেন তাদের প্রস্তুত করতে একটি সংকেতমূলক টেলিগ্রাম পাঠানো হবে, যেখানে লেখা হবে, 'অ্যানের অপারেশন সফল হয়েছে।'
ইভোন মাসকারেনহাস বলেন, 'পরদিন ভোর তিনটায় আমি টেলিগ্রামটি পাই। তখন আমার মনে হয়েছিল, ও ঈশ্বর, এখন আমাদের লন্ডন যেতে হবে। আমাকে সবকিছু এখানে ফেলে রেখে যেতে হবে। এটা যেন শেষকৃত্যের মতো একটা ব্যাপার ছিল।'
সন্দেহ এড়াতে পরিবার রওনা হবার আগেই অ্যান্থনি মাসকারেনহাস আবার পাকিস্তানে ফিরে যান। কিন্তু তখনকার নিয়ম অনুযায়ী, পাকিস্তানি নাগরিকরা বছরে একবার বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেতেন। তাই পরিবার চলে যাওয়ার পর তিনি সড়ক পথে গোপনে সীমান্ত অতিক্রম করে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়েন।
যেদিন লন্ডনে পুরো পরিবার আবার একত্রিত হয়, তার পরের দিন সানডে টাইমস পত্রিকায় ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, 'গণহত্যা'।
এটি খুবই শক্তিশালী একটি নিবন্ধ ছিল। কারণ মাসকারেনহাস পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন ও তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন। নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ''সামরিক ইউনিটগুলোর হত্যা আর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযান আমি নিজে দেখেছি। বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর শহর আর গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দেখেছি।
আমি দেখেছি, পুরো গ্রামের ওপর শাস্তিমূলক অভিযান চালাতে। অফিসার্স মেসে রাতের বেলায় কর্মকর্তাদের বলাবলি করতে শুনেছি যে, তারা কতটা সাহস দেখিয়ে সারাদিন ধরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। 'আপনি কতজনকে মেরেছেন? তাদের একজন আরেকজনকে এভাবে প্রশ্ন করছিলেন, আমার এখনও মনে আছে।''
এই প্রতিবেদন প্রকাশকে পাকিস্তান প্রতারণা হিসেবে দেখেছে এবং অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে শত্রু এজেন্ট হিসেবে গণ্য করেছে। তার এই প্রতিবেদনের তথ্যকে তারা অস্বীকার করে একে ভারতীয় প্রোপাগান্ডা হিসেবে দাবি করেছে। এরপর থেকে লন্ডনেই বাস করেন মাসকারেনহাস ও তার পরিবার।
তবে তারপরেও সবসময়েই পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এসেছেন মাসকারেনহাস। ১৯৭৯ সালে তিনিই প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যে, পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করছে। ১৯৮৬ সালে তিনি লন্ডনে মারা যান। বাংলাদেশে তাকে এখনো স্মরণ করা হয় এবং তার এই নিবন্ধটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। সূত্র: বিবিসি।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com