যেভাবে ‘যুদ্ধ’ হলো পাক-ভারত টিভি স্টুডিওতে

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

গত মাসের মাঝামাঝি ভারতের পুলওয়ামাতে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জনের মত ভারতীয় সেনা নিহত হবার পর চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয়। কিন্তু সীমান্তে যখন একটু একটু করে উত্তেজনা বাড়ছে, তার ছোঁয়ায় দুই দেশের টিভি স্টেশনগুলোতে উত্তেজনার পারদ উঠেছে অনেক ওপরে।

দুই দেশের গণমাধ্যমকেই পরে পক্ষপাত ও উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কতদূর গেছে সেই যুদ্ধ – বিবিসি সাংবাদিক রাজিনি ভৈদ্যানাথান এবং সেকান্দার কিরমানি দুইজন বিশ্লেষণ করেছেন এই টিভি যুদ্ধ।

ভারত পাকিস্তানের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্কটি যেন ২৬শে ফেব্রুয়ারি আরও খারাপ হয়ে গেল। পুলওয়ামার জবাব হিসেবে সেই দিন ভারত ঘোষণা করে পাকিস্তানের বালাকোটে জঙ্গিদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে।

একদিন পর ২৭শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান ভারতের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এবং এর পাইলটকে আটক করে। পরে দু’পক্ষের মধ্যে শান্তির আকাঙ্ক্ষায় পাইলট আভিনন্দন বর্তমানকে কে মুক্তি দেয়া হচ্ছে বলে জানায় পাকিস্তান।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, যুদ্ধে দুই দেশের কেউই জিতবে না। আর এই উত্তেজনায় শামিল হয় দুই দেশের জনগণ, বিশেষ করে ভারতের টিভি সাংবাদিকেরা।

রাজিনি : সীমান্তের উত্তেজনা ভারতের টিভিগুলোতে পরিষ্কার বোঝা গেছে। ঘটনার খুঁটিনাটি বর্ণনা হাজির করে ভারতীয় সাংবাদিকেরা এই সময় কাভারেজে বাড়তি উত্তেজনা করেছেন। আর সেই কাভারেজ প্রায়ই জাতীয়তাবাদী প্রচারণার মতই হয়েছে,

বিশেষত যখন ‘পাকিস্তান ভারতকে একটা শিক্ষা দিলো’ কিংবা ‘কাপুরুষোচিত পাকিস্তান’ কিংবা ‘শান্ত থেকে জবাব ভারতের’ এ ধরণের শিরোনাম টিভি পর্দায় লেখা হয়েছে। কিছু সাংবাদিক ও বিশ্লেষককে দেখা গেছে ভারতের উচিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো এমন মন্তব্য করতে।

দক্ষিণ ভারতে একজন রিপোর্টার যুদ্ধসাজে একটি খেলনা বন্দুক হাতে নিয়ে একটি পুরো অনুষ্ঠান করেন। আমি যখন ভারতীয় পাইলটের প্রত্যাবর্তনের ঘটনা কাভার করতে যাই, আমি দেখেছি একজন নারীর গালে ভারতীয় পতাকা আঁকা। মুচকি হেসে তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘আমিও একজন সাংবাদিক।’

ভারতের প্রিন্ট মিডিয়ার একজন সাংবাদিক দেশটির টিভি সাংবাদিকেরা সাংবাদিকতার মূল নীতিগুলো যেমন পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ থেকে কাজ করার কথা ভুলে গেছেন বলে কঠোর সমালোচনা করেন। কিন্তু সেসব সমালোচনা গায়েই মাখেননি টিভি সাংবাদিকেরা।

কিরমানি : ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করার পরই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী একটি সংবাদ সম্মেলন করে। সম্মেলনের শেষে সাংবাদিকেরা স্লোগান দেন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’

দেশপ্রেমিক সাংবাদিকতার এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। বেসরকারি টিভি চ্যানেল নাইন্টিটু নিউজের দুইজন উপস্থাপক সামরিক পোশাক পড়ে সংবাদপাঠ করেন। তবে পাকিস্তানের অনেক সাংবাদিক সে ঘটনার সমালোচনা করেন।

তবে সামগ্রিকভাবে ভারতের সাংবাদিকেরা যখন সামরিক পদক্ষেপের কথা বলছিলেন, পাকিস্তানের সাংবাদিকেরা তখন ভারতকে ‘যুদ্ধবাজ ও হিস্টিরিয়াগ্রস্থ’ বলে তামাশা করতে দেখা যায়।

ভারতে এক রিপোর্টে দেখা যায়, একজন কৃষক পাকিস্তানে টমেটো রফতানি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, সেটা নিয়ে একজন উপস্থাপক ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘টমেটিক্যাল হামলা’ শুরু হয়েছে।

রাজিনি : টিভি নেটওয়ার্কে কিছুক্ষণ পরপরই বুলেটিন প্রচার হচ্ছিল। যুদ্ধের ময়দানে কী ঘটছে, তারচেয়ে বেশি দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমের চলতে থাকা যুদ্ধের দামামা বাজানো গরম বক্তৃতা আর রিপোর্টাররা কী খবর দিয়েছে – সেটা নিয়ে আলোচনা চালাতে।

এমনকি সরকারের নেয়া পদক্ষেপকে প্রশ্ন করার বদলে সরকার কোথায় কী বলছে, বা করছে, সেই রিপোর্ট করা হচ্ছিল বারবার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে সাংবাদিকদের ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন করায় ঘাটতি রয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। তবে সে অভিযোগ ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময়ও করা হয়েছিল।

কিরমানি : বালাকোটে বিপুল সংখ্যক জঈশ-ই-মোহাম্মদ জঙ্গিকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে বলে ভারতের যে দাবী তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমগুলো। পাকিস্তানের প্রভাবশালী টিভি উপস্থাপক হামিদ মীর ঐ এলাকায় নিজে গেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, ‘আমরা সেখানে জঙ্গিদের বানানো কোন স্থাপনা দেখিনি, সেখানে কোন মরদেহ দেখতে পাইনি, আর কোন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও হতে দেখিনি। আসলে আমরা সেখানে একটি মরদেহ দেখেছি, সেটা একটা কাক।’

এরপর ক্যামেরা প্যান করে একটি মৃত কাককে দেখিয়ে মীর দর্শকদের জিজ্ঞেস করেন ‘একে দেখে কি সন্ত্রাসী মনে হয়?’ ভারতের দাবী অনুযায়ী, ঐ অঞ্চলে জঙ্গি সংগঠনের কোন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আক্রান্ত হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকেরা সেখানে জঈশ-ই-মোহাম্মদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন একটি মাদ্রাসা খুঁজে পেয়েছে, যা হামলার জায়গার খুব কাছেই অবস্থিত। সামাজিক মাধ্যমে ঐ মাদ্রাসায় যাবার রাস্তা বাতলে দেবার সাইনপোস্টও রয়েছে, যেখানে বলা হয়ে মাদ্রাসাটি মাসুদ আজহারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

মাসুদ আজহার জঈশ-ই-মোহাম্মদের প্রতিষ্ঠাতা। বিবিসি এবং আল জাজিরা ঐ সাইনপোস্টের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু যখন রয়টার্সের সাংবাদিক সেটি দেখতে যান, ততক্ষণে সেটি মুছে ফেলা হয়েছে।

পাকিস্তানি টেলিভিশন সাংবাদিকদের কেউই নিজে প্রমাণ খুঁজতে যাননি। গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করলে সেখানে হেনস্তার শিকার হওয়া কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী তকমা পাবার আশংকা রয়েছে।

রাজিনি : সাধারণ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে তিনি নিজের কয়েকটি বড় জনসভায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি এখনো বিষয়টি নিয়ে কোন সংবাদ সম্মেলন কিংবা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেননি।

তবে এটা কোন বিশেষ ঘটনা নয়, মোদি খুব কমই সংবাদ সম্মেলন করেন বা সাক্ষাৎকার দেন। পুলওয়ামায় হামলার সময় মোদির ফটোশ্যুট চলছিল, তার জন্য তিনি বিস্তর সমালোচনার শিকার হয়েছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও তার সমালোচনা করেছেন।

আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে মোদি ভোট টানার চেষ্টা করছেন এমন সমালোচনাও রয়েছে দেশটিতে।

কিরমানি : এই উত্তেজনার সময় সংকট সমাধানে ইমরান খানের পরিমিত আচরণের জন্য তিনি এমনকি তার অনেক সমালোচকের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় টিভি ও পার্লামেন্টে দুইবার হাজির হন ইমরান খান, প্রতিবারই তাকে দৃঢ়চিত্ত মনে হয়েছে, কিন্তু তিনি ভারতের প্রতি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

তার পরিমিতির কারণেই পাকিস্তানের টিভিগুলো কিছুটা সংযত আচরণ করেছে। আটক পাইলটকে ছেড়ে দেবার ঘটনায়ও ইমরান খান প্রশংসা পেয়েছেন। টুইটারে ইমরান খানকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেওয়ার দাবি নিয়ে হ্যাশট্যাগ চালু হয়েছে।