রিমা সুলতানা রিমু (১৯)। কক্সবাজারের রামুর রাজারকুল পশ্চিম সিকদার পাড়ার কৃষক আবদুর রহিম ও গৃহিণী খালেদা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন মাত্র।
জাগো নারী উন্নয়ন সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী হয়ে সমমনা তরুণীদের নিয়ে দলবেঁধে পাড়া-মহল্লা, রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে বয়স্ক নারীদের সাক্ষরতা থেকে শুরু করে সমাজের ভালো কাজগুলো করতেন। বাল্যবিয়ে রোধ কেন প্রয়োজন তা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়েও আলোচনা করতেন। এ বিষয়ে নারীদের সচেতন করতেন।
কোভিড-১৯ এর শুরু থেকে চলমান সময়েও রিমুর স্বেচ্ছাসেবক দল নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণবিরোধী র্যালি থেকে শুরু করে ধর্ষণ বিষয়ে সচেতনতা নিয়েও কাজ অব্যাহত রয়েছে তার দলের।
এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র জরিপে অগ্রগামী ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন অজপাড়ার অদম্য আত্মপ্রত্যয়ী তরুণী রিমু। বিরল এ সম্মাননা তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। এ বিশ্ব স্বীকৃতির প্রতিদানে আরও বেশি মানবতার কল্যাণে কাজ করতে চান তিনি।
বিবিসির অদম্য ১০০ নারীর তালিকায় স্থান করে নেয়ার পর কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কক্সবাজারের রামুর মেয়ে রিমু।
রিমু বলেন, ‘মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) গণমাধ্যমের সংবাদে বিবিসির ১০০ নারী তালিকায় বাংলাদেশের যে দুজন নারী স্থান পেয়েছেন, তার মধ্যে আমার নামটিও রয়েছে দেখে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। একাধিক সংবাদমাধ্যমে একই খবর দেখে খুশিতে দৌড়ে মাকে জাপটে ধরেছি। তারপর ছুটে গেছি, যার অনুপ্রেরণায় আজকের এ স্বীকৃতি পেয়েছি সেই এনজিও জাগো নারী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী শিউলি ম্যামের কাছে।’
বিবিসির বাছাই করা ১০০ নারীর মাঝে স্থান পাওয়ার অনুভূতি সম্পর্কে রিমু বলেন, ‘এতদিন কাজ করেছি খেয়ালিপনায়। আজ থেকে দায়িত্ব বেড়েছে। সে হিসেবে এখন আমার যাত্রা নতুন করে শুরু হলো।’
ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে অদম্য এই তরুণী বলেন, ‘আমি মনে করি নারীরা সাহসী হলেই এগিয়ে যাওয়া সহজ। সাহস না থাকায় নারীরা অনেক কিছুতেই রয়েছে পিছিয়ে। নারীরা সাহস করে কিছু না বলায় অনেক সমস্যারও সমাধান হয় না। এমন স্বভাবের নারীরা গ্রাম-শহর সবখানেই কষ্টে রয়েছে। তাদের কষ্ট আমাকে পীড়া দেয়। আবার অনেক প্রতিভাবান নারীর রয়েছে অনেক কিছু উদ্ভাবন। কিন্তু এসবের কেউ খোঁজ নেয় না। পিছিয়ে থাকা এসব কর্ম নিয়েই আমি কাজ করতে আগ্রহী।’
তিনি বলেন, ‘আমার চাওয়া বাংলার একজন নারীও পেছনে পড়ে থাকবে না। স্কুলে পড়াকালীন আমিও ভাবতাম সবকিছু মেনে নিয়ে চুপ করে থাকাই নারীর নিয়তি। কিন্তু জাগো নারীর সঙ্গে যোগ দিয়ে বুঝলাম আমার ধারণা ভুল। কলেজে গিয়েই নিজেদের অধিকার নিয়ে কাজ করার বাসনা জাগলো। সাহস নিয়ে শুরু করেছি বলেই আল্লাহ আমাকে ভালো কাজের প্রতিদানও দিয়েছেন। তাই প্রত্যেক নারীদের সাহসী করে তুলতে কাজ করে যাব।’
রিমু বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার নারী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি আমাদের রামু এলাকারই মেয়ে। তারা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বিভাগে নারীরা বড় বড় পদে কাজ করে নিজেদের যোগ্যতার সাক্ষর রেখেছেন ও রাখছেন। আমিও উনাদের মতো পরিশ্রমী নারী হয়ে সমাজ পরিবর্তনে কাজ করে যেতে চাই।’
প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে হিসেবে রিমুর বেড়ে ওঠাও বন্ধুর ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে স্কুলজীবন পার করার পর নিজেকে পরার্থে বিলাতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেই। আমার মতের সঙ্গে মেলে এমন কয়েকজনকে খুঁজব না পেলে একলা হাঁটব। আমার সিদ্ধান্তে মা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খালেদা ম্যাডাম সাহস জোগালেন।’
‘তাদের সাহসকে পুঁজি করে জাগো নারী উন্নয়ন সংস্থার রামু অফিসে এলাম। এনজিওটিতে স্বেচ্ছায় কাজ করতে এসেছি বলার পর প্রথম দর্শনে সংস্থার চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী শিউলি শর্মা ম্যাম তেমন পাত্তাই দিতে চাননি। পরে একটি দলভিত্তিক কাজ দিয়ে পরীক্ষা নিলেন। কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে দায়িত্ব দিলেন, ‘গার্লস অ্যাম্বাসেডর ফর পিস’ নামের একটি প্রকল্পে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অব উইমেন পিস বিল্ডার্সের (জিএনডাব্লিউপি) সহায়তায় সমাজ পরিবর্তনে কাজ করা হয় এ প্রকল্পের আওতায়। আমি হয়ে গেলাম শান্তির দূত। কক্সবাজারভিত্তিক ইয়াং উইমেন লিডার্স ফর পিসের সদস্য হিসেবে রয়েছি আমি।’
রিমু বলেন, ‘আমার মতো আরও অনেক নারীকে নিয়ে দলবেঁধে পাড়া-মহল্লা, রোহিঙ্গা শিবিরসহ এনজিওটির নির্ধারিত অফিসে যাই। সেখানে বয়স্ক নারীদের সাক্ষরতা থেকে শুরু করে সমাজের ভালো কাজগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে শেয়ার করি। বাল্যবিয়ে ও নারীর সহিংসতা রোধ নিয়ে আমরা কাজ করি। সঙ্গে কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় আমি স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে রিমু বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই পড়ালেখায় রয়েছি। চলতি বছর অটোপাসে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি। এনজিওতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজের পাশাপাশি টিউশনি ও রামু সদরে গ্লোবাল ইংলিশ লার্নিং সেন্টার নামের একটি স্পোকেন ইংলিশ প্রতিষ্ঠানের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করছি। আমার ছোট বোন সানজিদা মুশতারি ইমান এবং কামরুল হাসান জিহাদ স্কুলে পড়ছে।’
সরকারের কাছে নিজের জন্য কোনো চাওয়া নেই জানান রিমু। তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে চাই যুবাদের সৃষ্টিশীল মেধার মূল্যায়ন। উপজেলা লেভেলে যুব উন্নয়নের গদবাধা প্রশিক্ষণের পরিবর্তে চাহিদামাফিক প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে যুবাদের যোগ্য করে তুলতে ব্যবস্থা করা।’
যুবাদের প্রতি রিমুর আহ্বান কোনো কাজ শুরুর পর বাধা এলে থেমে যাবেন না। বাধা সফলতার প্রথম ধাপ। মাদক থেকে দূরে থেকে পরিবেশ বিপর্যয় রোধে মুখ্য ভূমিকা যুবাদের রাখতে হবে। চলমান সময়টা করোনার দখলে। তাই সচেতনভাবে নিজের, পরিবারের এবং প্রতিবেশীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এতে দেশ এবং দশের কল্যাণ।