সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে সোমা আক্তার। আপাদমস্তক যাচাই করে মনে হলো, ছেলেটি প্রাপ্তবয়স্ক নয়-ওর পরনে বাদামি রঙের শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট। পোশাক দুটির একটিও নতুন না, বহু ব্যবহারে মলিন। মাথার কোঁকড়া চুল ঘাড় পর্যন্ত গড়িয়ে নেমেছে। চোয়াল ভাঙা। দাড়িমোছ শেভ করা, নাকি একেবারে উঠেইনি, খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টি না ফেললে বোঝা কঠিন। শেভ করার পর চামড়ার তলে দাড়ির কালচে যে ছোপ দেখা যায়, সেটা নেই। অতিরিক্ত শুকনো হওয়ার কারণে চোয়ালের মাঝখানে সামান্য খোড়ল। প্রথম দৃষ্টিতেই চোখে পড়ে গিলার মতো ঠেলে ওঠা গলার ওপরের হাড়টা। ঘন কালো মোটা ভ্রু-জোড়ার কারণে চোখ দুটো চোখে পড়ে না। দেখে মনে হয়, চোখ দুটো ভ্রুর তলে লুকিয়ে গেছে, ঠিক পাতার তলে লুকানো বোলতা সামান্য দেখা গেলে যেমনটা দেখায়। গায়ের রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিহীন গাঢ় কালো ঠোঁট-জোড়া দেখেই বোঝা যায় অতিরিক্ত সিগারেটের তাপে পোড়া। তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে পরখ করে ছেলেটিকে সোমা আক্তারের পছন্দ না হলেও আপাতত অভিব্যক্তিতে সেটা সে প্রকাশ করে না।
সার্চ লাইটের মতো সোমা আক্তারের দৃষ্টি বার কয়েক ঘুরে আসে ছেলেটির মুখমণ্ডলের ওপর থেকে। অনুমান করার চেষ্টা করে ওর বয়স কত হতে পারে? এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে প্রশ্ন করে-এই, বয়স কত তোমার?
প্রশ্নটির উত্তর না দিয়ে ছেলেটি মুখ টিপে হাসে। ওকে ওভাবে হাসতে দেখে বিরক্তিভরা কণ্ঠে সোমা আক্তার বলে-আরে, কী আশ্চর্য! বয়স জিজ্ঞেস করলাম আর তুমি গাল ভেটকে হাসছ? অকারণে হাসার মতো প্রশ্ন করেছি নাকি? আমি জানতে চেয়েছি, বয়স কত তোমার? এতগুলো কথা বিরতিহীন বলে পুনরায় প্রশ্ন করে-বয়স কত তোমার?
নির্বিকার ছেলেটি মাটিতে দৃষ্টি আবদ্ধ করে উত্তর দেয়, জে, উনিশ। সোমা আক্তারের মনে হলো, এই উত্তর দেওয়ার সময় কেমন এক হাসির রেখা ফুটে উঠে দ্রুত মিলিয়ে গেল। নবাগত বলে হাসিটা ইয়ার্কির, নাকি স্বভাবসুলভ, সেটা অনুধাবন করে উঠতে পারল না।
ক্ষীণ ও ক্ষণস্থায়ী হাসিটা গভীর সন্দেহের উদ্রেক ঘটায় সোমা আক্তারের মনে। মিথ্যে কথা, তোমার বয়স উনিশ হয় কী করে? আমার তো মনে হচ্ছে, তোমার বয়স এখনো পনেরো হয়নি!
আমি কইলাম আমার বয়স উনিশ, আর আপনে কন যে আমার বয়স উনিশ হয় নাই, তাইলে আপনে যেইটা কন সেইটাই সই। ওর প্রতিবাদের ভাষা দৃঢ় নয়। শব্দগুলো সে উচ্চারণ নয়, মনে হলো পানের মতো দাঁতের তলে ফেলে চিবাল। কান পেতে না শুনলে হয়তো অর্থ উদ্ঘাটন সম্ভব হতো না। ছেলেটির উত্তর দেওয়ার এ ধরনে সোমা আক্তারের চেহারায় বিরক্তি ও বিস্ময় যুগপৎভাবে স্পষ্ট হয়।
তখন সোমা আক্তারের মনে পড়ে ন্যাশনাল আইডি কার্ডের কথা। বয়স যাচাইয়ের আরেকটি উপায় হলো ন্যাশনাল আইডি কার্ড। তৎক্ষণাৎ সোমা আক্তার প্রশ্ন করে-এই, তোমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে?
জি, আছে।
কই, দেখি?
এইডা আমার লগে নাই, বাড়িতে রাইখা আসছি।
ওটা কালকে নিয়ে আসবে, ওটাতে তোমার বয়স কত, দেখতে চাই।
সোমা আক্তারের সামনে মাথা নিচু করে ছেলেটি অনুগত ভাব দেখায়-জে…; কিন্তু নিঃশব্দে আওড়ায়-কী আশ্চর্য, বেটি আমার বয়সের পিছে লাগল ক্যান? আমারে নি হ্যার পোলার বাপ বানাইব! যত্তসব।
ম্যাডাম একটা কথা কই?
হ্যাঁ, বলো?
ম্যাডাম আমগো দেশে চৌদ্দ-পনেরো বছরের মাইয়াগো বয়স বাড়াইয়া আঠারো বানায় বিয়া দেওনের জন্য। ন্যাশনাল আইডি কার্ড বানানির সময় আমার ছোট বোইনের বয়স চাইর বৎসর বাড়াইয়া দিছে মায়ে। তাইলে আগে আগে বিয়া দিতে পারব। আঠারো বছর হইলে গেরামে মাইয়ার বিয়া দেওন যায়? কয়, মাইয়াটা নাকি বুড়ি হইয়া গ্যাছে। বিয়ার জন্য যদি বয়স বাড়ানি যায়, তাইলে চাকরি পাওনের জন্য পোলাগো বয়স আডারো-উনিশ করা, হেইটাতে কি দোষের কিছু? বয়স যেইটা হইলো, হইলো! সেইডাতে কী আইয়ে-যায়, আমার লাইসেন্স দিয়া কথা। লাইসেন্স থাকলে তো আর সমুস্যা নাই, কী কন?
মানে? তুই বললেই হলো? অ্যাডাল্ট না হলে লাইসেন্স তো লিগ্যাল হবে না! নিশ্চয়ই একটা দুনম্বরি লাইসেন্স বের করে নিয়ে এসেছিস? এইটুকু ছেলের সঙ্গে তুমি তুমি বলার প্রয়োজন বোধ করে না সোমা আক্তার। সে দ্রুত তুমি থেকে তুই সম্বোধনে চলে আসে।
আইচ্ছা ম্যাডাম, একটা কথা কই-লাইসেন্স দুই নম্বরি, নাকি তিন নম্বরি হেইটাও কথা না, কথা হইল কাম চলে কি না? আপনে গাড়িতে বসেন, দ্যাখেন আমি ক্যামন চালাই, যদি একসিডেন করি, তখন কইয়েন যে আমার বয়সটা ঠিক নাই, আমি নাবালক নাকি সাবালক।
তার মানে তোর উত্তরগুলোর সারমর্ম হলো-দুটোতেই চোরামি। প্রথমত, তোর বয়স উনিশ হয়নি। আর দ্বিতীয়ত, তোর লাইসেন্সটাও দুনম্বরি?
না, জি…না…
জি না আবার কী কথা? তোর জি না বলার ভেতরে তো কোনো স্ট্রেংথ নেই, স্ট্রেংথ বুঝলি স্ট্রেংথ? স্ট্রেংথ মানে জোর, শক্তি, দৃঢ়তা! তোর কণ্ঠে জোর নেই, দুটো উত্তরই দিলি মুরগির ছাওয়ের মতো চিঁচিঁ করে। এটাতেই প্রমাণ হচ্ছে, তুই সত্যি বলছিস না!
ম্যাডাম, ব্যাপারটা হইল গাড়ি চালানিটা, ধরেন গিয়া এইটা একটা টেরনিংয়ের কাম, এই টেরনিংটা কে কত ভালোমতো নিতে পারল, বয়সটয়স দিয়া কিছু হয় না। কত ব্যাডা আছে, ধরেন গিয়া পঞ্চাশ বছরের বুইড়া, তাই বইলা কি স্যায় আমার থেইকা ভালো গাড়ি চালাইব? নিশ্চয়ই না, কারণ হইল, কার টেরনিংটা কত ভালো হইছে! কত সিনিয়ার ডেরাইভার আছে, আমার ধারেকাছেও আইতে পারব না, যদি ধরেন কমপিটিশনে আসে।
আচ্ছা, দাঁড়া। তুই এইখানে দাঁড়া। আগে আমি জরুরি কথা বলে নিই আপার সঙ্গে। সোমা আক্তার গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে ধাস শব্দে গাড়ির ডোর টেনে বন্ধ করে দেয়।
মোবাইল ফোনের বাটন টিপে কানের সঙ্গে চেপে ধরে। অন্য প্রান্ত থেকে উত্তর না এলে তার অভিব্যক্তিতে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট হয়। বেশ কয়েকবার অস্থির হাতে ডায়াল করার পর অন্য প্রান্ত থেকে হ্যালো শোনা গেলে সোমা আক্তার অস্থির কণ্ঠে বলে-আপা, আপনি তো ফোনই ধরছেন না। আমার তো আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে। সোমার কণ্ঠে যতটাই উদ্বেগ, অস্থিরতা; ওপাশের কণ্ঠস্বর ঠিক ততটাই শীতল, শান্ত, নিরুদ্বেগ।
আমি তো অস্ট্রেলিয়াতে কথা বলছিলাম, বলো, কী বলবা বলো। ড্রাইভার গেছে নাকি গাড়ি নিয়া? পথটথ কিচ্ছু চিনে না, আমার ছোট ছেলেকে দিতে হইলো ওর লগে। এখন আবার তিন শ টাকা খরচ এইটার জন্য।
কই আপা, আপনার ছোট ছেলেকে তো দেখছি না?
ওই তো গেট পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া চইলা গ্যাছে।
আয় হায়, কেমন করে গেল?
হ্যার বন্ধু গ্যাছিলো পিছে পিছে হোন্ডা নিয়া, হ্যার ওই দিকেই কাম আছে, তাই আমি না আইসা ওরেই লগে দিয়া দিলাম।
ড্রাইভারটা তো এসেছে আপা, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে ওর বয়স এখনো আঠারো হয়নি! একেবারে বাচ্চা ছেলে।
অন্য প্রান্ত থেকে ভঅস্…একটা শব্দ শোনা যায়, তারপর পুনরায় ভেসে আসে-শুনো সোমা, বয়স যা হউক সেইটা সমস্যা না, আমি ছ্যাঁড়ারে দেখছি। হইবো, কাম চইলবো। মনে তো হইলো আঠারোটাডারো হইবো। বুঝো না, গরিবের ঘরের পোলাপানরা তো ঠিকমতো খাইতেখুইতে পায় না, তাই শরীর বাড়ে না, গড়নগাড়ন শুকাইয়া চিমসাইয়া থাকে। তোমার তো আইজ থেইকা কাম শুরু, আইজ আর নতুন কোনো ড্রাইভারের খবর নাই আমার কাছে। ভাঙা মাসে ড্রাইভার পাওয়া যায় না। এইডারে দিয়া আইজকার কাম চালাও, দেখো কেমন চালায়, যদি দেখো ভালো চালাইতাছে তাইলে এইডারে দিয়াই চলবো।
সামান্য একটু বিরতির পর আবার শোনা যায়, আর যদি দেখো ভালো চালায় না, তাইলে আরেকটারে খুঁজতে হইবো। আইজকাল বাড়িতে বাড়িতে গাড়ি। গ্যাস আসোনের পর বাড়িতে বাড়িতে গাড়ি হইছে, হইবো না ক্যান! আমার গাড়ির মতো একটা গাড়িতে গ্যাস লাগে দিন আড়ই শ-তিন শ টাকার। আরো কমেও সারানি যায়। তাই আইজকাল পছন্দমতো ড্রাইভার পাওন যায় না। গার্মেন্টস হওনের জন্য যেমন কামের ছেড়িদের পাওয়া যায় না, আবার সিএনজি গ্যাস হওয়ার জন্য ড্রাইভার পাওয়া যায় না। একটা সিনিয়ার ড্রাইভারের ব্যাতন ধরো মাসে কুড়ি থেইকা পঁচিশ হাজার টাকা, সব কিছু দিয়া-থুইয়া। এত টাকা দিয়া তো আর আমরা ড্রাইভার রাখতে পারি না। সিনিয়ারগুলারে রাখে হইলো গিয়া বড় বড় অফিস, কম্পানি-হ্যারা। এই জন্য জুনিয়ারগুলা দিয়া আমগো মতো মানুষেরা কাম চালায়। কুত্তা দিয়া গু খাওয়ানি আর কি! যাকগা, তুমি আইজকার দিনটা দ্যাখো, এইটা কেমন চালায়।
ওহ, আচ্ছা, তো আপা, এই ড্রাইভারটাকে কত দিতে হবে?
আমি তো ওকে বারো হাজার টাকায় ঠিক করছি, তবে তুমি ওর সঙ্গে ব্যাতন নিয়া কোনো কথা বইলো না, আমি দরাদরি কইরা নিছি তো, তাই আমারেই এই ব্যাপারে কথা কইতে দিয়ো। তুমি খালি দিনে এক শ টাকা দিয়ো দুপুরে খাওয়ার জন্য। আর যেই দিন রাইত হইয়া যাইব সেইদিন রাইতরের জন্য এক শ টাকা এক্সট্রা দিয়ো। কারণ কম্পানির গাড়ি দশ ঘণ্টার পর ওভার ডিউটি চার্জ করে। এই দুইটা পেমেন্টের বাইরে তুমি যদি হ্যারে দুই-দশ টাকা বকশিশ দেও অথবা দুই-এক বেলা খাইতে দেও, সেগুলি তোমার ব্যাপার। সেগুলি হিসাবের বাইরে, আর হ্যাঁ, রাইতরে গাড়ি আমার বাসায় রাইখা যাইব, এইটা ফাইনাল হইছে, তোমার তো পার্কিং নাই, সে জন্য। তুমি চেষ্টা কইরো ওরে আটটার মইধ্যে ছাইড়া দিতে। তাইলে ও দশটার মইধ্যে আইয়া পড়তে পারব। তোমার ওইখান থেইকা আমার এইখানে আসতে জ্যামজুম মিলা দুই ঘণ্টার বেশি লাগবো না।
সোমা আক্তারের চেহারায় হতাশার ভাব স্পষ্ট হয়, দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস মোবাইল ফোনের ওপরে ছেড়ে বলে-আচ্ছা, ঠিক আছে আপা, বুঝলাম, এখন তাহলে রাখি, আমার দেরি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, শোনো, তুমি খেয়াল রাইখো ক্যামন চালায় সেইটার ওপরে। ডাইনে বাঁয়ে কাওরে যেন লাগাইয়া না দেয়, সেইটার দিকে নজর দিও, উল্টাপাল্টা চালাইলে ডাক দিয়ো, ঠিক আছে?
জি, আপা, আচ্ছা, আল্লা হাফেজ, রাখি তাহলে?
আচ্ছা, আল্লা হাফেজ।
টাকা সেভ করার বুদ্ধি
দিলরুবা আহমেদের সঙ্গে কথা শেষ হলে সোমা আক্তার গাড়ির দরজা খুলে গলা লম্বা করে গাড়ির বাইরে বের করে ড্রাইভারকে ডাক দেয়-এই, এই, আসো, আসো। চলো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। শোনো, সাবধানে চালাবে, ডাইনে-বাঁয়ে ভালো করে চোখ রাখবা। বিশেষ করে রেলগেটের কাছে। আজ আমার কাজের ফার্স্ট ডে, খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে আছি। সাবধানে চালাইয়ো, আবারও কিন্তু বলতেছি, কাউরে ধাক্কাধুক্কা মাইরো না।
জি ম্যাডাম, ঠিক আছে। পুনরায় সে হাসে, মনে মনে বলে-আপনের কামে ফার্স্ট দিন, আমারও কামের ফার্স্ট দিন।
কী নাম তোর? একবার তুমি একবার তুই হয়ে যাচ্ছে। কারণ সোমা আক্তারের মনে হলো, একে তুমি বলার প্রয়োজন নাই।
ইসুব।
ইসুব আবার কেমন নাম?
ম্যাডাম ইসুব, ইসুব…পুরা নাম হইলো মোহাম্মদ ইসুব আলী।
বানান করিস কী করে?
রসসো ই রসসো উ দনতনস রসসু ফঅ।
ওহহ, ইউসুফ। বুঝেছি, ইউসুফ। তো ইউসুফটাকে ইসুব করল কে?
বাপে আর নইলে মায়ে হইতে পারে, মনে হয়, ছোডব্যালা থেইকাই ইসুব ডাকে।
গুড…গুড…শর্টকাট। তো ইসুব সাহেব, আমি কিন্তু বলছি খুব সাবধান, এইটা তো আমার গাড়ি না, আমি ভাড়া নিয়েছি, এই গাড়িটার মালিক হইল দিলরুবা আপা, যার বাসা থেকে তুমি গাড়িটা নিয়ে আসছ আজ। যেই আপা তোমাকে চাবি বুঝাইয়া দিছে, বুঝলা? দেইখা-শুইনা সাবধানে চালাইয়ো।
ঠিক আছে ম্যাডাম।
শোনো, তুমি আমাকে ম্যাডাম ডাকবে না, স্যারের মতো ম্যাডাম হলো ইংরেজদের ভাষা, মহিলাদের প্রতি শ্রদ্ধাসহকারে অ্যাডরেস করার জন্য। কিন্তু এটা এখন বাংলাদেশে শুধু একজনকে বোঝায়। আমি খালেদা জিয়া না, বাংলাদেশে ম্যাডাম বলতেই খালেদা জিয়াকে বোঝায়, ওটা তাঁর ট্রেড নেম, আমাকে তুমি আপা ডাকবে, আপা।
জি ম্যাডাম, ঠিক আছে।
কী আশ্চর্য, নিষেধ করলাম, তার পরও ম্যাডাম ডাকলি? আমার নিষেধটা তোর কানে গেল না? কেউ আমাকে ম্যাডাম ডাকলে আমার মেজাজ খুব চড়ে যায়। ইচ্ছা করে…যত্তসব ইডিয়েট, মেয়েলোক দেখলেই ম্যাডাম মনে হয়?
জি না, ম্যাডাম…বলেই এবার সে দুই সারি দাঁতের নিচে জিহ্বাটা কামড়ে ধরে।
আরে, প্রতিবারই ম্যাডাম বলছিস, অথচ নিষেধ করলেই বলছিস ঠিক আছে! ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! যা…যা…স্টার্ট দে, বলে দুম করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে পেছনের সিটে জুতমতো বসে, তখন সোমার কপালে গোটা কয়েক বিরক্তির ভাঁজ।
ঘ্যাএ্যাএ্যাএ্যাস শব্দে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ম্যাডাম, কই যামু?
লালমাটিয়া যা, লালমাটিয়া।
গাড়ি খিলক্ষেত ধরে এগোতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ইসুব ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চায়, ম্যাডাম, লালমাটিয়াটা কোন দিকে, একটু কইয়া দিয়েন।
কী আশ্চর্য! তুই লালমাটিয়া চিনিস না? লালমাটিয়া!
আমি তো ম্যাডাম ঢাকা আসার আগে ছয় মাস নারায়ণগঞ্জে গাড়ি চালাইছি, মনে করেন গিয়া আমার গেরামের বাড়ি হইল কুমিল্লা। ঢাহা শহরে তো আসা হয় নাই এর আগে। কয়েক মাস ডিউটি করলেই সব চিনা ফালামু।
আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুই যা, আমি দেখিয়ে নেব, সোজা রেলগেট থেকে বাঁয়ে যেতে হবে। ঢাকার দিকে যেতে হলে সব সময় রেলগেট থেকে বাঁয়ে যাবি, আর যদি এয়ারপোর্ট, উত্তরা এইগুলা বলি তাহলে রেলগেট থেকে ডাইনে, তখন একদম ওই সামনে থেকে ঘুইরা আসতে হবে। এইটা মনে রাখিস।
লালমাটিয়া এসে অফিসে সংক্ষিপ্ত মিটিং শেষে সোমা আক্তার বের হয়ে পুনরায় গাড়িতে ওঠে। গাড়িতে উঠে ওর মনে পড়ে, ইসুব রাস্তাঘাট তেমন চেনে না। ইসুবকে ডিরেকশন দিয়ে চিনিয়ে নিয়ে আসতে হয় সাতাশ নম্বরের ওপরে জিনজিয়াং চায়নিজ রেস্টুরেন্টে।
মারিয়া এসেছে কানাডা থেকে। ওর সঙ্গে লাঞ্চসহ মিটিং। মিটিং শেষ হলে সোমা আক্তার উদ্বৃত্ত খাবারগুলো প্যাকেট করে দিতে বলে। বিল পরিশোধ করে সোমা আক্তার খাবারের প্যাকেট হাতে নেমে আসে।
সোমা আক্তারকে দেখে ইসুব গাড়ি থেকে বের হয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সোমা আক্তার খাবারের ব্যাগটা ইসুবের হাতে দিয়ে বলে-এত খাবার দিয়েছে যে আমরা মাত্র দুজন শেষ করতে পারিনি। তোর জন্য তাই নিয়ে এলাম। ভেবেছিলাম মিটিং শেষ হয়ে যাবে এক ঘণ্টার ভেতরে। কিন্তু দেরি হয়ে গেল। স্যরি, অনেক পরিমাণ খাবার দেখে তোকে আর খেয়ে আসতে বলিনি। এক কাজ কর, আমাদেরকে আড়ংয়ে নামাবি এখন, আড়ংয়ে আমাদের দু ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। এই অবসরে তুই খেয়ে নিস। অনুগতভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় ইসুব।
এখানে আজ জরুরি মিটিং অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট চাইল্ড লেবার প্রজেক্টের। রিপোর্টিং অ্যান্ড ডকুমেন্টেশনের সবটুকু দায়িত্ব তাঁর, কাজটা শেষ করে দিতে হবে তিন মাসের মধ্যে। এই রিপোর্টিং আর ডকুমেন্টেশনের ওপর নির্ভর করছে এবারের ফান্ডিংয়ের বড় একটা অংশ। এত দ্রুত কাজের জন্য তাঁর একটা গাড়ি দরকার হলো।
গত সপ্তাহে দিলরুবা আপার সঙ্গে দেখা হলো কুলখানির মিলাদে। সোমা আক্তার সেখানেই আলাপ প্রসঙ্গে দিলরুবা আপাকে জিজ্ঞেস করে, ভালো গাড়ি কারা ভাড়া দেয়? কথাটা বলতেই দিলরুবা আপা একেবারে লাফিয়ে উঠলেন-তাই সোমা? তোমার গাড়ি লাগব? বাব্বা, তোমার দেখি অনেক উন্নতি হইছে। যাকগা, কম্পানির গাড়িতে অনেক সমস্যা। হ্যাগো গাড়ি ভাড়া কইরো না। তার থেইকা প্রাইভেটগুলি ভাড়া নিয়ো, অনেক দিক থেইকা সুবিধা পাইবা।
প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া দেয় তেমন কাউকে চেনেন?
প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া দেয় দুই-একজনরে চিনি। কিন্তু তাদেরকে কইতে লাগে এক মাস-দুই মাস আগে, মানে অ্যাডভান্স কইতে হয়।
কেন? এত দিন আগে বলতে হয় কেন?
বুঝো না, ভাড়া দিয়া ফ্যালে, হ্যাগো তো আর কম্পানির মতো অনেক গাড়ি থাকে না। মনে করো, যারা প্রাইভেট দেয় হ্যারা একটা অথবা দুইটা মাত্র গাড়ির মালিক। ধরো সব দিন গাড়ি লাগে না। তাই মাঝেমইধ্যে ভাড়া খাটায়। এতে কইরা ড্রাইভারের ব্যাতনটা উইঠা আসল, আবার নিজেদের বাড়িতে একটা গাড়ি থাকল। গাড়িটা একটা ইস্টাটাসের ব্যাপার না?
ওহ, আচ্ছা, তাই তো! সে তো বেশ ভালো বুদ্ধির কাজ। আমি তো আসলে এসব জানি না যে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। গাড়িও আবার রাখে কষ্ট করে স্টেটাসের জন্য! আমি তো মনে করি, যাদের গাড়ি আছে তারা বড়লোক। বড়লোক না হলে কি আর গাড়ির আরাম নেওয়া যায়!
কী যে কও, গাড়ি কিইন্যা মাসে মাসে দম যায় আর আসে এমন মানুষও আমি চিনি। আর তুমি কও আরাম! হুউ…
তা যাক, ওদের কথা ভেবে লাভ নেই, এখন আমার একটা গাড়ি ভাড়া নেওয়া দরকার আমার প্রজেক্টটার জন্য, কোনো স্টেটাসের জন্য না। ঢাকা শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ঘুরতে হবে চাইল্ড লেবারের ওপর ডকুমেন্টারির কাজে।
তো তোমার বাজেট কত গাড়ি ভাড়ার জন্য?
সেটা যা ভাড়া চায় তা-ই দিয়ে নিতে হবে, আমার গাড়ি ভাড়ার খরচ তো দেবে অফিস, তাই আমি ভাড়া নিয়ে ভাবছি না। এখন কাজ শেষ করা নিয়ে কথা। বিল যা সাবমিট করব, সেটাই পাব।
এক কাম করো না, তুমি আমার গাড়িটা ভাড়া নাও, মাত্র তিন মাসের তো ব্যাপার। আমার ছোটখাটো গাড়িটা দিয়া তোমার রিপোর্টিংয়ের কাম চইলা যাইব। তুমি আমারে মাসে বিশ হাজার টাকা দিয়ো। আমি তোমারে ষাট হাজার টাকার একটা রিসিট বানাইয়া দিমুনে। য্যামুন ত্যামুন গাড়ি মাসে ষাট হাজারের নিচে পাইবা না। তার ওপরে গ্যাস, ড্রাইভারের খাওনের খরচা হইল তোমার।
আপনি তো ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া দিচ্ছেন, রিসিট দেবেন কী করে?
আরে দূর, রিসিট একটা বানাইয়া দিমুনে, এইডা কোনো ব্যাপার হইলো? তোমারে আমি অনেকগুলা টাকা বাঁচাইয়া দিলাম, তোমার অফিসের কাম তো দিনের বেলা। তুমি দিনের বেলা কাম চালাইলা, আর সন্ধ্যার পর আমি কদ্দুর ব্যবহার করলাম। তাও সব দিন না, মাঝেমইধ্যে। এইটাতে আমাদের দুইজনেরই দুই রকম লাভ।
আড়ং থেকে ফিরে গাড়িতে পুনঃ প্রবেশের সময় সোমা আক্তারের নজরে আসে চায়নিজ ফুডের ব্যাগটা। সেটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে সোমা আক্তার বলে-কী রে চাইনিজ খাস নাই?
জি না ম্যাডাম, চাইনিজ ফুড খাইতে গেছিলাম; কিন্তু পারলাম না, ইছছ্ ক্যামনে খান আপনারা এগুলি, আমার বমি আইয়া পড়ছিল এইটা খাইতে গিয়া।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
একটা কথা কই ম্যাডাম?
হ্যাঁ, বল!
আমারে আর চাইনিজ দিয়েন না, এইডা খাইতে গেলে বমি আহে, আপনে আমারে খাইতে দিলে মাঝেমইধ্যে দেশি খাবার খাইতে দিয়েন। আমি দেশি ডাইল আর ভাত পাইলে আর কিচ্ছু চাই না।
চাকরিটা কেমুন?
কারওয়ান বাজারের সামনে জ্যাম। দুই পাশে কোথাও এক পা ফেলার জায়গা নাই। জ্যামে আটকে বসে আছে ইসুব। এরই ভেতরে দিলরুবা আহমেদ চারবার ফোন করেছে। মনে হচ্ছে, ঘড়ি ধরে বসে আছে। কী রে কত দূর? সাবধানে চালাইস। দেখিস আবার গাড়ি সামনে-পিছে গুঁতা লাগাইস না। আর হুন, এসি ছাড়িস না, গ্লাস নামাইয়া বইয়া থাকিস, যদি দ্যাখোস বেশিক্ষণ এক জায়গায় বইয়া আছস, জ্যাম ছুডনের কুনো লক্ষণ নাই, তাইলে স্টার্ট বন্ধ করি দিস, গ্যাস সেভ হইব-প্রতিবারই ফোনের সঙ্গে এসব উপদেশ দেয় ইসুবকে। আর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সময় ইসুব প্রতিবারই খেদ প্রকাশ করে-ধেৎ শালার চুতমারানি গাড়ির কামের গুষ্টি মারি-এই ধরনের বাক্যে দিনের ভেতর বহুবার সে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
জ্যামে বসে থেকে ইসুবের বিরক্তি ধরে না; বরং ভালোই লাগে। ফেরার এই সময়টাতে সে মোবাইলে কথা বলতে পারে। যতক্ষণ গাড়িতে ম্যাডাম আপা অথবা খালাম্মা ম্যাডাম বসে থাকে, ততক্ষণ তার কথা বলার উপায় থাকে না। এরই ভেতরে কথা হলো হাসি, আনু, ছবি, রোজিনার সঙ্গে। এবারও রিং বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে মোবাইল ফোনের সেট হাতে নিয়ে তাকিয়ে দেখে। অন করে যখন সে বলে-হ, কও, তখন ওর চেহারায় বিরক্তির ভাব।
ও ইসুব, কী রে, কাম করছস সারা দিন? কাম কেমুন হইলো? মালিকে কেমুন রে বাজান?
মালিকে মালিকের মতো, মালিক যেমুন হয়, মালিকগো মুখের মইধ্যে থাকে স্যাভেন ও কোলক বেলেড। কথায় কথায় কুত্তার মতো ঘেউ ঘেউ করে, মনে হয় আমরা মানুষ না!
ক্যান রে বাপ, অ্যামুন কইরা কইতাছস ক্যান? মালিকটা ভালো না? কিচ্ছু কইছে?
নাহ, খুউব ভালোওও…চাইনিজ খাইতে দিছে…তুই ও যা, আছস কই, মালিকে ভালো হইব, মিঠা মিঠা কথা কইব, জামাই আদর কইরা খাওয়াইব…তর কি মাথামুথার ঠিক আছে? মাইনষের থাকে একটা মালিক, আর আমার একটা না, আমার হইলো দুইটা মালিক, তাও দুইডাই হইলো বেডি। একটার মাথা মনে হইতাছে কদ্দুর খারাপ খারাপ, আর একটা মনে হইতাছে খবিস খবিস। খবিসটা এর মইধ্যে চাইরবার ফোন দিছে, কই আছস, সাবধানে চালাইস, এসি বন্ধ কইরা দে, ইসটাট বন্ধ কইরা দে…কী বুঝলি?
থাক বাজান, মালিক হইলো মালিক, হ্যাগো দয়ায় ব্যাতন পাইবি, থাক, হ্যাগো লগে বেয়াদপি করিস না য্যান, মাইন্নো কইরা কাম করিস, কত ট্যাকাপয়সা খরচা কইরা লাইসেন বাইর করলি, আল্লায় যদি এখন মুখ তুইলা চায়, তাইলে তো দ্যানাদুনা দিয়া কদ্দুর শান্তি করতে পারি! সব সময় মনে রাখিস, আমরা হইলাম গরিব মানুষ। আমগোরে বুইঝাশুইনা চলতে হইব। মালিকগো মাইন্নো করতে হইব।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, বুইঝাশুইনা চলতাছি।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার এই পর্যায়ে আরেকটা ফোনের সংকেত বাজে। আইচ্ছা মা, তুই এখন রাখ, কাইল আবার কথা কমুনে বলেই সে দ্বিতীয় ফোনটি রিসিভ করে। হ, হাসি বল, এখন কী করস? কাম শ্যাষ?
আরে না, কাম শ্যাষ হইব? ইসুব, আমি এই কাম ছাইড়া দিমু ভাবতাছি, বাসাবাড়ির কাম করতে আর ভালো লাগে না।
বাসাবাড়ির কাম ভালো না লাগলে রাজরানির কাম কই পাইবি?
আমি ভাবতাছি গারমেন্টে কাম করুম। তুই রাগ করবি না তো আমি গারমেন্টে কাম নিলে?
আরে সেইটা আরো ভালো কথা, আমি রাগ করুম ক্যান, তর যেইখানে মন চায় সেইখানে কাম করবি, আমার রাগের কী কাম?
বাহ্ রে, আমি তরে না জিগাইয়া কি কিছু করুম নাকি, আমি তোরে অনেক মাইন্নো করি ইসুব।
মাইন্নো করনের কাম নাই, খালি ভালোবাসলেই হইব। শুন, কাম যদি ছাড়োস তাইলে কিন্তু ব্যাতনের টাকা সব না নিয়া কাম ছাড়িস না। দ্যাশে মায়ের শরীল আর নাইলে বাপের শরীল খারাপ কইয়া ব্যাতনের টাকাগুলা নিয়া তারপরে কাম ছাড়িস। ব্যাগম সাহেবগুলা তো সব সারাক্ষণ ধান্দায় থাকে, ক্যামনে তগো ব্যাতন মারব।
না, না, আমার খালা আম্মা খুব ভালো মানুষ, ব্যাতন মারনের ধান্দা নাই; কিন্তু এই বাসায় হইলো কাম আর কাম, সারা দিন-রাইত কাম, সকাল থেইকা রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত খালি পাকের ঘরের মইধ্যে থাকতে থাকতে আমার শরীল ঝলসাইয়া গ্যাছে। আমার এইটা ভালো লাগে না। গারমেন্টে কাম করলে কাম শ্যাষের পর তো কদ্দুর আরাম কইরা বেড়াইতে পারুম, ঘুমাইতে পারুম। একদিন ছুটি পামু সাপ্তাহে, এইখানে তো সাত দিনই কাম করতে হয় সকাল থেইকা মাঝরাইত পর্যন্ত। দম ফালানির সময় নাই। সারা দিন টেলিভিশনে একটা নাটক দেখারও সময় দেয় না।
তর ব্যাতনের টাকা কি সবটা দ্যাশে পাঠাইয়া দ্যাস, নাকি কদ্দুর জমাসটমাস?
আবার জমানি, ক্যামনে, মাস শ্যাষ হওনের আগেই মায়ের ফোন, বাপের ফোন।
এইডা ঠিক করোস না, কয়ডা কইরা টাকা জমাইবি, নাইলে বিয়া-শাদি করবি ক্যামনে?
আমি কত ভাবছি কয়টা টাকা জমামু; কিন্তু ক্যামনে, দুই হাজার টাকা ব্যাতন, তাও যদি এক লগে দ্যায়।
এই পর্যন্ত কথা হয়। হাসির সঙ্গে পরিচয় নারায়ণগঞ্জে। সেইখান থেইকা ফোন করে হাসি। হাসি ফোন করলে নিজেকে ইসুব খুউব মূল্যবান মনে করে। এত্ত দূর থেইকা ছেড়িডা মনে করে নিশ্চয়ই তার যোগ্যতার কারণে। এই রকম ভাবনার ভেতরে আরেকটা ফোন আসার সংকেত বাজে। সোমা আক্তারের মোবাইল নম্বর দেখে সে দ্রুত হাসির সঙ্গে কথা শেষ করে দেয়। -জি ম্যাডাম,
তুই কোন পর্যন্ত গেছিস?
এই তো ম্যাডাম, আমি তো এখন কাওরান বাজারের কাছে।
আচ্ছা, ঠিক মতো যা, চেষ্টা করিস তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে, দিলরুবা আপা অপেক্ষা করছে।
জ্যাম থাকলে আমি কী করুম? রাস্তার মইধ্যে এমুন জ্যাম।
আচ্ছা ঠিক আছে, অন্য কোথাও আবার যাইস না, আপা বলল তোকে বলতে, তাই বললাম। যদি কোনো কারণে অন্য কোথাও যাস, তাই। সরাসরি আপার কাছে যা।
ধেৎ শালার, আমি তো পাগল হইয়া যামু, রাস্তা কি আমার বাপের নাকি! জ্যাম ঠেইলা তাড়াতাড়ি ক্যামনে যাই!
দ্যাখেন কী করল
সোমার ইন্দ্রিয় সচেতন হয়ে ওঠে এই গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। মনে হয়, ড্রাইভারের সঙ্গে সঙ্গে এখন এটা তারও চাকরি। রোজ রাতে দিলরুবা আহমেদ টেলিফোন করে বুঝিয়ে দেবে-দেখো, তুমি কিন্তু গাড়িতে উডি ঘুমাইয়ো না, আর নইলে ফোনে কথা কওনে ব্যস্ত থাইকো না, বিশেষ করি তুমি যখন খিলক্ষ্যাত বাজার রেলগেট পার হইবা তখন। এটা তো একটা মহা জ্বালা হবে তাহলে দিলু আপা, আমি তাহলে গাড়িতে বসে কোনো কাজই করতে পারব না। ঢাকা শহরে যেকোনো জায়গায় যেতে লাগে তিন ঘণ্টা। জ্যামে বসে সময়টা যেন নষ্ট না হয়, সেটা আরেকটা কারণ আমার গাড়ি ভাড়া করার। এখন আমাকে সারাক্ষণ গাড়ি পাহারা দিতে হবে?
কী করবা কও? তোমার তো সিনিয়ার ড্রাইভার রাখার টাকা নাই। জুনিয়ার ড্রাইভার দিয়া গাড়ির কাম চালানি আর কুত্তা দিয়া গু খাওয়ানি একই কথা।
এটা ঠিক না, আমি তো পুরো টাকা দিয়ে কম্পানির গাড়ি ভাড়া নিতে পারব। আপনি বরং একটা এক্সপার্ট ড্রাইভার দ্যাখেন।
না, দ্যাখো আগে হ্যায় ক্যামোন গাড়ি চালায়, সিনিয়ার ড্রাইভার গো আবার অনেক ঝামেলা আছে, সেগুলি আবার অনেক দেমাগ দ্যাখায়, কথা কওন যায় না, হুজুর হুজুর করতে হয়। থাউক, তুমি আপাতত এইটারে দিয়া দ্যাখো। তাতে কইরা আমাদের দুইজনারই টাকা সেভ হইল। তো তুমি এখন কোন দিকে যাইতাছ?
এই তো আমি আজকে যাব লালবাগ। এ সপ্তাহের সবটুকু কাজ করব লালবাগ, তারপর করব ধোলাইখাল।
খিলক্ষ্যাত রেলগেটটা পার হওনের লগে লগে যে মোড়টা, এই মোড়টা হইলো খুউব মারাত্মক জায়গা। এইখানে সরকার কিচ্ছু করে না। বাড়তি কয়ডা ট্রাফিক দেয় না। ওইখানে যখন-তখন মানুষ মরে, সেই দিন আমার চোখের সামনে একটা ট্রাফিকরে বাসে এমন করি ধাক্কা দিল যে, লগে লগে শ্যাষ। যেই দিকেই যাও গাড়িতে উঠার লগে লগে নজর রাখবা কাউরে ঘষা, গুঁতা দিল নাকি।
দিলু আপা, সেটা আমি অবশ্যই লক্ষ রাখব; কিন্তু কেউ যদি এসে ওর গাড়িতে ঘষা লাগায়ে দেয় তাইলে ও কী করবে বলেন? ঢাকা শহরে গাড়ির শরীর অক্ষত রাখা খুউব কঠিন ব্যাপার। দ্যাখেন না, গাড়িগুলার সামনে-পিছে কেমন করে স্টিলের ফ্রেম দিয়ে ঘের দেওয়া! আপনি সেইটা দেননি কেন দিলু আপা?
আরে গাড়ি রাখা আর হাতি পালা এক কথা, হাত ছোঁয়াইলেই হাজার টাকা। আমি তো মনে করো স্টেটাস ধইরা রাখনের জন্য গাড়ি রাখি। ভাঙা হউক চোরা হউক, নাম তো হয় গাড়ি আছে, বুঝো না? যদি গাড়িটা না থাকে তাইলে আত্মীয়স্বজনে জিগাইলে কইতে হইব রিকশায় আইছি, সিএনজিতে আইছি। খালি মানইজ্জত ধইরা রাখার জইন্নো মনে করো গাড়িটারে ঠেকা দিয়া রাখছি। এইটার আয়ু ফুরাইয়া গ্যাছে কবে, কোনো রকমে কাম চালাই। তুমি দুই মাস ভাড়া রাখলে সেই টাকা দিয়া গাড়িটারে আবার কদ্দুর ঠিক করালাম, বুঝো না?
খিলক্ষেত রোডের জ্যাম ঠেলে পিঁপড়ের মতো পিলপিলিয়ে সবে রেলগেটের সামনে এসেছে। ঠিক তখনই আটকে গেল। রেলগাড়ি আসার সময় এই রেলগেটের সামনে নানা রকমের মানুষ, গাড়ি, বাজার-এসবের এক অস্বাভাবিক জ্যাম ধরেছে। একেবারে মৌমাছির চাকের মতো। সেসব ঠেলে গাড়ির শরীর অক্ষত রাখতে অনেক সময় পাক্কা ড্রাইভারও পারে না। সোমা আক্তার অন্তত এই কয়েক দিনে এটা বুঝে গেছে।
গাড়ির পেছনের ছিটে বসে সোমা আক্তার খাঁচার পাখির মতো শুধু চঞ্চল দৃষ্টি ঘোরাতে থাকে। কোন দিক থেকে কোন গাড়ি আসছে, এই গাড়ির গা ঘেঁষে কোনটা দাঁড়াল, ইসুব ঠিকমতো সব দিকে নজর দিচ্ছে কি না!
একটা অটো এসে দাঁড়াল গাড়ির গা ঘেঁষে। বারবার পেছন থেকে ডাক দেয় সোমা আক্তার-ইসুব, সাবধানে চালা। এতভাবে যখন সোমা আক্তার উদগ্রীব হয়ে আছে, তখন অটোটা সরে গেল। এগিয়ে এলো একঝাঁক রিকশা, গাড়ির শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল একটা। পেছন থেকে সেটাকে ধাক্কা দিতেই কাত হয়ে একবারে গাড়ির শরীরে। দুটো রিকশার চাকা আটকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সোমা আক্তার চেঁচিয়ে ওঠে-আয় হায়, দিল, দিল, দিল ঘষা দিয়ে। ঘাড় কাত করে সেদিকে তাকিয়ে ইসুব চেঁচিয়ে ওঠে, অই খানকির পোলা, দ্যাহোস না, চোখের মাথা খাইছস? রিকশাঅলা নির্বিকার, সে ইসুবের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে পাশের রিকশার সঙ্গে আটকে যাওয়া চাকা ধরে তখন ঝাঁকাচ্ছে। যতই ঝাঁকিয়ে ডান পাশের চাকা খোলার চেষ্টা করছে, ততই এপাশের চাকা গাড়ির শরীরে যেন দেবে যাচ্ছে ঘসস শব্দ তুলে।
জ্যামে এমন ঠেসে আছে, গাড়ির দরজা খুলে নামতে চাইলেও ইসুব পারে না, শুধু গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে থাকে, অই খানকির পোলা, দিলি তো রে, আরে, অই, অই,। আরে রে…চোখে দ্যাখোস না? পেছন থেকে ক্রমাগত হর্ন বাজাচ্ছে আটকে পড়া গাড়ির ড্রাইভাররা।
ইসুব ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাস করে, ম্যাডাম, আপনে কন, এইটা কি আমার দোষ আছিল? এই যে গাড়িটাতে এত্ত বড় ঘষা লাগল, এইটা কার দোষে?
ওয়াজের টেপ
আর তিনি তখন কান্দিতে কান্দিতে কহিলেন, মাবুদ, তুমি আমার কন্যাসন্তানের প্রতি কেন মায়া বাড়াইলা? আমি তো কন্যাসন্তানকে জীবিত রাখিতে চাই নাই। আমাকে কেন কন্যাসন্তান হত্যা করিবার মতো একখানা পাথরসম হৃদয় দিলা না? আআআররর…মাবুদ (কান্না বিলাপ…) আমার কন্যাসন্তান তো আমারে-পিতাগো, আব্বাজান গো বলিয়া আমার হৃদয়ে ভালোবাসার নহর বহাইয়া দিয়াছে-আহারেএএ…কন্যাকে হত্যা করিয়া পিতা ছুটিলেন তোমাদের নবীজির কাছে, নালায়েক পাপী অধম কান্দিয়া পড়িল নবীজির পদতলে, সেই দিন নবীজি ফরমাইলেন, তোমরা আর নারীশিশু জন্মগ্রহণ করিলে হত্যা করিবে না, তাহাদিগকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়া লালনপালন করিবে…আহ্ হা…রে মাবুদ, হে গুনাহগার বান্দাগণ, বলুন ছোবহানাল্লাহ…এবার আমি এই মাহফিলে উপস্থিত নারীদের জ্ঞানের জন্য বলিতেছি, তোমরা কি এখনো বুঝিতে পারিতেছ না কোন মৃত্যুগহ্বর হইতে তোমাদের বাঁচিবার অধিকার প্রদান করা হইয়াছে? তোমাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা এবং তোমাদের নবী হুজুরের অশেষ রহমত করুণা ও আদেশ বর্ষিত হইয়াছে, তোমরা নারী হিসাবে পৃথিবীতে বাঁচিবার অধিকার পাইয়াছ শুধু স্বামীর সন্তুষ্টি বিধান আর সন্তান উৎপাদনের জন্য-আররর তোমাদের বেহেশত ধার্য করা হইয়াছে স্বামীর পদতলে…বলো গুনাহগার নারীরা সোবহানাল্লাহ আল্লা রহমানুর রাহিম…সোমা আক্তার কান পেতে শুনতে থাকে এই ওয়াজের প্রতিটা কথা, ওর কপালের মাঝখানে তখন দুটি চিকন ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওয়াজকারীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত এক আকর্ষণীয় ক্ষমতা আছে সন্দেহ নাই। জ্যামে আটকে সোমা আক্তার বেশির ভাগ সময় বই পড়ে, না হয় ফেসবুক খুলে নানা ধরনের নিউজ পড়ে অথবা চেনা-অচেনা বন্ধুদের ছবি দেখে, ফেসবুকের স্টেটাসে নিজের মন্তব্য লেখে।
ওয়াজের কথাগুলো কানে আসতে থাকে প্রথমে মৃদু মৃদু। প্রথম দিকে বাইরের শব্দের কারণে ওয়াজের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে না শুনলেও শেষের এই কথাগুলো কানে এলে সোমা আক্তার বই থেকে মুখ তুলে মনোযোগ স্থাপন করে। দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুরের সঙ্গে খুব সামান্য মিল আছে। সুর করে বলা কথায় মনোযোগ স্থাপন করলে সোমা আক্তারের কানে এবার কথাগুলো স্পষ্ট হয়। এবার সে গাড়ির বন্ধ জানালার বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখার প্রয়াস চালায়, কোথায় ওয়াজ হচ্ছে। গাড়ি থেমে আছে মহাখালী পার হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালের কাছাকাছি। আশপাশে কোথাও ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন নেই! রাস্তার একপাশের দীর্ঘ এলাকা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। অন্য পাশেও কোনো মসজিদ নাই, অথবা শামিয়ানা টাঙানো ওয়াজ মাহফিল।
এবার আরেকটু মনোযোগ দিতেই সোমা আক্তারের মনে হয়, গাড়ির ভেতরে ঠিক সম্মুখ থেকে আসছে এই শব্দ। সোমা আক্তার জিজ্ঞেস করে, কী রে ইসুব, ওয়াজের শব্দ আসছে কোথা থেকে?
আমার মোবাইল ফোন থিকা ম্যাডাম।
মানে, তোর মোবাইল ফোন থেকে কী করে আসছে?
আমি র্যাকর্ড কইরা নিছি, এইটা হইলো মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল হায়াতের ওয়াজ, বুঝলেন ম্যাডাম, না না, স্যরি, আপা, হ্যার ওয়াজ হইলো গিয়া খুব হাই কেলাস। হ্যারে সউদি আরবে পর্যন্ত হায়ার কইরা নিয়া যায় ওয়াজ শুননের জন্য। কথাগুলো বলা শেষ হওয়ার পরই সে জিজ্ঞেস করে, আপা শুনবেন, সাউন্ড একটু বাড়ায়া দিমু?
শোনা যায়, দে তো বাড়ায়ে, সোমা আক্তার শুনতে চায় কন্যাসন্তানদের নিয়ে কী বলছিল, তাই সে বলে-দে বাড়াইয়া, বাড়াইয়া দে, শুনি কী বলে?
আপা, এই ওয়াজ আমি বাইশজনকে কপি কইরা দিছি। শুনতে শুনতে আপনার চোকখে একদম পানি চইলা আসব, আহা মাইয়াদের কী খারাপ অবস্থা ছিল, বলতে বলতে সে মোবাইলের সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়। সোমা আক্তার মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে, কী বলে যাচ্ছে কন্যাসন্তানদের নিয়ে! আরবে অন্ধকার যুগের কাহিনী-কী করে নারীদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হলো, সেসব দিনের গল্প ওয়াজের সুরে ও কথায় বিষাদ বর্ণনা।
কান পেতে ম্যাডাম আপা ওয়াজ শুনছে, তার রেকর্ড করা-ইসুবের চেতনায় অহংকার বুদবুদ করে ওঠে। কাজটা তাইলে সে খুউব মূল্যবানই করেছে। ম্যাডাম আপার মতো শিক্ষিত, হাই ক্লাসের মহিলা তাঁর রেকর্ড করা ওয়াজ শুনছে। আজকে এই মুহূর্তে নিজেকে ম্যাডাম আপার সমপর্যায়ের মনে হয় অন্তত এই একটা দিক থেকে। একই সময়ে তার মনে হয় কাজটা খুউব ভালো হলো-এসব হাই ক্লাস চাকরি করা মহিলাগুলার জন্য খুব দরকার এই রকম ওয়াজ, বক্তৃতা। এইগুলা শোনানোর মইধ্যে অনেক ফায়দা আছে। মহিলাগুলারে এইগুলা ঠিকঠাক কিছুদিন শুনানি গেলে এগুলারে ঠিকমতো সাচ্চা মুসলমান বানানি যাইত। ক্যামোন কইরা কামিজ আর জিন্সের প্যান্ট পিন্দে বেশরমের মতো। কদ্দুর শরমও নাই। এই ওয়াজগুলা শুনাইতে পারলে আস্তে আস্তে বোরকা পিনত।
জ্যামে বসে থাকতে থাকতে তন্দ্রা চলে এসেছিল সোমা আক্তারের। কখন যে ওয়াজ শোনা থেকে সে ঘুমের রাজ্যে চলে গিয়েছে, নিজেই জানে না। কাল সারা রাত জেগে রিপোর্টের ফার্স্ট পার্ট তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু ইসুব মনে করে, এতক্ষণ ম্যাডাম আপা ওয়াজই শুনে যাচ্ছে। ওয়াজ শেষ হয়ে গেলে ইসুব জিজ্ঞেস করে-আপা, আপনে কইলে আমি আপনার ফোনেও রেকর্ড কইরা দিতে পারি।
ইসুবের কথায় তন্দ্রা ছুটে যায় সোমা আক্তারের, তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করে-কী, কিছু বললি ইসুব?
বলছিলাম আপনারে কি ওয়াজটা রেকর্ড কইরা দিমু? আপনি চাইলে দিতে পারি।
আরে না, না, আমার এসব ওয়াজের দরকার নাই। ম্যাডামের উত্তরে ইসুব খুউব হতাশ হয় এবং বিরক্ত হয়ে ওঠে এই বিরূপ মন্তব্যের ওপর। মনে মনে ভাবে, ইস্স্! এই ওয়াজটার সবটা যদি শোনানি যাইত, তাইলে একটা কামের কাম হইত, ছোয়াবও হইত অনেক আর এই মহিলাটারে নামাজি বানানি যাইত। রোজিনার মতো এই বেডিও খুব খারাপ হইয়া গ্যাছে, রোজিনার যেমন দাপট, এই মহিলারও তেমন দাপট। কী চটাং চটাং কথা বলে এই মহিলা।
নামাজ-রোজা তো মনে হয় জানেই না। এই দিক দিয়া খালাম্মা ম্যাডামটা খুব ধার্মিক। কী সুন্দর মসজিদে যায়, তারাবির নামাজটা পর্যন্ত মসজিদে পড়ে। রোজা আসছে পর্যন্ত একদিনও এই ম্যাডাম আপারে রোজা রাখতে দেখল না, নামাজও পড়তে দ্যাখে নাই এক দিনও। রোজিনাটারও সব কিছু ভালো; কিন্তু ওরে বিয়া করা যাইব না, নামাজ না পড়া ছেড়ি বিয়া করলে শ্যাষে সে নিজেও দোজখের আগুনে পুড়ব।
শ্যাম্পু, লোশন, পলিশ
খালাম্মা ম্যাডামকে টার্মিনাল ওয়ানে নামিয়ে দিয়ে ইসুব ফিরে আসে পার্কিংয়ে। গাড়ির ভেতরে অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়েছে। ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেতে হবে ভেতরে। টার্মিনালের ভেতরে গাড়ি রাখতে দেয় না। খালাম্মা, ম্যাডামের ছোট ছেলে, ছোট মেয়ে, মেয়ের জামাই তিনজন গাড়িতে অপেক্ষা করছে। আরেকটা গাড়ি আজ ধার করা হয়েছে খালাম্মা ম্যাডামের বড় বোনের কাছ থেকে। সেটাতে অপেক্ষায় আছে খালাম্মা ম্যাডামের স্বামী, স্বামীর ছোট ভাই এবং খালাম্মা ম্যাডামের বোন আর মা।
খালাম্মা ম্যাডামের বড় ছেলে আজ আমেরিকা থেকে আসবে। একই কথা বলেছে খালাম্মা ম্যাডাম গত কয়েক দিনে বোধ হয় হাজারবার-এরই ইসুব, আমার বড় পোলা আঁইয়ের, পাঁচ বছর পর, হ্যারে লই যে কদিন গাড়ি চালাইবি সাবধান। পোলা তো এখন আর দেশি নাই রে, বিদেশি হই গ্যাছে। ঢাকা শহরের জ্যামের অবস্থা দেখি ডরাইব।
দুই সপ্তাহ আগে থেকে খালাম্মা আজকের জন্য গাড়ি চেয়ে রেখেছিল, খালাম্মা ম্যাডামের বড় পোলা আসবে বলে। খালাম্মা ম্যাডামকে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ম্যাডাম আপা আজ সারা দিন কোথাও বের হয়নি। বাসায় বসে কাজ করবে। সকাল থেকে খালাম্মা ম্যাডামের অনেক কাজ বাইরে। মার্কেটে যাওয়া, বাজার করা। এসব ছাড়া ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা। দিনের অর্ধেক ইসুবকে দিয়ে খালাম্মা ম্যাডাম গাড়ি চালানির বদলে বাড়ি পরিষ্কার করানির কাজ করিয়েছে।
গত রাত থেকেই শুরু করেছে ঘরের কাজ করানো। এসব কাজ করার সময় থেকে ইসুবের মেজাজ খারাপ হয়েছে। এখনো সেই মেজাজ খারাপের জের চলছে। চুপচাপ সে ড্রাইভিং ছিটে বসে খালাম্মা ম্যাডামের মাইয়া, পোলা, মাইয়ার জামাইয়ের কথা শোনে। মাইয়ার জামাইটা তো শালীর লগে রীতিমতো ফাইজলামি করতাছে। মনে হয়, সুযোগমতো শরীরের এইখানে-সেইখানে হাতও দিতাছে। বেশ কয়েকবার ইসুব সামনের আয়নায় সেটা দেখার চেষ্টা করে। মাইয়াটাও কম যায় না। দুলাভাইয়ের লগে ফাইজলামি করতে ওস্তাদ। দুলাভাইয়ের হাতের আঙুলে মাইনষের ছবি আঁইকা ওড়না পিন্দাইয়া হাসতে হাসতে খালি দুলাভাইয়ের শরীরের ওপর গড়াইয়া পড়তাছে।
ইসুব ভাবে, কী ফাজিলের ফাজিল মাইয়ারে বাবা, এইটারে না আমার দরকার আছিল, ফাইজলামি কারে কয় শিখাইয়া দিতাম। খালাম্মা ম্যাডামের ছোট পোলা তার পাশের ছিটে বসে আছে। যতক্ষণ এই ছ্যামড়া গাড়িতে বইসা থাকে এক মনে গাড়ির সামনের যত সুইচ আছে সবগুলিরে টিপব। টিপা টিপা মনে হয় পরান ভরে না। কী খুঁজে এসবের মইধ্যে? তাও যদি জসিম ভাইয়ের মালিকের গাড়ির মতো গাড়ি হইত, তাইলে তো মনে হয় গাড়ির এই জায়গার মইধ্যে হান্দায়া যাইত।
ভাইয়া, ভাইয়া, আমার হাতটা দেখো না ভাইয়া, বলে এবার খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ে হাতের তালু মেলে দেয় তার দুলাভাইয়ের সামনে। ইসুব আরেকবার আয়নার ভেতর দিয়ে তাকানোর লোভ সামলাতে পারে না। খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ের বাঁ হাত নিজের হাতের ভেতরে তুলে নিয়ে রানের ওপর রাখে। টিপে টিপে দেখছে হাতের তালুর রেখা। ইসুব মনে মনে গালি দেয়-চুতমারানির লুইচ্চা, ইস্! হাত দ্যাখে, না হাত টিপে?
এই সময়ে খালাম্মা ম্যাডামের ছোট পোলার মোবাইলটা বেজে উঠলে ইসুব নড়েচড়ে বসে। যা, যা, যা, তাড়াতাড়ি যা।
খালাম্মা ম্যাডামের ছেলেকে নিয়ে যখন এয়ারপোর্ট থেকে রওনা হলো, তখন প্রায় রাত সাড়ে ৮টা। রাস্তায় তখন প্রতিদিনের নিয়মে জ্যাম। পার্কিংয়ে গাড়ি থামিয়ে ইসুব যখন লাগেজ নামায়, তখন ইসুবের দিকে উৎসুক দৃষ্টি আবদ্ধ করে সে বলে-পাপ্পু, এইটা কি নতুন আমদানি?
হঅঅ, এই তো দুই সপ্তাহ হইছে জয়েন করেছে।
ইজ হি আ সেফ ড্রাইভার? লাইসেন্স দেখে নিয়েছ?
চলে, ভাইয়া, ডেঞ্জারাস না, তখন খালাম্মা ম্যাডামের বিদেশ ফেরত ছেলে ইসুবের পিঠ চাপড়ে বলে-হ্যালো ইসুব, কেয়ারফুলি ড্রাইভ করবা, আমি তোমার গাড়ির জন্য শ্যাম্পু, লোশন আর পলিশ নিয়ে এসেছি। তোমাকে আর গামছা দিয়ে রেগুলার সাবান দিয়ে ঘষতে হবে না।
খালাম্মা ম্যাডাম উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। হাচা নি? গাড়ির লাই শ্যাম্পু? লোশন? এ্যারই, তুই গাড়ির লাই শ্যাম্পু আইনছস? আমার লাই আইনছস নি আগে কঅ। লোশনের কথা কইছিলাম, ভুলোছ নাই তো?
আম্মা, আম্মা, আপনার জন্য তো আনছিই, গাড়ির জন্য আনলাম এই জন্য, আপনারা গাড়ি কিনেই মনে করেন গাড়ি কেনা শেষ, এর কাজও শেষ। ব্যস, আসলে গাড়ি কিনলে গাড়ির মেইনটেনেন্সও করতে হয়, বাংলাদেশের মানুষরা গাড়ি ওয়াশ করার ব্যাপারটা কেয়ারই করে না।
এইটা হাচা কথা কইছ বাবা, আমরা তো আসলে জানিই না গাড়ির লাই যে শ্যাম্পু, লোশন, পলিশ-এই সব আছে। লাগেজ নামিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল ইসুব। ইসুবের ঠোঁটের কোণে তখন চাপা হাসি। ইসুবের দিকে আরেকবার দৃষ্টি ফিরিয়ে খালাম্মার বড় ছেলে বলে-কাল সকালে ফার্স্ট থিং, তুমি শ্যাম্পু দিয়ে গাড়ি ওয়াশ করে পলিশ করবে। আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব কোনটা শ্যাম্পু, কোনটা লোশন আর কখন পলিশ দিতে হবে।
গাড়ি পরিচর্যা
আজ সকালে গাড়ি নিতে এলে ইসুবকে অপেক্ষা করতে বলে আলো। ইসুব দরজার ওপর প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করার পর একটা প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ হাতে বের হয়ে আসে খালাম্মা ম্যাডামের দুই ছেলে। একজন আমেরিকা ফেরত ছেলে, আরেকজন দেশের থাইকা বিদেশিদের মতো ডুপ্লিকেট হাবেভাবে। তাদের দুজনের সঙ্গে ইসুব এলিভেটরে ওঠে একসঙ্গে। খালাম্মা ম্যাডামের বড় ছেলে কথায় কথায় ইংরেজি বলে। ইসুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমেরিকা ফেরত মানুষের দিকে। এলিভেটর এসে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থামলে ইসুব ওদের দুজনার সঙ্গে বের হয়ে আসে। গাড়ির বডি পানি দিয়ে হালকা ভিজিয়ে কী করে শ্যাম্পু করতে হবে, কী করে শ্যাম্পুর পর লোশন এবং লোশনের পর পলিশ দিতে হবে-পড়ে পড়ে ডিরেকশন দেয় বিদেশ ফেরত বড় ছেলে, ছোট ছেলে পাপ্পু সেই ডিরেকশন মতো ইসুবকে অর্ডার করতে থাকে।
গাড়িটার শরীরে অনেক স্ক্র্যাচ, এত ড্যামেজ কেন রে পাপ্পু?
আর বোলো না ভাইয়া, আম্মা এই গাধাটারে রাখার পর গাড়িটার বডি ফিনিশ, আর কিচ্ছু নাই। রোজ দুই-দুই চাইরটা দাগ লাগানই ওর কাজ।
আসলে এইটা ওর দোষ না, গাড়ির লাইফ একদম শেষ, এখনো যে এইটা সার্ভিস দিচ্ছে, সেটাই বেশি। মাই গড! বাংলাদেশ বলে এই রকম গাড়িগুলো চালাইতে পারে। বিদেশে তো এগুলিরে স্ক্র্যাপ করে ফেলে।
এইটারে আবার ফিঙ্ করতে পাঠাইতে হবে।
এইটারে ফিঙ্ করার কিচ্ছু নাই, এইটারে এখন ফিঙ্ না ফাইনাল করতে হবে। আম্মুকে আমি বলব। আম্মু এইটা বিক্রি করে দিলে যা পায় সেই টাকার সঙ্গে যা লাগবে তা দিয়ে একটা নতুন গাড়ি কেনা যাইতে পারে।
শ্যাম্পু করার পর পরিষ্কার টাওয়েল দিয়ে মুছে ড্রাই করে তারপর লোশন লাগাতে হবে, আসলে এটাকে লোশন বলে না, এটা হলো ট্রিটমেন্ট, কন্ডিশনার, বাংলাদেশের এই নবিশ ড্রাইভারটা বুঝবে না বলে আমি লোশন বলছি, কারণ লোশনের মতো দেখতে। এরা তো এখন লোশন পর্যন্ত চিনে মাত্র।
গাড়ির সমস্ত বডিতে কন্ডিশনার দিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। কন্ডিশনার যখন একটু ড্রাই হবে, সেটা আরেকটা ফ্রেশ মাইক্রো ফাইবার টাওয়েল দিয়ে মুছে ফেলতে হবে। দেন পলিশ লাগাতে হবে লেটেক্স গ্লভস ইউজ করে। ইসুবের হাতটাতে এবার একটা রবারের গ্লভস লাগাতে হয়। এইটা হইলো স্পেশালি মেড ফর পলিশ। বুঝলি ইসুব! এইটা হইলো লেটেক্স গ্লভস। এইটা ছাড়া খালি হাতে কখনো পলিশ লাগাইস না। তাহলে তোর হাতের মধ্যে লেগে যাবে অর্ধেক পলিশ। তরা তো আবার হাত দিয়ে ভাত খাস, এসব কেমিক্যাল হেলথের জন্য ভালো না, টঙ্কি-বুঝলি?
ঘণ্টাখানেক পর উপদা হয়ে আয়নায় মুখ দেখার মতো গাড়ির বডির ওপর উপদা হয়ে খালাম্মা ম্যাডামের বড় ছেলে বলে-দ্যাখ ইসুব, এইভাবে যখন তোর মুখটা গাড়ির বডিতে দেখতে পাবি তখন বুঝবি পলিশটা ঠিকমতো হয়েছে। কি, মনে থাকবে?
ইসুব ওর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথা দোলায়, দোলাতে দোলাতে বলে-হ, থাকব, আর মনে মনে গালি দেয়, চুতমারানির পোলা পলিশ শিখায়, আমারে ভাঙা গাড়ি পলিশ করন শিখায়! আর বাঁচলাম না!
আচ্ছা, তাই নাকি?
আজ বিকেলের আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল ম্যাডাম আপা। ম্যাডাম আপাকে অনুরোধ করেছে বড় খালাম্মা ছেলে বিদেশ থেকে আসার পূর্বে-ছেলে মাত্র দুই সপ্তাহ থাকবে। এই দুই সপ্তাহ যেন গাড়িটা বেশি ব্যবহার করতে দেয়।
ভাইয়া, তুমি নেক্সট ইয়ারে আম্মুকে একটা গাড়ি কিনে দাও, এই গাড়িতে করে গ্লোরিয়া জিন্সে গেলে আমাদের ইজ্জত ফিনিশ, সবাই ওখানে কী রকম দামি দামি গাড়ি নিয়ে যায়, গেলে দেখবা। ওখানে তো ভাইয়া ঢুকলে তোমার মনে হবে তুমি আমেরিকাতেই আছ।
রিয়েলি?
হ্যাঁ, ভাইয়া, বাংলাদেশ এখন অনেক ডেভেলপ করেছে। গুলশান-বনানীতে যত কফিশপ আছে সব তো বিদেশিগুলার ফ্রেঞ্চাইজ। আর ওগুলাতে কোনো কিচ্ছু তো দেশের নাই, সব কিচ্ছু বাইরের। ন্যাপকিন থেকে স্পুন পর্যন্ত সব বাইরে থেকে ইমপোর্ট করা। আর ওখানে যারা আসে, তাদের ড্রেসআপ যদি দেখো, ওরা তো সবাই রিচ ফ্যামিলির ছেলেমেয়ে। বাংলাদেশে বর্ন হলেও আসলে ওরা তো বিদেশের মতোই বড় হয়, ওদের লাইফস্টাইল তো একদম বিদেশের মতো। ওরা কেউ বাংলা ঠিকমতো বলতে পারে না, পড়তে তো পারেই না; কারণ ওরা সবাই পড়ালেখাও করে ইংলিশ মিডিয়ামে।
ঠিক আছে, আমরা তাইলে এই গাড়ি ভেতরে নেব না। আমেরিকাতে এ রকম গাড়িগুলাকে বলে শিটবক্স। এই কথা শুনে খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
এসব কথার সঙ্গে যখন হাসাহাসি চলে, ইসুব তখন কান পেতে শুনতে থাকে। নামটা যেন কী! বেশ কয়েকবার নামটা মনে রাখার চেষ্টা করে; কিন্তু পারে না। শেষের শব্দটা ওর মনে থাকে। কারণ ওর একটা নীল রঙের জিন্সের প্যান্ট আছে। কিন্তু প্রথম শব্দটা সে একবারও উচ্চারণ করতে পারে না।
এই ইসুব! তুই গাড়িটা ডান পাশ্র্বে রাখ। ইসুব গাড়ি ডান পাশ্র্বে রাখে। খালাম্মা ম্যাডামের ছেলেমেয়েরা গ্লোরিয়া জিন্সের ভেতরে প্রবেশ করে। গ্লোরিয়া জিন্সের সামনে রাস্তার ওপরে গাড়ির সার। ইসুব রাস্তার ওপর সারিবদ্ধ গাড়িগুলোকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে। এসব গাড়ির পাশে এই প্রো বক্স গাড়িটাকে ফকিন্নির পুতের মতো মনে হয়।
সে তখন দামি গাড়ির ডেরাইভারদের দিকে লক্ষ করে। দামি গাড়ির ডেরাইভারদের সবার হাবভাব আলাদা, দামি দামি। হ্যারা গাড়ির ছিটে বসে টান টান হইয়া, গাড়ির সামনে খাড়ায় বাহাদুরের মতো। হ্যাগো কয়েকটার পরনের কাপড়চোপড়ও হ্যার থেইকা দামি। একজন ডেরাইভারের হাতে সুন্দর ঘড়ি, আঙুলে সোনার আংটি। ইসুব ইচ্ছা করে সেই ডেরাইভারের পাশে গিয়ে সালাম দেয়। ভাইজান, আপনের হাতের ঘড়িটা খুব সুন্দর। দূর থেইকা চোক্ষে নজরে আসে, কয়টা বাজে, আপনে খুব দামি গাড়ি চালান ভাইজান-এভাবে সে দামি গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা চালায়।
আমি আর কইয়েন না, আমি একটা ফকিন্নির পুতের মতো গাড়ি চালাই, সবে তো মাত্র লাইসেন্স পাইছি, আমার ওস্তাদ ভাইয়ে আমারে কইছে পুরানধুরান চালাইয়া হাত পাকাইতে। ইসুব খুব খাতির দিয়ে, সম্মান দেখিয়ে কথা বলার কারণে দামি গাড়ির ড্রাইভার হয়তো অহংকারী হয়ে ওঠে। নিজেকেও গাড়ির মতো দামি মনে করে। গোল্ডলিফ সিগারেটের ভরা প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে লাইটার দিয়ে ধরায়। সে হয়তো এটাও দেখাতে চায়, রাস্তার পাশে সস্তা চায়ের দোকানে বান্ধা দড়ির আগুন দিয়ে সে সিগারেট ধরায় না। সে লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরানোর ক্ষমতা রাখে। দামি গাড়ির ড্রাইভার সিগারেটে টান দিয়ে নাকের ভেতর দিয়ে কয়েক দলা, এবং ঠোঁটের গোলা দিয়ে বৃত্তাকারে ধোঁয়া ছেড়ে নিজের পারদর্শিতা প্রকাশ করে। ইসুব তার এই দক্ষতা দেখে ভক্তিভরে হাসে। তখন দামি গাড়ির ড্রাইভার ইসুবকে আস্ত একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলে-ল, কই থাকোস?
আমি থাকি ত্যাজগাঁও, আমার বড় ভাইয়ের লগে, আমার ভাইয়ে আপনার মতো দামি গাড়ি চালায়, সেইটার নাম পাডো।
দূর ভোদাই, তুই দেখি নামও কইতে পারোস না, পাডো না, প্রাডো, এই যে আমারটা দ্যাখতাছস, এইটার নাম ল্যাকছাছ। আমার বসের বাপে চালায় বিএমডাব্লিউ। হ্যাগো এই রকম দামি গাড়ি আছে দশটা। বাড়ির হগলের দুইটা কইরা গাড়ি। ইসুব মনে মনে আহত হয়। তার কপালে কবে একটা বড়লোক মালিক জুটবে, এই রকম ফকিন্নির পুত গাড়ি তাকে কত দিন চালাতে হবে। সিগারেটে টান দেয় আর বিষণ্ন মুখে সে ধোঁয়া ছাড়ে।
কথার মাঝখানে ইসুবের ফোন বেজে ওঠে। খালাম্মা ম্যাডামের বড় ছেলে ফোনসেট ফেলে গেছে। পেছনের ছিটে। এক্ষুনি দিয়ে আসতে হবে। দামি গাড়ির ডেরাইভারের সঙ্গে কথা আর আগায় না। ধেৎ শালা, আইচ্ছা, আমি আসতাছি ভাইজান, বলে সে গাড়ির পেছনের ছিট থেকে সেল ফোনের সেট খুঁজে বের করে।
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে। এইটা হইলো আই ফোন! খালাম্মা ম্যাডামের বিদেশ ফেরত ছেলে কইল, আই ফোন সিঙ্টা ফেইলা আসছি। ইসুব উল্টিয়েপাল্টিয়ে দ্যাখে, অনেক সুন্দর ফোন। ইসুবের একটা নকিয়া। ছোট্ট, বারো শ টাকা দিয়ে কিনেছে। এইটা কিনতেই তার অনেক কষ্ট গেল।
ইসুব গ্লোরিয়া জিন্সের ভেতরে প্রবেশ করার সময় গেটের বাইরে দারোয়ান ওকে ডাক দেয়-এই, কই যাস?
স্যারের সেল ফোন দিয়া আইতে। দে, আমার কাছে দে, আমি দিয়া আসতাছি, ইসুবের চেহারা ক্রুদ্ধ হয়, ক্যান, আমারে দিয়া আসতে কইল; এত্ত দামি ফোন আমি আপনের হাতে দেই ক্যান? আমারে নি কুত্তায় কামড়াইছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ইসুব গ্লোরিয়া জিন্সের ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরে প্রবেশ করে সে থতমত, ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তার মনে হয়, সে এক ধন্ধের মধ্যে পড়ে গেল। কোনদিকে যাবে? এত্ত পোলাপান এইটার ভেতরে। সব তো খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ের মতো ড্রেস পিন্দা। হইচই, চিল্লাচিল্লির জন্য কান ঝালাপালা। ইংরাজি গানে ফাটাফাটি অবস্থা। ইসুব দাঁড়িয়ে থাকে হতভম্বের মতো। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকায় সামনের দিকে।
এই সময় সেল ফোন বেজে ওঠে-কই রে তুই?
আমি ভিতরে ভাইজান।
আস, সোজা এসে ডান দিকে চলে আস। আমরা বসে আছি একেবারে মাঝখানের টেবিলে। আয় চলে আয়। ইসুব বোকার মতো এগোতে থাকে। দ্বিধা-সংকোচের টক্কর লাগে ওর পায়ে পায়ে। টেবিলের ওপরে নজর আটকায়, কফির কাপে চুমুক দেয় পোলাপানেরা, তার বয়সী অনেক পোলাপান। দূর থেকে হাত তুলে খালাম্মা ম্যাডামের ছোট মেয়ে ডাক দেয়-ইসুব, এই…এই যে…এদিকে…কাম হিয়ার। সে টেবিল লক্ষ করে এগোয়। খালাম্মা ম্যাডামের ছোট মেয়েকে দেখে ইসুব এবার আগের চাইতে দ্রুত এগিয়ে যায় টেবিলের কাছে। মোবাইল সেট এগিয়ে দেওয়ার সময় সে দ্রুত দেখে নেওয়ার প্রয়াস চালায়, কী আছে তাদের টেবিলের সামনে। টেবিলের ওপর অনেকগুলা কাগজের গেলাস। খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ে-ছেলে সবার সামনে ড্রিংকস-কফি ফ্রুট জুস, আইসক্রিম-এসব কাপের ওপর দিয়ে ওর দৃষ্টি ঘুরে আসে কয়েকবার। ইসুব যে গতিতে এসেছিল এই টেবিলের সামনে, সেই গতির বিপরীত হয়ে যায়। শ্লথ হয়ে যায় মোবাইল ফোনসেট এগিয়ে দেওয়ার পর তার ফিরে আসা।
ক্ষণিকের জন্য সে দাঁড়িয়ে যায় এই টেবিলের সামনে, যেখানে বসে আছে খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ে ও ছেলেরা। অবাক বিস্ময়ে যেন নতুন এক পৃথিবী প্রত্যক্ষ করে ইসুব। ওর দৃষ্টি দ্রুত ঘুরে বেড়ায় এই সুযোগে সব কিছু দেখে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছায়। খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ের ডাকে সে সচেতন হয়ে ওঠে-ওম্মা, তুই দেখি দাঁড়ায়ে গেলি! যা, তাড়াতাড়ি চলে যা, গাড়ির কাছে চলে যা। দূরে কোথাও যাইস না গাড়ি ছেড়ে, কাছেই থাকিস, গুলশান-বনানীতে কিন্তু অনেক চোর-বদমাইশের আড্ডা, মনে করিস না গুলশান বলেই যে খুব ভালো জায়গা, এখানে চোর-বদমাইশ আরো বেশি।
যেমন দ্বিধা-সংকোচ জড়ানো পায়ে গ্লোরিয়া জিন্সে প্রবেশ করেছিল, ঠিক তেমনই সংকোচ জড়ানো পায়ে সে বের হয়ে আসে আই ফোন সিক্স বিদেশি ভাইজানের হাতে পৌঁছে দিয়ে।
ম্যাডাম আপার গোপন বিষয়
যখনই ম্যাডাম আপা কারো সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে, ইসুব কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শোনে। গাড়ি চালানির এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে ইসুবের। বড় লোকগো ভেতরে কত সমস্যা, কত কামড়াকামড়ি-সব কিছু শোনা যায়। সামনে বসে কানটা খাড়া না করলেও কানের ভেতরে আপনাআপনিই ঢুকে পড়ে তাদের কিচ্ছাকাহিনী। খালাম্মা ম্যাডাম আর ম্যাডাম আপার কত কথা এই দেড় মাসেই জানা হয়ে গ্যাছে। একেবারে কাছের আপন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবও এত কিছু জানতে পারে না, ইসুব যা জানছে।
কত কথা জানতে পারে ইসুব। খালাম্মার কাছে ফোন আসে বেশির ভাগই তাবিজ-কবচ নেওনের। খালাম্মা কতজনেরে তাবিজ আইনা দেয়। সবারই এক সমস্যা-স্বামীরে ক্যামনে ঘরে রাখে, স্বামীর লুইচ্চামি ক্যামনে বন্ধ করব, ক্যামনে স্বামীর মন গলাই। সন্ধ্যার পর বেশির ভাগই খালাম্মা যায় মসজিদের হুজুরের কাছে চিনি, কাপড় পড়া-এইসব আনতে।
ভালোই কামায় এই সব কামে নিশ্চয়ই। হুজুরের খরচা বইলা যা নেয়, নিশ্চয়ই অর্ধেক হ্যার পকেটে! কথাবার্তা শুনে বোঝা যায় কে কার সঙ্গে কথা বলে, কী কথা বলে।
অনেকক্ষণ যাবৎ ম্যাডাম আপা কথা বলে মোবাইলে- মাঝে মাঝে কিছু কথা ইংরাজিতে বলে। যেই সব কথা সে ইসুবরে শোনাইতে চায় না, সেই সব কথা ম্যাডাম আপা ইংরাজিতেই বলে। ইসুব শুধু দুই-একটা শব্দ বোঝে, ইয়েস, ইয়েস, নো, নো, গুড গুড-এইগুলা তো খুব সহজ বোঝা ও বলা; কিন্তু ম্যাডাম আপা যে রেলগাড়ির মতো ছাড়ে, তখন আর কিছুই বোঝে না।
কী কথা কয় ম্যাডাম আপা ইংরাজিতে?
মাঝে মাঝে ম্যাডাম আপার মোবাইল সেটের বাইরে দিয়া কথা শোনা যায়। কখনো বেডির গলা, কখনো ব্যাডার গলা।
আজও তেমন, সেটের বাইরে দিয়ে অন্য পারে যে মানুষটা, তার গলার স্বর শুনতে পায়। ম্যাডাম আপারে বলতাছে-
আমি তোমাকে বলছি চলো চলে যাই, আমরা কানাডা অথবা অস্ট্রেলিয়া চলে যাই, না, তুমি দেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না, তাহলে কী করে হবে?
না হলে না হবে, আমি তো বলেছি, আই ডোন্ট বিলিভ ইন দিস ইনস্টিটিউশন। বিয়ে নামের যে ইনস্টিটিউশনটা আছে, সেটা ভেঙে যাবে। এই ইনস্টিটিউশনটা অলরেডি ভাঙা শুরু হয়েছে ওয়ার্ল্ডের উন্নত দেশে। আমাদের দেশেও এটার ভাঙনটা শুরু হবে। আই টোলড ইউ, আমি এই ইনস্টিটিউটটাতে বিশ্বাসী না, আমি আর বিয়ে করব না।
কী সব কথাবার্তা। অর্ধেক কথা বোঝে, আর বাকি অর্ধেক ইংরাজিতে ঠাসা। সব কথা এর জন্য ধরতে পারে না ইসুব, শুধু একটা কথা ধরতে পারে, আমি আর বিয়ে করব না, তার মানে-ম্যাডাম আপার আগে একটা বিয়া হইছিল। কী হইছে সেই বিয়াটা? কেমন আছিল তাঁর স্বামীডা? ভালো না লুইচ্চা? ছাড়ল ক্যান? একা একা থাকে ক্যান? ম্যাডাম আপারে নিয়ে এত ভাবনা তার, সেইটা কি ম্যাডাম আপা জানে?
একদিন গাড়ি নিয়ে
কিভাবে কথাটা ম্যাডাম আপাকে বলবে ইসুব, এই ভাবনায় ডুবে থাকে। ম্যাডাম আপাকে সত্য কথা বললে কাম হবে না। সত্য কথায় ভাত নাই, সেদিন জসিম যখন অভিনয় করে কানল, কী সুন্দর মালিকের কাছ থেইকা দুই দিনের জায়গায় তিন দিনের ছুটি মিলল, আবার মালিক অফিস থেইকা মায়ের জানাজার খরচার টাকাও দিল।
যতগুলি মাইয়ার সঙ্গে কথা হয়, তার মইধ্যে সব থেইকা বেশি পয়সা জমাইছে রোজিনা। রোজিনা অনেক চালাক মাইয়া। ব্যাতনের টাকা থেইকা অর্ধেক টাকা জমায়। কথাবার্তায় খুব চালাক। এইডার ভবিষ্যৎ ভালো, বহুত বুদ্ধি রাখে। টাকা জমাইয়া দুইটা মেশিন কিনা একটা টেইলারিংয়ের দোকান দিব। তার মানে হ্যার কাছে অনেক টাকা জমছে। ছেড়ির প্ল্যানের কথা শুনলে নিজেরে ওর কাছে ভোদাই ভোদাই লাগে।
পেরেম করলে এই রকম একটার লগেই করতে হয়। বয়সে কদ্দুর বড় হইব, তা হউক, এক্কেবারে ছেমড়ি হইলে টাকা পাইব কই? টাকা জমাইতে যত দিন লাগে তত দিনে কি আর ছেমড়ি থাকে? রোজিনার কথা ভাবতে ভাবতে সে একা একা হাসে। ছেমড়ি এত্ত চালাকের চালাক-সেদিন কয়, তুমি তো ডেরাইভার, তোমার হাতে তো মালিকের গাড়ি থাকে, একদিন গাড়ি নিয়া আসতে পারো না আমারে বেড়াইতে নিতে? তার মানে ছেমড়িও তার প্রেমে পড়ছে; কিন্তু সস্তা প্রেম করব না, গাড়িতে কইরা ঘুরাইতে হইব।
ক্যামনে আমি গাড়ি নিয়া আসি, তুমি বুঝো না, আমারে তো এক দিনও ছুটি দেয় না। সকাল থেইকা দুপুর পর্যন্ত ম্যাডাম আপার ডিউটি, আর সন্ধ্যা থেইকা রাইত পর্যন্ত খালাম্মা ম্যাডামের ডিউটি। তো কখন গাড়ি নিয়া বাইর হমু? আর খালাম্মা ম্যাডাম, গাড়ির মালিকে এত্ত চালাক, কয়টার সময় আমারে ম্যাডাম আপা ছাড়ল, সব খোঁজ নিতে থাকে।
আরেএএ…ঢাকা শহরে যেই জ্যাম, জ্যামের কথা কইয়া দিলেই হইল।
এইটা ঠিক কইছস, কই যাইতে চাস?
গ্যালে তো যাই ফ্যান্টাসি কিংডমে; কিন্তু এত দূরে যাইতে না পারলে শিশু পার্কে তো যাই!
আইচ্ছা ঠিক আছে, শিশু পার্কে যামুনে; কিন্তু ফ্যান্টাসি কিংডমে যাইতে পারুম না রে, অনেক সময় লাগব ওইটাতে যাইতে। একদম উল্টা পথে কিনা! শিশু পার্কটা তো মনে কর খালাম্মা ম্যাডামের বাড়ি যাইতে পড়ে। ইচ্ছা করে ইসুব ফ্যান্টাসি কিংডমে যেতে রাজি হয় না টিকিটের দাম শুনে।
কারণ সেদিন শুক্রবার খালাম্মা ম্যাডামের বিদেশ থেকে আসা ছেলে ছোট ভাই, বোন, বোনের জামাই-সবাইকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল ফ্যান্টাসি কিংডমে। সে-ই প্রথম ইসুবের ফ্যান্টাসি কিংডমে যাওয়া। কিন্তু সে বাইরেই অপেক্ষা করেছে গাড়ি নিয়ে। ভেতরটা কেমন জানা হয়নি। ভেতরে যেতে টিকিট লাগে, এইটা জানা হয়েছে তাদের কথায়। সেদিন যেতে-আসতে পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগেছে পথে জ্যামের কারণে।
শিশু পার্কে টিকিটের দাম কম। রোজিনাকে নিয়ে সে শিশু পার্কে যাবে-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
বৈশাখী মেলা
তিন বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠটা ত্রিকোনা। খেলার মাঠ, মেলার মাঠ যে এমন তিন কোনাইচ্চা হয় সেইটা ইসুব কোনো দিন দেখে নাই। ইসুব যে গ্রামে বেড়ে উঠেছে, সেখানে এমন তিন কোনাইচ্চা মাঠ নাই। সেইখানে কত বড় বড় মাঠ। সেই মাঠে হাডুডু খেলতে কী মজা। এই তিন কোনাইচ্চা মাঠে পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। দুপুর থেকে শুরু হয়েছে গানবাজনা, প্রথমে হাউজিং সোসাইটির শিল্পীদের নাচ-গান।
খানিক পর পর বিরতি দিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে, আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের প্রাণের শিল্পী মমতাজ, আমাদের সকলের প্রিয় মমতাজ।
ম্যাডাম আপা এই রকম হইচই আর জ্যামের ভেতরে বের হবে না, সেটা ইসুব খুউব ভালো করেই জানে। সে গাড়ির দরজা খুলে নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দিতে পারত। কিন্তু ঘুমের চাইতে ভালো লাগে গাড়িতে বসে গান শুনতে। গান শুনতে শুনতে সবে দুই চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে, এই সময় পকেটের ভেতরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…বেজে উঠলে সোজা হয়ে বসে ইসুব। শালীর শালী, আর সময় পাইল না, ইস্! কী আরামের ঘুমটা আইছিল-বিড়বিড়িয়ে বলতে বলতে সে মোবাইল অন করে বলে-জি আপা, কঅন।
ওপরে আস তো ইউসুফ, ওপরে আস-বলে ম্যাডাম আপা লাইনটা ডিসকানেক্ট করে দিলে ইসুব সমস্ত রাগক্ষোভ মেটায় নকিয়া মোবাইল সেটের ওপর। প্রয়োজনের চাইতে বেশি চাপ দেয় মোবাইল ফোনের লাল রঙের অফ বাটনে। গাড়িটা খোলা জায়গা দেখে পার্ক করে দরজা খুলে ঘুমাচ্ছিল। সেখান থেকে ঘুম জড়ানো চোখে চৌদ্দ নম্বর পার্কিংয়ে নিয়ে আসে। চৌদ্দ নম্বর ফ্ল্যাটের মালিক থাকে বিদেশে। সেই কারণে এইটাতে দিনের বেলা পার্ক করতে দেয়। চৌদ্দ নম্বরে পার্ক করে হাই তুলতে তুলতে এলিভেটর নিয়ে ওপরে আসে। দরজায় বেল দিতে হয় না। ম্যাডাম আপা ওকে ফোন দিয়ে ডাকার পর মাঝে মাঝে এভাবে ড্রইংরুমের দরজা খুলে রাখে।
ইসুবকে দেখে সোমা আক্তার বলে-ইসুব সাহেব, আমাদের মেরুনা বেগমের যে একটু নিচে যাওয়ার শখ করছে। গানাবাজনা দেখতে যাইতে চায়। তুমি ওকে একটু নিয়ে যাও। দেইখো, আবার ওকে একা ছেড়ে দিয়ো না। হারায়ে যাবে কিন্তু! কিচ্ছু চেনে না। মনে থাকবে?
জি আপা, জি, ঠিক আছে, আমি অরে পাহারা দিয়া রাখমু, সঙ্গে করে নিয়া যামু, আর অনুষ্ঠান শেষ হইলে নিয়া আসমু। বিনয়ের সঙ্গে কথা বললেও ভেতরে ভেতরে সে আনন্দে নেচে ওঠে। দরজার সামনে কাঁচুমাচু ভাব নিয়ে মেরুনার জন্য অপেক্ষা করলেও মনে মনে বলে-ম্যাডাম আপায় কী কয় রে! ইশশশ্! মেরুনারে নিয়ে যাইতে হবে গানবাজনার ওইখানে। এইটার মতো আনন্দের কথা আর কিছু হইতে পারে পহেলা বৈশাখের এই দিনে। আইজকা লাল পাঞ্জাবি পরাটা একদম গেছিল ফ্লপ হইয়া। এক্ষণে আমার পাঞ্জাবির ইজ্জত বাঁচল।
পহেলা বৈশাখের সকালবেলা উঠে সে টিনের বাক্স থেকে লাল পাঞ্জাবিটা বের করে। গত বছর এই পাঞ্জাবিটা সে উপহার পেয়েছিল রোজিনার কাছ থেকে। বেতনের টাকার অর্ধেক দিয়ে কিনে দিয়েছিল এই পাঞ্জাবি। মেরুনাকে লাল রঙের সুন্দর সালোয়ার-কামিজ কিনে দিয়েছে ম্যাডাম আপা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ম্যাডাম আপা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয় ইসুবকে-ইসুব, সাবধান, মেরুনাকে রেখে এক মিনিটের জন্য কোথাও দূরে যাইস না, ও কিন্তু একেবারে নতুন। এই এলাকার কিছু চেনে না। ইসুবকে সাবধান করে দেওয়া হলে মেরুনার উদ্দেশে বলে-মেরুনা, খুব সাবধান, একদম ইসুবের সঙ্গে সঙ্গে থাকবি, আর মনে আছে তো, আমি কত তলায় থাকি? মেরুনা মিটমিটিয়ে হেসে বলে-হ, আছে আমরা বারোতলায় থাকি, তিন নম্বরে।
মোবাইল নিয়েছিস?
হ, নিছি যে।
আর ঠিকানা লেখা কাগজটা?
জি, সেইটাও নিছি।
হাতের মুঠায় রাখিস, দেখিস হারিয়ে ফেলিস না, আর বাই চান্স ধর তুই ইসুবকে হারিয়ে ফেললি, নিচে এসে রিসিপশনে দাঁড়িয়ে আমাকে কল করতে বলিস। আমি নিচে এসে এগিয়ে নেব, মনে থাকবে তো?
এত কথা একনাগাড়ে বলে যাওয়ার পর ইসুব বলে-একটা কথা কমু?
হ্যাঁ, বল, আমার লগেই যখন দিতাছেন এত চিন্তা করতাছেন ক্যান? আমি কি এতই বেকুব কন? আমার কি আক্কল এতই কম যে আমি এর মতো গাধারে ছাইড়া দূরে যামু?
গাধা বলার সঙ্গে সঙ্গে মেরুনার চোখেমুখে অভিমান ফুটে ওঠে। কোনো কথা না বলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে গাল বাঁকায়। মনে মনে বলে, ইস্! নিজে কত চালাক! ব্যাটারি ডাউন কইরা ঘুমায়, আবার আমারে কয় গাধা।
এলিভেটরের সুইচ টিপে কোমরে হাত দিয়ে মেরুনার মুখোমুখি দাঁড়ায় ইসুব। মেরুনার চোখে চোখ রেখে টিটকারির সুরে বলে-ওই মেরুনা বেগম, তুই আমারে খোঁচা মারলি ক্যান?
আমি আগে মারছি না আপনে আমারে আগে মারলেন?
আমি তোরে খোঁচা মারলাম কই?
ইস্, ভুল হইয়া গেল? গাধা কন নাই আমারে?
আরে আমি কখন গাধা কইলাম তরে?
তর আপুটা কিন্তু একটা বোকা মাইয়া মানুষ।
হ, আপনারে কইছে? আপনার থেইকা চালাক আছে, তা না হইলে আপু এত বড় চাকরি করত না, আর আপনে যদি আপুর থেইকা বেশি বুদ্ধিমান হইতেন, তাইলে আপনে আপুর চাকরি করতেন না।
ওই, তর আপু আর আমি কি এক সমান? হ্যায় বয়সে আমার কত বড় হইব জানোস?
তো আপনার বয়স কত? আপনে হ্যার কত ছোট?
যা ছেড়ি, একটা আস্তা ভোদাই, আমি হইলাম কি না সবে জোয়ান হইতাছি।
তাইলে আপনে এখনো পুরাপুরি জোয়ান হন নাই-হি হি হি!
যা ছেমড়ি, ফাইজলামি করিস না। শুন মেরুনা, তুই আমারে একটা মিস কল দে, আমি তর নম্বরটা সেভ করি, আর তারপর তুই আমার নম্বরটা সেভ কইরা ল। যদি ভিড়ের মইধ্যে আমারে হারাইয়া ফেলোস তাইলে লগে লগে ফোন দিস।
মেরুনার সঙ্গে ছোট ছোট দুষ্টুমি করে আর ভাবে, এই ছেমড়িটার সঙ্গে প্রেম করতে পারলে মন্দ হইত না, এরে বিয়া করতে পারলেও ভাইগগোটা খুলে, কারণ এইটারে ম্যাডাম আপা খুব মায়া করে। জমিজিরাত দিয়া বিয়া দিব, সেদিন কইতে আছিল।
এইটা ঠিক হয় নাই
হ্যালো সোমা, কী করো?
তেমন কিছু না, এই তো একটা রিপোর্ট তৈরি করছিলাম। কালকে জমা দিতে হবে।
কী খাইলা?
কয়েক রকমের তরিতরকারি, মাছ-এই সব।
মেরুনার পাক কি ঠিক হইছে?
এই চলে যাচ্ছে যা করে, ওকে দিয়ে তো আর আমি মোগলাই বাবুর্চিদের মতো রান্না আশা করতে পারি না!
কই, দাও দেখি একটু কথা কই, অনেকবার হ্যার ফোনে ফোন দিলাম, ধরে না।
নিচে বৈশাখীর অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেখানে গেছে, হৈ-হাঙ্গামার ভেতরে বোধ হয় শুনতে পাচ্ছে না।
আয় হায়, কার লগে গেল? একা পাঠাইছ?
না, না, একা পাঠাইনি, ইসুবকে দিয়েছি ওর সঙ্গে।
আহ হা রে, সর্বনাশ, বদমাইশটার সঙ্গে কেমনে দিলা মাইয়াটারে? তোমারে এত কইরা নিষেধ করলাম। দেখো সোমা, তোমারে মেয়েটা দেওয়ার সময় এতবার কইরা কইলাম যে মেয়েটারে কোথাও একা পাঠাইয়ো না, আর তুমি কিনা ওরে ড্রাইভারটার সঙ্গে বৈশাখী মেলার অনুষ্ঠানে পাঠাইলা?
আপনি এত ছোট্ট একটা ব্যাপারকে এত্ত বড় করে দেখছেন। কাজের মেয়ে বলে কি ওর কোনো লাইফ নাই, বলেন তো? মেয়েটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মন খারাপ করে, ড্রাইভার ছেলেটা নিচে বসে আছে, আমি তাই ওকে একটু মেরুনার সঙ্গে যেতে বললাম, এতে দোষের কী? ঘণ্টাখানেক অনুষ্ঠান দেখে চলে আসবে, আমার খুব জরুরি কাজ, আমি যেতে পারব না, তাই ইসুবকে মেরুনার সঙ্গে যেতে বললাম।
এইসব ড্রাইভারট্রাইভারের নজর সব সময় বাড়ির কামের মেয়েগুলার ওপর থাকে, তুমি জানো না? তুমি কি লন্ডন থেইকা আইছ, নাকি আমেরিকা থেইকা আইছ যে এইসব জানো না!
কেন, জানব না কেন; তবে আপনি যা ভাবছেন সেটা না। ছেলেটা ওকে একটু দেখে রাখবে, যাবে আর আসবে, সব মিলিয়ে এই ঘণ্টাখানেক থাকবে।
হ, আইজ তো সুযোগ কইরা দিলা, এরপর কাইল থেইকা শুরু করব মেরুনার সঙ্গে প্রেম করা।
দূর! আপনি শুধু শুধু সব কিছু বাড়িয়ে সন্দেহ করেন। এতটুকু টুকু ছোট্ট দুইটা ছেলেমেয়ে কী প্রেম করবে? আর যে ভয়াবহ পাহারার ভেতরে থাকে! হিহিহি…। হাসালেন দিলু আপা, ইসুব তো আমি না ডাকলে ওপরে আসার অনুমতি নেই, আর মেরুনা, আমি তো বের হওয়ার সময় ওকে তালা দিয়ে রেখে যাই, প্রেমটা করবে কী করে শুনি?
শোনো, এগুলি গরিবের ঘরের পোলাপান, আমাদের পোলাপানদের থেইকা অনেক আগে পাকে, বুঝলা, ছ্যাড়াটার ঠোঁটের দিকে দ্যাখছ?
না, দেখিনি। কেন, কী হয়েছে ওর ঠোঁটে?
ক্যামন কালার কালা, মনে হয় সারা দিন বিড়ি-সিগারেট খায়!
আমি তো তাহলে বিড়ি-সিগারেটের গন্ধ পেতাম, তা ছাড়া বিড়ি খেলে সেটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার, বিড়ি খেলেই কি একটা ছেলে খারাপ হয়ে যায়? আপা মনটাকে একটু উদার করেন, একটু উদার, ওদের একটু ছাড় দিতে শেখেন, তা না হলে এত নামাজ-রোজা কোনো কাজে লাগবে না।
আরে তুমি যে আছ কোন জগতে! আমার সঙ্গে কয়টা দিন তুমি একটু থাইকা যাইয়ো, তাইলে তুমি সব কিছু আমার মতো দেখতে পাইবা। যাক গা, তুমি এক কাম করো, ইসুবরে ফোন দিয়া কও মেরুনারে নিয়া এখনই ফিরা আইতে। বেশি রাইত কইরো না, গাড়িটা একা একা নিয়া আসে তো, আমি তাই টেনশনে থাকি।
মমতাজ মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তালির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। শুধু তালি নয়, তালির সঙ্গে ঘন ঘন শিস, চিৎকার, হইচই-সব কিছু একাকার হয়ে ভিন্ন এক পরিবেশ সৃষ্টি হলো। মেরুনার গা ঘেঁষে দাঁড়ায় ইসুব ভিড়ের ভেতরে। পেছন থেকে ভিড়ের ধাক্কা এলে সে মেরুনার হাত চেপে ধরে, কানের কাছে মুখ এনে বলে, এই ভিড়ের মইধ্যে তো দাঁড়ানিরও জায়গা নাই, বাইর হ, চল ওই পাশে ভিড়টা হালকা, আমরা ওই দিকে যাই। মেরুনা ইসুবের কথামতো ভিড় ঠেলে বাম পার্শ্বে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছে, এ সময় ইসুবের মোবাইলে বেজে ওঠে-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। পকেটে হাত দিয়ে সে মোবাইল বের করে নম্বর দেখে ঠোঁট উল্টে মোবাইল ফোনটা পুনরায় পকেটে রেখে দেয়।
সার্জেন্টের হাতে ধরা
বসুন্ধরা শপিং সেন্টারের উল্টো দিকে ফার্নিচারের দোকানের সামনে গাড়ি থামায় সোমা। গাড়ি থেকে নামার আগে বলে-ইসুব! আমি একটা পড়ার টেবিল আর একটা বুকশেলফ কিনব। তুই এক কাজ কর, এইখানে তো পার্কিং নাই, তুই সামনের দিকে গাড়ি নিয়ে যা, সোজা গিয়ে বাঁয়ে গেলে হলো গ্রিন রোড। গ্রিন রোডে রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করতে পারবি। যদি তা-ও না পারস, তাহলে আরো একটু আগায়ে যাইস। দেখবি গ্রিন রোড স্টাফ কোয়ার্টার। সেখানেও রাস্তার পাশে অপেক্ষা করতে পারবি। এই ভাবে গাড়ি কোথায় নিরাপদে পার্ক করতে পারবে, সেই সম্পর্কে ধারণা দিয়ে সোমা আক্তার গাড়ি থেকে নেমে যায়।
সোমা গাড়ি থেকে নেমে গেলে ইসুবের গালের কোনায় সেই হাসিটা আবার স্পষ্ট হয়। সোমা যেখানে নেমেছিল, সেখানেই সে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে সিটের পেছনটা পেছনে নামিয়ে চিত হয়। সে গ্রিন রোডের দিকে যায় না। খিলক্ষেত থেকে পান্থপথ পর্যন্ত আসতে আড়াই ঘণ্টা লেগেছে। সেই বেলা ৩টার সময় বের হয়েছে, আর এখন বিকেল সাড়ে ৫টা। পেছনে চিত হয়ে বলে-কাম নাই, আমি এখন পার্কিং খুঁইজা বেড়ামু! ঠ্যাকা পড়ছে, পারুম না। ঘাড় ঘুরিয়ে সে চারপাশটা দেখে চিত হয়ে ডায়াল করে-ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই খিক করে হেসে বলে-কী রে মেরুনা, কী করস?
ওপাশ থেকে মেরুনা উত্তর দেয়, টিভি দেখি।
তোর কপালটা শালার অনেক ভালো, আমার কপালে তো আর টিভিটুভি নাই, সারা দিন গাড়ি চালাই।
ক্যান, আপনের বাসায় টেলিভিশন নাই?
টেলিভিশন? শুন ছেমড়ির কথা, সারা দিন গাড়ি চালামু না টেলিভিশন দেখুম! আর বাঁচলাম না, আসলে কি জানোস, বাসাবাড়িতে কাম করলে এই একটা সুবিধা, টেলিভিশন দেখা যায়, আরাম কইরা ঘুমানি যায়।
তো আপনে টাকাপয়সা জমাইয়া আস্তে আস্তে সব করেন, ডেরাইভারি কাম ছাইড়া অন্য কাম করেন। তাইলে তো টেলিভিশন দেখতে পারবেন।
সেইটা তো করুমই, ঢাকা শহরে মাত্র আইলাম। হইব, সবই হইব। তারপর, তর বিয়া কবে?
জানি না, মায়ে তো পোলা খুঁজতাছে শুনছি। ভালো পোলা পাইলেই দিয়া দিব। সোমা আপারে কইছে আমার ব্যাতনের টাকাগুলো জমাইতে, এক লগে আমার বিয়ার সময় দিতে।
তো তুই আমারে বিয়া করবি?
আপনারে? আপনেরে তো লাগে পোলাপান, সোমা আপা তো নানু আপার সঙ্গে কইতেছিল তখন শুনলাম, আপনে নাকি বয়স বাড়াইয়া লাইসেন বাইর করছেন?
হ, তো হইছে কী? বয়স না বাড়াইলে কি আর লাইসেন্স বাইর করতে পারতাম?
আমি তরে বিয়া করলে আমারে করবি নাকি সেইটা কঅ। তুই তো আমারে বিয়া করবি, আমার লাইসেন্সের লগে তো আর বিয়া বইবি না।
ধেৎ! যান, আমারে কইয়া লাভ নাই, আমারে যদি পছন্দ হয় তাইলে আপুরে কন, তারা যেইটা কইব সেইটা হইব।
এভাবে যখন ইসুব একেবারেই কথায় মগ্ন মেরুনার সঙ্গে, তখন হঠাৎ গাড়ির ওপরে টাস টাস বেশ কয়েকটা শব্দ। পরক্ষণেই একেবারে গাড়ির শরীর ঘেঁষে দরজার পাশে ট্রাফিক পুলিশ। লাফিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে মাথা নত করে দাঁড়ায়।
এই হারামজাদা, বাপের বাড়ি পাইছস নাকি? এইখানে পার্ক করা নিষেধ জানস?
জি, জি না, আমি বেশিক্ষণ হয় নাই স্যার, এই মাত্র ম্যাডামে নামছে।
চোপ, হারামজাদা বদমাইশ, মিথ্যা কথা কইলে এখনই থানায় পাঠাইয়া দিমু। দেখি, তর কাগজ বাইর কর।
স্যার, আমি আপনের পায়ে ধরি স্যার, ম্যাডামে…স্যার এই মাত্র নামছে।
তো নামাইয়া দিয়া বইয়া থাকলি ক্যান? বেশি কথা কইস না, কাগজ বাইর কর।
স্যার…বলে সে ট্রাফিক পুলিশের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। লম্বা-চওড়া, ট্রাফিক পুলিশের পোশাক পরিহিত লম্বা চওড়া মানুষটার পাশে ইসুবকে একেবারে একটা বালকের মতো দেখায়। সে ফিসফিসিয়ে বলে-স্যার, আমার কাছে এক শ টাকা আছে, দেই আপনারে? আমারে ছাইড়া দ্যান, আমি এখনই এইখান থেইকা যামু গা।
না, কোনো কথা নাই, এই সব চলব না, কাগজ বাইর কর। তোর ম্যাডামরে কইস কোর্টে গিয়া যা করনের করতে।
বেশ কয়েকবার অনুনয়-বিনয়ে কাজ না হলে ইসুব এবার প্রস্তাব করে-স্যার, পাঁচ শ টাকা দিলে সারব? ট্রাফিক পুলিশ এবার মুচকি হাসে। ইসুব তখন ট্রাফিক পুলিশকে বলে-স্যার, আপনে আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দ্যান। আমি যামু আর আমু। এবার সে পাল্টা অনুরোধ করে ট্রাফিক পুলিশকে গাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য। এবং টাকা নিয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত তাকে সময় দিতে। দ্রুত সে ম্যাডাম আপার নম্বর ডায়াল করে ছুটতে থাকে, যেদিকে ম্যাডাম আপা নেমে হেঁটেছিল। দুবার ডায়ালের সময় সে সোমাকে পায়। অস্থির কণ্ঠে সে জানতে চায়, সোমা কোথায়?
কেন, কী হয়েছে? সোমা জানতে চাইলে ইসুব অস্থির কণ্ঠে বলে-আপনে কোথায় আপা, আমারে আপনার কাছে আসতে হইব।
কেন, আমার কাছে আসতে হবে কেন? কী হয়েছে?
সার্জেনে ধরছে, গাড়ির কাগজপত্র চায়, গাড়িতে কোনো কাগজপত্র নাই, কথা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল আর যুগপৎভাবে সোমাকে খুঁজছিল। মডার্ন ফার্নিচারের ভেতরে দাঁড়িয়ে সোমা তখন দামদরের কথা বলছিল দোকানের সেলসম্যানের সঙ্গে।
সোমার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায় ইসুব।
সোমা অবাক হয়ে জানতে চায়, কী হয়েছে? সার্জেন্ট কেন তোকে ধরেছে? গাড়ি কোথায় রেখেছিস?
মাথা নিচু করে তোতলায় ইসুব-আমি ভাবলাম কই আবার যামু, আমি তো রাস্তাটাস্তা তেমন চিনি না, কী যে কইলেন গিরিন রোড ইসটাট কুয়ার আমি যদি হেইটা খুঁইজা না পাই তাই আমি রাস্তার ওপরেই স্টার্ট বন্ধ কইরা বইয়া ছিলাম।
এখন কী হয়েছে সেই কথা বল?
গাড়ির কাগজপত্র নাই, গাড়ির নামে মামলা কইরা দিবো, আমি সার্জেনরে খাড়া করাইয়া রাইখা আসছি। পাঁচ শ টাকা দিলে ছাড়াইয়া নিতে পারুম। আপনে যদি পাঁচ শটা টাকা দিতেন তো কেস করা থেইকা ঠ্যাকাইতে পারি। আর না হইলে কেস দিবো গাড়ির নামে।
কই, চল দেখি পাঁচ শ টাকা ঘুষ কাকে দিতে হবে! হঠাৎ এ সময় সোমার মনে পড়ে দিলরুবা আহমেদের কথা। ইসুবকে লক্ষ্য করে সোমা বলে-দাঁড়া আমি দিলু আপাকে ফোন দিই, কী করা যাবে শুনি। হাতেই ধরা ছিল মোবাইল ফোন। এই মাত্র ইসুবের সঙ্গে কথা বলেছে। তাড়াহুড়া করে সে দিলরুবা আহমেদের নম্বরে বাটন টেপে। এক রিং হতেই পাশ থেকে দিলরুবা আহমেদের হ্যালো বলার শব্দ।
হ্যালো আপা, এই যে একটা সমস্যা হয়েছে, গাড়ি আটক করেছে ট্রাফিক পুলিশে। এখন পাঁচ শ টাকা ঘুষ দিলে মামলা দেবে না, ইসুব বলছে, আমি এখন কী করব? আমি কি টাকাটা দিয়ে দেব, নাকি বলব গাড়ির নামে মামলা দিতে, কোর্টে গিয়ে ফয়সালা করবেন?
না, না, অনেক ঝামেলা মামলাটামলা নিয়া, তুমি পাঁচ শ টাকা দিয়া দাও, মাস শ্যাষে এইটা ইসুবের বেতন থেইকা কাইটা রাখুম, হারামজাদা কেন গাড়ি ওইখানে রাখল?
আপা আপনের ভাগ্নে না জানি ভাতিজা কে যেন আছে পুলিশের অফিসার, তাকে ফোন দেবেন?
আরে না, মাথা খারাপ? এই রকম টুডাফাডা ছোটখাটো কামের জন্য ওকে বললে আর মানইজ্জত থাকব না। মাত্র পাঁচ শ টাকায় যে মামলা খতম করা যায়, সেইটার জন্য আবার ভাইগনাকে ফোন দিমু! ইস্! কথায় কয় না, মশা মারতে কামান দাগা। যাক, তুমি পাঁচ শ টাকা দিয়া ঝামেলা মিটাইয়া ফ্যালো। তার পরে আমি ওরে দেখুম নে।
আমি কিন্তু ওকে বলেছিলাম, গাড়িটা চালিয়ে গ্রিন রোডের পাশে অথবা স্টাফ কোয়ার্টারের ভেতরে কোথাও রেখে অপেক্ষা করতে; কিন্তু আমার কথা না শুনে চালাকি করে এখানেই রাস্তার পাশে বসেছিল।
গাড়ির শরীর
দিলরুবা বেগম ঘুরে ঘুরে দেখে। গাড়িকে কেন্দ্র করে যেন সে আবর্তিত হয়, তুই কতগুলা ঘষা খাওয়াইছস গাড়িটারে দ্যাখ।
খালাম্মা, আমি ঘষা খাওয়াই নাই, এই ঘষাগুলি আগেই আছিল গাড়ির গায়ে।
চোপ, বদমাইশ, শয়তান, আমার সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করবি না, তুই জানোস আমি তোর চাকরির বারোটা বাজাইয়া দিতে পারি? একখান মাত্র… একখান মাত্র ফোন দিমু, জনমের মতো ড্রাইভারি করা বাইর হইয়া যাইব, দুই নম্বরি লাইসেন্স নিয়া আর রাস্তায় নামতে হইব না।
আমার লাইসেন্স দুই নম্বরি না খালাম্মা।
এই বদমাইশ, আবার তর্ক করোস? আমি জানি না তর লাইসেন্স এক নম্বরি না দুই নম্বরি? তরে কত দিন কইলাম ছবি, আইডি কার্ড সব কিছুর ফটোকপি দিয়া যাবি।
আইডি কার্ড আনতে আমারে তো গেরামের বাড়ি যাইতে হইব।
ক্যান, সঙ্গে নিয়া ঢাকা শহরে আসোছ নাই ক্যান? বদমাইশির জাগা পাস না, না? ঢাকা শহরে ড্রাইভারি করতে আসতাছস আর আইডি কার্ড আনতে ভুইলা গ্যাছস? রাখ তরে কী কইরা সোজা করতে হয় আমারও সেইটা জানা আছে।
আপনে কইলে আমি কাইলকা গেরামের বাড়ি যাই, আইডি কার্ডটা নিয়া আসি?
না, আমি ক্যান সেইটা কমু, তুই যাইয়া তর ম্যাডামের কাছে জিগা গিয়া,
তরে কতবার কইছি আমারে খালাম্মা ডাকবি না। কতবার কইলাম আইজ তন আমারে ম্যাডাম ডাকবি!
না, আপনে হিজাব বান্দেন, মুখটা তো খালাম্মা, খালাম্মা লাগে, তাই মুখ দিয়া ম্যাডাম আইতে চায় না।
ওহ, হিজাব ছাড়া মাইয়া মানুষ দেখতে খুউব ভালো লাগে, তাই না, এর লাই ম্যাডাম ডাইকতে বলি ভালা লাগে, বদমাইশ, যা হুতা কাট।
আজ বিকেলেই বাড়ি ফিরে আসে সোমা। বাড়ি ফিরে আর যদি বাইরে কোনো কাজ না থাকে, তাহলে সোমা গাড়ি পাঠিয়ে দেয় দিলু আপার বাড়িতে। যেমনতেমন একটা গাড়ি মাস করা ভাড়া নিতে গেলে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা। সেখানে মাত্র বিশ হাজার টাকায় গাড়িটা দেওয়ার সময়ই সোমা আক্তার কথা দিয়েছে, বিকেলে কাজ শেষ হয়ে গেলে সে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে দিলু আপার বাড়িতে। ফলে দিলু আপা তার প্রয়োজনীয় কাজ বিকেলে অথবা রাতে করে নেবে। সোমা যখন একটা গাড়ি ভাড়ার কথা বলছিল, তখন এই রকমই সিদ্ধান্ত হয়-শোনো সোমা, তুমি আমার গাড়িটা ব্যবহার করো। দিনের বেলা তুমি ব্যবহার করলা, আর বিকেলে, সন্ধ্যার পর আমি ব্যবহার করলাম। যেই দিন বিকেলে বা রাতে লাগে সেই দিনও ব্যবহার করলা। সব দিন তো আর তোমার বিকেলে অথবা রাইতরে লাগব না, যেই দিন বিকেলে অথবা রাইতরে তোমার না লাগে সেই দিন তুমি একটু বেলাবেলি পাঠাইয়া দিলা, আমি টুকটাক কাম সারলাম। গাড়ি তো আমি ব্যবহার করি মনে করো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া-এই সব কামে। বুঝো না, বড় লোক আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আইজকাল রিকশায় গেলে আর স্টেটাস থাকে না।
দিনের বেলা
আরে না, না, তোমার দুলাভাইয়ের তো অফিস নাই। রিটায়ার মানুষ-সকালে হাঁটতে যাওয়া, দুই-তিনবার মসজিদে যাওয়া ছাড়া আর তো কোথাও যায় না। মুন্নি তান্নি ওরা কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যায় রিকশা করে। সেইভাবেই তো বাসা ভাড়া নিয়েছি যেন ওদের জন্য গাড়ির দরকার না হয়।
তাহলে গাড়ি? গাড়ি কী করেন?
ওই যে বললাম, এই আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়িতে যাওয়ার সময় ব্যবহার করি। তোমার দুলাভাই রিটায়ার করার পর এখন তো ইনকাম কমে গেছে, ড্রাইভারের বেতন টানি কেমন করে?
বেঁচে দিলেই পারেন, যখন ড্রাইভারের বেতন টানা সম্ভব হয় না!
কিন্তু স্টেটাস! তোমার দুলাভাই না হয় রিটায়ার করছে, কিন্তু স্টেটাস, সেইটা তো আর রিটায়ার করে নাই। না নামছে ওপরে, না নামছে নিচে। সে রিটায়ার করছে বলি স্টেটাস তো আর নিচে নামাইতে পারি নাই।
ওমা! গাড়ি যদি গ্যারেজে পড়ে থাকল, তাহলে আর স্টেটাস রক্ষা হলো কী করে?
কী যে কও না, আমি তো মাঝে মাঝে ছুটা ড্রাইভার কল করি।
সেটা কী করে?
এই ধরো স্কুলগুলা, কম্পানির গুলা-এই রকম অনেক গুলাতে কাম করে এই রকম ড্রাইভারের নম্বর কালেক্ট কইরা রাখছি। কম্পানির ড্রাইভারগুলার তো শুক্র শনি ছুটি থাকে, স্কুলগুলার ছুটি থাকে। তখন সেগুলারে ডাক দিলে আসে, এই মনে করো ছুটা বুয়াদের মতো। আমারও কাম চলল, হ্যাগোরও এক্সট্রা ইনকাম হইল দুই দিনে।
ওরা কত নেয় তাহলে?
ওই যে দিন পাঁচ শ টাকা, দুপুরের খাওয়া খরচসহ।
ও বাব্বা, তাহলে অনেক বেশি হয়ে গেল না?
না, মোটেও না, হ্যারা তো কম্পানিগুলা থেইকা মাসে পনের-কুড়ি হাজার টাকা ব্যাতন পায়। পনের শ কইরা হইলে মাসে পাঁচ শ টাকা হইল না? আর ধরো আমি যদি আমার বাসা থেইকা বনানী যাওয়ার জন্য একটা সিএনজি ভাড়া করি, তাইলে আমার আপ-ডাউন ভাড়া খরচ হয় তিন শ থেইকা চাইর শ। আর আমি পাঁচ শ টাকা দিয়া সারা দিন গাড়িটা ব্যবহার করতে পারতাছি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে দাওয়াত, পার্টি-এগুলাও তো হয় ধরো শুক্র অথবা শনিবারে। আগে থেইকাই আমি অনেক কাম জমাইয়া রাখি। বাজারঘাট, রোগী দেখা, আত্মীয়স্বজন এক দিনে শেষ করি।
তুমি যদি গাড়ি কম্পানিগুলা থেইকা ভাড়াও নেও, তাইলেও তো তোমার ডিউটি করব সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। ছয়টার পর তো তোমাকে এমনিতেও গাড়ি ছাইড়া দিতে হইব, ছয়টার পর রাখলে আবার ওভারটাইম দিতে হইব।
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে সোমা। আপা, আপনার কি দারুণ বুদ্ধি। প্রধানমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অর্থমন্ত্রী বানিয়ে ভুল করেছে, ওনার উচিত ছিল আপনাকে অর্থমন্ত্রী বানানো।
সেইটাও পারতাম, খালি কয়েকটা ডিগ্রি নাই বইলা আমার কোনো পাত্তা নাই, কয়টা ডিগ্রি যদি থাকত, তাইলে দেখতা, আসলে তোমরা যারা অনেক পড়ালেখা করো, হ্যাগো মাথায় বুদ্ধি কইমা যায়। আমরা যারা অল্পবিদ্যা প্যাটে রাখি, আমগো বুদ্ধি বেশি হওয়ার কারণ আমগো বদহজম হয় না।
কম টাকায় গাড়িটা ব্যবহার করতে দেওয়ার উদ্দেশ্য এবার সোমার কাছে খোলসা হয়ে যায়।
আপা আপনাকে সত্যি আমার সালাম করতে ইচ্ছা করছে।
ওমা! ইচ্ছা করলে করবা, আমি তো আর বয়সে তোমার ছোট না।
হাতির ঝিল
নাম, নাইমা আস। আমি এখন ড্রাইভ করি, তুই পাশে বস।
খালাম্মা ম্যাডামের ছোট ছেলে পাপ্পুর কথামতো ইসুব নেমে আসে ড্রাইভিং সিট থেকে। এবং পাপ্পুর কথামতো ইসুব ড্রাইভিং সিটের পাশের ছিটে এসে বসে। পাপ্পু নিচের থেকে ফোন করে খালাম্মা ম্যাডামকে বলে-আম্মা আমি ইসুবকে নিয়া হাতির ঝিলে যাইতাছি। আমার কয়টা বন্ধু আসবে। আমরা হাতির ঝিলে বিকেলে একটু সময় কাটামু, রায়ান, পাবলো, আলিফ, জয়-ওরা সবাই বিকেলে হাতির ঝিলের পাশে বসে একটু সময় কাটাতে চায়।
খালাম্মা ম্যাডাম এত জোরে কথা বলে, মোবাইলের বাইরে থেকে শোনা যায়-পাপ্পু তুই আমারে না কইয়া নিচের থেইকা ইসুবরে নিয়া হাতির ঝিলে যে রওনা হইলি, আমারে কওয়ার দরকার মনে করলি না।
ক্যান আম্মা, তোমারে যে কইলাম, তুমি ভুইলা গেছ। তোমারে না কইলাম বিকেলে ইসুব আসলে আইজ আমি ইসুবরে নিয়া যামু। তোমার একটুও মনে নাই, এইটা একটা কথা হইলো? তোমার না আম্মা ভুলনেকা বিমারি হুয়া। যাও, এখন তোমার অনেক কইরা পান খাওয়া দরকার। আমি হাতির ঝিল থিকা ফিরা আইলে তুমি বড় খালার বাড়িতে যাও।
ক্যান, বড় খালার বাড়িতে কী?
বড় খালার বাড়িতে অনেক পান আছে, তুমি পান খাইয়া আসো, কারণ তুমি বুড়ি হইয়া গ্যাছ, কোনো কথা মনে রাখতে পারতাছ না।
দ্যাখ পাপ্পু! তুই কিন্তু আমার লগে ফাইজলামি করিছ না, চালাকি করি গাড়ি চালাইতে যাইস না কই দিলাম। আল্লার ওয়াস্তে আমার নিষেধটা হুনিস। আর রাইত করিস না, তুই আইলে আমি সত্যই বড় আপার বাড়ি যামু।
যদিও খালাম্মা ম্যাডাম নিষেধ করে পাপ্পুকে গাড়ি চালাতে; কিন্তু পাপ্পু সেই নিষেধে পাত্তা দেয় না। সে ইসুবকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালায়ে আসে হাতির ঝিল। ইসুব গাড়িতে বসে থাকে আর সে গাড়ি থেকে গিটার নামিয়ে নিয়ে ফ্লাই ওভারের পশ্চিম পাশ্র্বে এগিয়ে যায়। পাপ্পুরা মোট চারজন। নিরিবিলি দেখে গিটার নিয়ে বসে। ওরা গিটার বাজিয়ে গায়-আজ পাশা খেলব রে শ্যাম … শ্যাম তোমার সনে…।
ইসুব গাড়ি থামিয়ে রেখেছে রাস্তার ওপারে। দূর থেকে পাপ্পুদের আড্ডা দেওয়া দেখতে পায়। ওর খুব ভালো লাগে গিটার বাজানি দেখতে। খালাম্মা ম্যাডামের ছেলে পাপ্পুর ভাগ্য কত ভালো। রাজকপাল, কাজকামের চিন্তা নাই, যখন খুশি মন চাইলে গিটার নিয়া বাইর হয়। হাতির ঝিলে খালি কথা কইয়া আড্ডা না, গিটার নিয়া আড্ডা। শালার এইডারে কয় জীবন…খাও দাও ফুর্তি মারো…।
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। হাতির ঝিলের পানিতে ইলেকট্রিকের নীল আলো পড়ে খুব লাগছে। লেকটা কী সুন্দর ঝিলমিল করে। সন্ধ্যার সময় ঝিলের পানিতে বাতাস নাচছে। ঝিলের পানির ছোঁয়া নিয়ে আসা বাতাস এখানে কী সুন্দর ঠাণ্ডা। সারা ঢাকা শহর গরম; কিন্তু হাতির ঝিলের দুই পাড়ের বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। এইখানে এখন অনেক ছেলেমেয়ে আসে। ওদের দেখলে মনে হয় ওরা কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সবাই নিশ্চয়ই প্রেম করতে আসে। শুধু কচি বয়সের ছেলেমেয়েরা না, কত রকমের, কত বয়সের মানুষ আসে। ইসুব দূরে দাঁড়িয়ে আবছা দেখতে পায় পাপ্পু ভাইরে। কিন্তু তাদের কথা সব শুনতে পায় না। হঠাৎ ইসুব সচকিত হয়ে ওঠে। মনে হয়, পাপ্পু ভাইয়াদের সঙ্গে কয়েকটা ছেলের হাতাহাতি শুরু হইল। হাতাহাতি-মারামারি হইতে হইতে একজন পানির ভেতরে উল্টায়ে পড়ে। কাছেই কোথাও পাহারায় ছিল র্যাবের পুলিশ। এক গাড়ি ওখানে পৌঁছার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো দুই গাড়ি এসে পৌঁছে।
খালাম্মা ম্যাডামের ছেলে পাপ্পু এবং বাকি তিনজনকেও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ইসুব মোবাইল থেকে তাড়াতাড়ি খালাম্মা ম্যাডামকে ফোন করে। খালাম্মা ম্যাডাম মনে হয় একটা বিপদের আঁচ করেছিলেন। ইসুব ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থির কণ্ঠে জানতে চান কী হইছে? পাপ্পু ভাইদের সবাইরে পুলিশে ধইরা নিয়া গেল।
তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আস, তাড়াতাড়ি। খালাম্মা ম্যাডাম, খালুজান স্যার অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল গেটের কাছে। ইসুবকে দেখে দৌড়ে আসে। গাড়িতে উঠে বসে থানায় যেতে বলে। পথে খালাম্মা কয়েকটা টেলিফোন করে। খালাম্মা ম্যাডাম খবর পায়, পাপ্পু ভাইদের সবাইকে ধইরা শাহবাগ থানায় নিয়া আসছে। খালাম্মা ম্যাডাম মোবাইল ফোনে কথা কয়। আমার ছেলে তো গিটার বাজায়; কিন্তু না কোনো নেশা করে; না না, আমি মা, আমি জাইনতাম না তো কে জাইনব।
গাড়ির ভেতরে ঝগড়া লাগে খালাম্মা ম্যাডাম আর খালুজান স্যারের-তুমি, তুমি তোমার ছেলেকে নষ্ট করছ। তুমি হ্যারে গিটার কেনার টাকা দেও। আল্লাহ-খোদার নাম নেওয়ার কথা নাই, সারা দিন গিটার বাজায়। বোরকা পিন্দো না, খুলি ফ্যালো, যাও, পোলার লগে গিয়া নাচো গিয়া।
তুমি কিন্তু মুখ সামলাইয়া কথা কইয়ো, আমি কিন্তু তোমারে সাবধান করি দিলাম।
কী সাবধান কইরা, আমি কি তোমারে ডরাই নাকি?
এই, এই … এই ড্রাইভার, গাড়ি রাখ, আমি যামু না থানায়, তুমি যাও, তুমি তোমার পোলারে ছাড়াও গিয়া। আমার মান-ইজ্জত নিয়া খেলা শুরু করছে তোমার পোলা-মাইয়ারা…। উপায়হীন ইসুব গাড়ির গতি কমায়। আর তখনই গাড়ির দরজা খুলে নেমে যায় খালুজান স্যার।
খালুজান স্যারের নেমে যাওয়ার দিকে খালাম্মা ফিরে তাকায় না। যা, নামি যা, ব্যাটা বদমাইশ, খাচ্চোর, পোলা বিপদে পড়ছে, আর মেজাজ দেখায়, আমি হ্যার মেজাজের গুষ্টি মারি।
খালাম্মা ম্যাডাম কার সঙ্গে কথা বলে-আমার ছেলে, না না, মারামারি করে নাই, হ্যাঁ… হ্যাঁ… গিটার বাজায়। … কালচারাল। কালচারাল ছেলেরা গানবাজনা-এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ওদের সময় কোথায় অন্য পোলাপানদের মতো আজাইরা সময় নষ্ট করার। জি, জি, আমার ভাগিনা, আপনাদের আইজি সাহেব আমার ভাগিনা। জি জি…। না, না, ঠিক আছে, আমি আসতেছি।
খালাম্মা ম্যাডাম কথা শেষ করে এবার কাকে যেন ফোন করে-হ, হ, না, থাক, আরে আমার, এইটা আমার ছেলে, রাখুক তো আটকাইয়া, আধা ঘণ্টার ভিতরে পোলারে থানা থেইকা বাইর কইরা আনতাছি। আমি হইলাম আইজির মামি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, এখনো থানায় পৌঁছাইতে পারি নাই, অনেক জ্যাম। না, আমি আইজিরে দিয়া ফোন করুম ক্যান, এই সব ছোটখাটো কাজে আইজিরে কমু? ক্যান, আমি আজাইরা কাম করুম ক্যান, আমি ওসি সাহেবরে ফোন দিয়া কইলাম আপনাগো আইজি সাহেবের মামি। ব্যস খাড়া হইয়া গ্যাছে…, লগে লগে কয় জি, মামি ম্যাডাম আপনে আসেন, আমরা আপনার ছেলেকে সঙ্গে সঙ্গে রিলিজ করে দেব।
খালাম্মা বনাম ম্যাডাম
আজ শুক্রবার সোমা আক্তারের অফিস বন্ধ। গত রাতে কথায় কথায় দিলরুবা আহমেদ জেনে নেয়, আজ কয়টায় সোমা আক্তার বের হবে। শুক্রবার সোমা আক্তার সাধারণত ঘরে থাকে।
শুক্রবার সকাল দশটার ভেতরেই ইসুবকে আসতে বলে দিলরুবা আহমেদ। সকালে এসে গাড়ির চাবি নিয়ে আসে। তারপর গাড়ি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে বলে তাড়াতাড়ি। ইসুব ত্রস্ত হাতে ধোয়ামোছা শুরু করলেও শেষ হওয়ার আগেই নেমে আসেন দিলরুবা বেগম ও তাঁর স্বামী কামাল আহমেদ।
দিলরুবা বেগম গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে তদারকি করতে থাকে। ওই কোনায় মুছ, ওই ধারে ঘষা দে, সাবান লাগি আছে, কদ্দুর পানি দে, ন্যাকড়াটা চিবি ল, চাক্কার কোনায় হয় নো, আঙুল ঢুকাইয়া ঘষা দে ইত্যাদি ইত্যাদি, দিলরুবা বেগমের কণ্ঠে যেন আদেশের ঝড় উঠছে, সেই ঝড় যেন থামতেই চায় না।
ইসুবের মাথা যেন রাগে ঝাঁঝাঁ করে; কিন্তু স্তব্ধ জলাশয়ের মতো ইসুবের অভিব্যক্তি দেখে বোঝার উপায় নেই তার অন্তর্গত অবস্থা। যেমন করে বলে দিলরুবা বেগম, সে তেমন করেই করে যেতে থাকে। কিন্তু ইসুবের অভিব্যক্তিহীন অবয়বের ওপর দৃষ্টিপাত করে দিলরুবা বেগমের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়।
যা, হইছে, রাখ, রাখ, নে চল।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ইসুব জিজ্ঞেস করে, খালাম্মা কই যাইবেন?
এই ছ্যামড়া! আমারে খালাম্মা ডাকছ ক্যান? আমারে নি তোর মায়ের বোইন মনে হয়? ফাজিল কোথাকার!
তুই সোমারে কস ম্যাডাম আর আমারে ডাকছ খালাম্মা? হ্যাঁ, তর এত্ত বড় সাহস হইছে ক্যামনে? জানোস তুই কার চাকরি করোস? আমার… আমার … এই দিলরুবা ম্যাডামের। আমারে নি তোর বুড়া মনে হইল, হ্যাঁ?
তুই সোমারে তো খালাম্মা ডাকোছ না?
না, মানে হইলো ম্যাডাম আমারে না করছে ম্যাডাম ডাকতে, আমারে কইছে আপা ডাকতে।
তো যে তরে নিষেধ করছে ম্যাডাম ডাকতে তারে তুই সারা দিন ম্যাডাম, ম্যাডাম ডাকোছ, আর আসল ম্যাডামরে ডাকোছ খালাম্মা? ক্যান রে আমারে তোর এত্ত বুড়া মনে হইলো?
না, না, আপনে বুড়া হইবেন ক্যান! খালি হিজাব বান্দেন বইলা আপনারে বুড়া লাগে।
কী কইলি, আমারে বুড়া লাগে! আমারে বুড়া লাগে আর সোমারে তোর কাছে ছেমড়ি মনে হয়, তাই না?
হারামজাদা লুইচ্চা, সোমারে খুশি করার জন্য তারে ম্যাডাম ডাকে, আর কয় কিনা আমারে বুড়া লাগে।
রাখ ভাঙা মাসের কয়টা দিন, তার পরে আমি তর চাকরি করা বাইর করুম।
সেই থেকে ইসুব খালাম্মা ম্যাডাম ডাকা শুরু। খালাম্মা ম্যাডাম ডাকলে উনি খুব খুশি হন।
খালাম্মা ম্যাডাম গাড়িতে উঠে বলল, যা, তুই খিলক্ষ্যাতে যা। খিলক্ষেতে যেতে বলে খালাম্মা ম্যাডাম ফোন করে। হ্যালো সোমা, আমি আসতেছি, আইজ মেরুনারে কদ্দুর নিয়া আসুম। হ্যারে কদ্দুর দরকার। আমার বাসায় কয়জন ম্যাহমান খাইব তো। আমার বাসার বড় মেয়েটা দ্যাশে গেছে।
ওস্তাদ
সকালবেলা ঘুম ভেঙে যায় জসিমের কান্নাকাটিতে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ইসুব। ঘুমের ঘোর তখনো কাটেনি। ঘুম জড়ানো চোখে ইসুব উঠে বসে। জসিমের শোকে বিহ্বল হয়ে কাঁদছে হাউমাউ করে। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সেই কান্না হু হু বেগে ইসুবের ঘুমের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ইসুব বুঝে ওঠার আগেই ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে ইশারা করে কথা না বলতে।
ডুকরে ডুকরে কাঁদে আর বলে-জি স্যার, জি, স্যার আমি আইজ যামু স্যার, স্যার দুপুরের মইধ্যে পৌঁছাইয়া গেলে স্যার বিকালের মইধ্যেই লাশ জানাজা দিয়া ফালামু। কাইলকার দিনটা বাপ-ভাইবোইনের ব্যবস্থা কইরা পরশু দিন বিকালে ফিরা আসুম। জি স্যার, জি, আইচ্ছা স্যার, আমি তাইলে মবিন স্যারের কাছে যামু স্যার? জি স্যার…জি আইচ্ছা, যে স্যার, জি…স্যার…স্যার আপনে আমার মারে মাফ কইরা দিয়েন স্যার, আমারে আপনে স্যার যা দিলেন স্যার আমার গায়ের চামড়া কাইটা জুতা বানাইয়া দিলেও স্যার সেই ঋণ শোধ হইব না স্যার, এই দুর্দিনে আমার ছোট ছোট ভাইবোন, অসুস্থ বাবা স্যার, সবাই আপনারে দিল থেইকা দোয়া করব স্যার…
ইসুববারে! হালার পুত, উড, উড…উড…, কাম ফাইনাল, আমি হালায় অভিনয় করলে শাহরুখ খান, শাকিব খান-সব খানের কপাল পুড়ছিল, বুঝছস?
সদ্য ভাঙা ভোরের ঘুমের ওপর জসিমের এই সব অদ্ভুত আচরণের কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
উঠে বসে বলে, জসিম ভাই! আপনের কিছুই তো বুঝতে পারি নাই, একটু খুইলা কন!
আবে সরকারি চাকরির ইন্টারভিউ পামু, আমগো এমপির লগে লাইন দিছি, তিন লাখ টাকা ঘুষ দিতে হইব, দেড় লাখ এখন আর দেড় লাখ অ্যাপয়েনমেন্ট ল্যাটার পাওনের পর।
আপনের এত্ত ভালো চাকরিটা ছাইড়া দেবেন?
দিমু মানে, খালি দিমু না, সরকারি চাকরি পাইলে এইটার মুখে লাত্থি মাইরা ছাড়ুম, অ্যা… না, ভুল কইলাম. . .স্যাররে একটা চাপা মাইরা ছাড়ুম।
আপনে না কইলেন আপনের স্যারে আপনারে খুব আদর করে?
হ, করে, তবে স্যারের থেইকা ম্যাডামে বেশি। আমি তো এমুন ত্যাল মারি, যদি কয় রাইত তিনটার সময় ডিউটি লাগব, আমি তো সব সময় ইসটানবাই থাকি।
ব্যাতন তো ভালো, এইটা ছাড়বেন ক্যান তাইলে?
আরে সরকারি চাকরি একবার পাইলে অনেক লাভ, ওভারটাইম, ত্যাল-গ্যাসের বিল বানানি, দুই ঈদে দুইটা বোনাস, ছুটিছাঁটা-সব অনেক অনেক, বড় কথা হইলো পেনশন, পেনশনের টাকা পাওয়া যাইব বুড়া বয়সে। প্রাইভেট চাকরি-এগুলির তো কোনো ফিউচার নাই। আইজ আছে কাইল নাই, সব মালিকগো মর্জির ওপরে টিকা থাকে। আর সরকারি চাকরি একবার হইলে আর জীবনের তরে ভাবতে হইব না।
সরকারি ডেরাইভার ক্যামনে হওয়া যায়?
ওই যে লাইন মারা, লাইন মারতে জানলে বাংলাদেশে সব হয়, লোকাল এমপি-এ তো এখন পিয়নের চাকরি দিতেও তিন লক্ষ টাকা ঘুষ খায়।
এমনে কানতে আছিলেন ক্যান? সকাল সকাল?
আরে মায়ে মরছে কইয়া ছুটিটা ফাইনাল করলাম। গত মাসে এক দিন ছুটি নিছিলাম মার অসুখ কইয়া। আইজ তো আর মার অসুখ কইলে ছুটি দিব না, আবার না কইয়া গ্যালেও চাকরি নট, আইজই আমারে যাইতে হইব, টাকা জোগাড় কইরা এমপি ভাইরে কাইলই দিতে হইব। সত্যি কথায় ভাত নাই, জানোস তো, তাই কাইন্দা-কাইটা ছুটি ফাইনাল।
জসিমের বুদ্ধি এবং অভিনয়ে বিমুগ্ধ ইসুব কয়েক সেকেন্ড কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে জসিমের দুই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলে-সালাম জসিম ভাই সালাম আপনারে ভাই, আপনে আসল ওস্তাদ। আপনার কাছ থেইকা সত্যি শিখনের অনেক কিছু আছে!
মিসকল
আরেকটু হলেই গাড়িটা প্রায় ধাক্কা লেগে গিয়েছিল ট্রাকের সঙ্গে। খিলক্ষেত রেলগেট পার হয়ে মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর উঠেছে গাড়ি, এ সময় ফোনের রিং। একবার ফোনের সেটের দিকে তাকিয়ে দেখে আবার সামনে তাকায়। কয়েক রিংয়ের পর থেমে যায়। পুনরায় রিং বাজলে ইসুব ঘুরে দেখতে যায়। আর অমনে হয়তো ওর হাতের মুঠোয় স্টিয়ারিং একটুখানি ঘুরে যায়। ঠিক তখনই ডান পাশের বাসটা একটু এগিয়ে গেছে। যদি এগিয়ে না যেয়ে আরেকটু পেছনে থাকত, তাহলে একেবারে বাসের তলে আশ্রয় হতো।
সোমা আক্তার বিরক্ত হয়ে বলে, কী ব্যাপার ইসুব, তোকে কত বলেছি গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনের দিকে নজর দিবি না। আজ তো বড় রকমের দুর্ঘটনা হতে পারত। বেয়াদপ! কথা বললে কথা শুনিস না কেন? এইভাবে কেউ জীবনের ওপর ঝুঁকি নেয়? ইসুব, আমি তোকে আগেও বুঝিয়ে বলেছি, যখন গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে ধরবি, তখন মনে রাখবি, গাড়িতে যতগুলা মানুষ আছে তাদের জীবনের দায়িত্ব তোর হাতে এসে পড়ল। সুতরাং গাড়ি চালানোর সময় সাবধান, এমন কোনো কিছু করা যাবে না, যাতে করে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু পেছনের সিটে বসে সোমা লক্ষ করে, দুই সিটের মাঝখানে মোবাইল ফোনটা এমন করে রাখে যেন টেলিফোন আসলেই সে নম্বরটা দেখতে পায়। এই মুহূর্তে ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দেখতে গিয়ে গাড়ি একেবারে বাসের পেছনে ঘুরে যায়। আর ঠিক তখনই পেছন থেকে আরেকটা গাড়ি এগিয়ে আসে। গাড়ি বাঁকা হয়ে যাওয়ার কারণে কোনো রকমে ব্রেক কষে এ যাত্রা রক্ষা পেলেও আরেকটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। ধাক্কা লাগা গাড়ির ড্রাইভারের আগেই মালিক ধরনের একজন লাফিয়ে নেমে আসে। অই হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসুবের ওপর। ইসুব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর গালে চটাং চটাং কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। আবারও মারতে যাবে এই সময় গাড়ির পেছনের দরজা খুলে সোমা আক্তার দ্রুত বের হয়ে এগিয়ে এসে ক্ষিপ্ত ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে বলে-কী, বলুন তো ও ইচ্ছা করে লাগিয়েছে নাকি আপনার গাড়িতে? এ রকম অভদ্রলোকের মতো আচরণ কেন করছেন?
আপনি জানেন এই হারামজাদাগুলা গাড়ি চালানি না শিখেই রাস্তায় গাড়ি চালাতে নামে। এগুলির কারণেই যত এক্সিডেন্ট হয়।
হতে পারে আপনার কথাই ঠিক; কিন্তু তাই বলে আপনি ওর গায়ে হাত তুলছেন কেন? মালিক বলে? আপনি ওর মতো ড্রাইভার হলে কিন্তু এভাবে গাড়ি থেকে নেমে বাহাদুরি দেখাতেন না।
আপনি দ্যাখেন আমার গাড়িটার কী করল?
রাস্তায় গাড়ি বের হলে যেকোনো সময় এটা হতে পারে, এত যখন গাড়ির জন্য দরদ গাড়ি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকলেই তো পারেন? যান গাড়িতে গিয়ে উঠুন, আর ভদ্র হতে শিখুন।
আপনার কাছ থেকে নিশ্চয়ই ভদ্রতা শিখতে হবে না?
না, না, তা শিখতে আসবেন কেন, তবে কারো ড্রাইভারের গায়ে হাত তোলার আগে আইনটা শিখে আসবেন। কালো টাকায় কেনা গাড়ির জন্য এত দরদ কেন? স্টুপিড, ক্রিমিনাল কোথাকার।
ম্যাডামের সামনে এমন কইরা থাপ্পড় লাগাইল শালার পুতে, মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে আছে। আজকের সকালটা আছিল সুন্দর। সকাল সকাল ম্যাডামের ব্যবহারে মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। মনে হইছিল, খুব সুন্দর। ম্যাডাম আমি আইছি-ম্যাডাম বলল, উপরে আস। অন্য দিনের মতো আইজও দরজা খোলা ছিল, ইসুবকে দেখামাত্র ম্যাডাম আপা বলল মেরুনা, ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে প্লাসটিকের লাঞ্চ বক্সটা নিয়ে এসো। মেরুনা যেন চঞ্চল প্রজাপতি, এক দৌড়ে ওড়না উড়িয়ে লাঞ্চ বক্সটা নিয়ে এলো। সেটা এগিয়ে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে হাসে। ছেড়ি ভারি দুষ্ট, খালি মিটমিটায়া হাসে।
ইসুব, এইটার ভেতরে দুইটা স্যান্ডউইচ আছে। কালকে তুই চাইনিজ খেতে পারিস নাই। আমি মেরুনাকে ভালো ভালো জিনিস বানানো শেখাচ্ছি, মেরুনাকে শিখাব বানানো, আর তোকে শিখাব খাওয়ানো।
আমি তো ম্যাডাম কোনো দিনও স্যানইচ খাই নাই, কেমুন লাগব জানি না।
কেউ কি পৃথিবীর সব খাবার খেয়ে জন্মায়? খেতে খেতে অভ্যাস হয়। সব দেশের খাবারদাবার খাওয়ার অভ্যাসের দরকার নাই; কিন্তু অন্তত খেতে পারা উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত অখাদ্য না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত যেকোনো খাবার খেতে পারবি না কেন?
আপা আমরা গরিব মানুষ, এত রকমের খাবার চিনুম ক্যামনে? পাইলে না চিনুম?
খাবার চিনতে হবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো ধরনের খাবার খাওয়া শিখতে হবে। তুই চাইনিজ খেতে পারিসনি-এটা আমাকে খুব অবাক করেছে। ধনীদের চেয়ে গরিবদের এই জিনিসটা শেখা বেশি জরুরি। এটা তোকে শিখতেই হবে। এই স্যান্ডউইচ দুইটা মেরুনাকে আমাদের দেশি স্বাদে বানাতে শিখিয়েছি। যা, বসে বসে খেয়ে দ্যাখগে, কেমন লাগে।
একটা কথা জিগাই আপা?
হ্যাঁ, জিগা, মেরুনা স্যানউচ না কী কইলেন এইটা বানানি শিখা কী করব?
আরে সেইটাই তো কথা, সব ধরনের খাবার যেমন খাওয়া শিখতে হবে, তেমন সব রকমের খাবার বানানোও শিখে রাখা ভালো। সেটা তুই বুঝবি না।
স্যানইচ খেতে খুউব মজা লাগে আজ সকালে। পাউরুটির মইধ্যে মুরগির মাংস, গোলমরিচের গুঁড়া, আরো কী-সব দিয়া বানাইছে। আইচ্ছা, একটা মুরগির মাংসরে হলুদ-মরিচ, আদা-রসুন, পেঁয়াজ দিয়া ভুনা কইরা না রাইন্ধা কী কারণে সাদা কইরা সিদ্ধ কইরা পাউরুটির মইধ্যে পুর দিয়া এমন কইরা স্যানইচ বানানির কাম আছে! ম্যাডাম আপাটার মাথাটা মনে হয় একটু-আধটু না, পুরাটাই খারাপ আছে। এই মাথা খারাপ নিয়া ক্যামন কইরা চাকরি করে, রিপুটিং তৈরি করে ভাবতে অবাক লাগে। একা একা বাড়িভাড়া দিয়া থাকে!
এত্ত বয়স হইছে, ট্যাকাপয়সা তো ভালোই কামায়, এখন পর্যন্ত বিয়া করে নাই, কী দাপটের দাপট রে বাব্বা… মাইয়া মানুষের।
প্রেমালাপ
গাড়িতে জ্যামে আটকে বসে থাকতে থাকতে প্রায়ই ঝিমিয়ে পড়ে সোমা আক্তার। আজকাল প্রায়ই রাত জাগা হচ্ছে। রাত জাগার কারণে জ্যামে আটকালেই তন্দ্রা আসে। আজও তন্দ্রা নেমে আসে, হঠাৎ এ সময়ে ইসুবের মোবাইল ভ্রুতভ্রুত শব্দ করে। ইসুব ওর ফোন ভাইব্রেশনে রেখেছে। সোমা আক্তার ইচ্ছা করেই ঘুমের ভান করে ছিটের পেছনে মাথা হেলিয়ে রাখে। ঘাড় কাত করে পেছনে তাকিয়ে দেখে, ম্যাডাম আপায় ঘুমায়। ম্যাডাম আপা গাড়ি চালানোর সময় কথা বলতে নিষেধ করেছে। এখন তো গাড়ি জ্যামে আটকে আছে। ফিসফিসিয়ে কথা বলে ইসুব-হ, কও, হ…তোর কথাই ভাবতে আছিলাম, হ্যাঁ, কাইল সারা রাইত তর কথা ভাবছি। সাবধানে পেছনে ফিরে আরেকবার ম্যাডাম আপার ঘুমের বিষয়টি নিশ্চিন্ত হয়।
তারপর ফিসফিসিয়ে বলে-ম্যাডামে ঘুমাইয়া পড়ছে। সারা রাইত জাইগা তো ম্যাডাম আপায় রিপোট ল্যাখনের কাম করে, হ… হ…।
না, আইজ সারা দিন ডিউটি, আবার সন্ধ্যার থিকা খালাম্মা ম্যাডামের ডিউটি।
সোমা আক্তার কান পেতে শোনার চেষ্টা করে, ইসুব কার সঙ্গে কথা বলে?
তোমার জন্য আমি তো পারলে সাত দিনই ছুটি করি, মন তো চায় তোমারে নিয়া গাড়ি এইটাতে কইরা ঘুইরা বেড়াই, আর ঘুইরা বেড়াই, ফ্যান্টাসি কিংডমে যাই, আশুলিয়া যাই, শিশু পার্কে যাই, তোমারে নিয়া বসুন্ধরা সিটিতে যাই।
থাক, এখন রাইখা দেও, ম্যাডামের আবার ঘুম ভাইংগা যাইব। বিকালে ফোন দিমুনে, আইচ্ছা, রাখি।
চোখ বন্ধ করে সোমা আক্তার এসব কথা শোনে আর মনে মনে হাসে। কিছুক্ষণের ভেতরে পুনরায় ইসুবের মোবাইল বেজে উঠলে ইচ্ছাকৃতই সোমা আক্তার জিজ্ঞেস করে-কী রে ইসুব, তুই এখনো ধান্দাবাজি করছিস মেয়েদের সঙ্গে?
না, না, ম্যাডাম, আমার খালাতো বোইনে ফোন করছে গেরামের বাড়ি থেইকা, মায়ের শরীলটা ভালা না।
তোর মা ফোন করতে জানে না?
জানে যে, তয় শরীরটা যে ভালা না, জ্বর আইছে, আমার খালাতো বোইনে আমারে সেইটা জানাইল। জিগাইল, আমি কবে বাড়ি যামু।
সবে তো মাত্র কাজে জয়েন করলি? এখনই কি বাড়ি যাবি?
না ম্যাডাম, আমি বাড়ি যাইবার ছুটি চাইতেছি না, কইলাম আর কি! যদি অনুমতি দ্যান তাইলে একদিন বিষসুদবার সন্ধ্যায় গেলাম। শুক্রবার বিকেলে আবার চইলা আইসা শনিবারে আপনার ডিউটি করলাম।
ঘামের গন্ধ
ঘরে ফিরেই ইসুব তাড়াহুড়া করে পরনের শার্ট খুলে ফেলে খালি গা হয়। চৌকির তলে টিনের বাক্সের তালা খুলে সেটির ভেতর থেকে লুঙ্গি বের করে দ্রুত প্যান্ট বদলায়। দ্বিতীয় শার্ট, একটা শহীদ মিনারের ছাপা টি-শার্ট, একটা লাল রঙের পাঞ্জাবি টেনে বের করে। সবগুলো ত্রস্ত হাতে ঝাড়া দেয়, ঝাড়া দিলে সেগুলোর একটার ভেতর থেকে একটা রঙিন ছবি টুপ করে ঝরে পড়ে। ছবিটা হাতে নিয়ে একপলক দেখে মুচকি হাসে। অতঃপর ছবিটা টিনের বাক্সের ঝাপা তুলে ফেলে দিয়ে সবগুলো কাপড় একসঙ্গে পেঁচিয়ে হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত সে বাইরের বাথরুমের দিকে রওনা হয়। বাথরুমের সামনে এসে দেখে, সেখানে জসিম কাপড় কাচছে। জসিমের পাশে ড্রাইভার মতিন, দুজনই গল্প করছে আর কাপড় কাচছে। জসিম আর মতিন খুব ভালো বন্ধু। দুজনে সব কাজই একসঙ্গে করে, শুধু দিনের বেলা গাড়ি চালানির চাকরি ছাড়া। মতিনের চাকরি, সেটাও জসিমের জোগাড় করে দেওয়া। জসিম আর মতিন দুজনেরই বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে। দুজনই বয়সে ইসুবের থেকে বছর দশ-বারো বছরের বড় হবে হয়তো। জসিম ঠাট্টা করে ইসুবকে ডাকে ভাতিজা। জসিম ভাতিজা ডাকার কারণে মতিনও জসিমকে অনুসরণ করে। ইসুবকে দেখে জসিম বলে ওঠে-ভাতিজা খালাম্মায় কি বারোটা বাজায়া দিল? হাহাহা … জসিমের ঠাট্টাকে সমর্থন করে মতিন-আহা, তাও যদি ম্যাডামে বাজাইত, একটা কামের কাম হইত।
ভাতিজা, আমগোরে ম্যাডামের গল্প কদ্দুর শোনাও না ভাতিজা? ম্যাডামের ফিগারডা ক্যামন?
আরে দূর, ফিগার দিয়া কী করুম? খালি প্যাঁচাল পাড়ে, কয় আমার শরীলের ঘামের গন্ধে নাকি গাড়ির ভেতরে বইতে পারে না। আমারে লাক্স সাবান কিননের ট্যাকা দিয়া কইল, রোজ রাইতরে লাক্স সাবান দিয়া শার্ট ধুইয়া দিতে। একটা ধোয়া শার্ট পইরা যাইতে হইব, আর একটা সঙ্গে নিয়া যাইতে হইব। দুপুরের পর সকালের শার্ট বদলাইয়া ফেলতে হইব। স্যায় নাকি আমারে সপ্তাহে একটা লাক্স সাবান কিনা দিব খালি শার্ট কাচনের জন্য।
তো তুই হালায় ঘামের গন্ধঅলা শার্ট পিন্দা যাস ক্যান? কইবই তো? ম্যাডামগো মন রাইখা কাম করবি তো দেখবি সাবানের লগে লগে আরো অনেক কিছু পাইবি, বুজঝোস ভাতিজা, পেপারে খবর আহে দ্যাখোস না, ড্রাইভারের বদলে গেল ভাগ্য, ড্রাইভারের প্রেমে বিদেশিনী। তর ম্যাডামের চাকরিটা পাওনের দরকার আছিল আমার বুজঝো মামা, কাপড় কাচা রেখে ডান হাতের পেশি ফুলিয়ে শক্ত করে দেখায় জসিম।
ইসুব ওদের ইশারা বুঝে মুখ টিপে হাসে। ইসুবের মুখের ওপর দৃষ্টি আবদ্ধ করে এবার মতিন বলে, তুমি ভাতিজা খাওনদাওনের পিছে কয়টা বাড়তি টাকা খরচা করো, তোমার শরীল সাইসথের যা কন্ডিশন-তিন বাঁক দিয়া গ্যাছে সব কিছু, বডিটা এমুন থাকলে তো ম্যাডামগো নজরে আটকায়বা না।
ইসুব তখন নিজের নগ্ন শরীরের দিকে তাকায়।
তোমার ভাতিজা, বগলতলার লোম তো দাড়ি হইয়া গ্যাছে, এইডারে কাইটা কমাইয়ো, নাইলে ঘামের গন্ধ কমব না, ওইডা বেশি থাকলে ঘামের গন্ধ শরীরে বইয়া থাকে।
আইচ্ছা জসিম, হিন্দি সিনেমার সময় অ্যাডভারটাইজটা দ্যাখছস না? অই যে অরজুনে মডেল হইছে, তার পরে ঋতিক রোশানে করছে, আফটার সেভের মতো, কী যেন কয়?
ওহ, ডিওডোরন, ঠিক কইছস, ওগুলি লাগাইলে আর ঘামের গন্ধ হয় না; কিন্তু আমগো দেশে যেই গরম, সারা দিন ঘাম বাইর হয়, দিনে একটা ডিওডোরন লাগব। এত্ত পয়সা কই পাইব ভাতিজা, তার থেইকা ম্যাডামের কথাই ঠিক, সপ্তাহে একটা লাক্স সাবানের খরচা কম।
হাসি-ঠাট্টার ভেতর দিয়ে জসিম ও মতিন দুজনে তাদের কাপড় কাচা শেষ করে গোসলখানা থেকে বের হয়ে এলে ইসুব শার্ট কাচতে বসে। নতুন লাক্স সাবান ঘষে ঘষে সে তার কাপড় কাচে, লাক্স সাবান গায়ে ঘষে গোসল দিতে খুব ভালো লাগে। সকালে গোসলের লম্বা লাইন থাকে। তা ছাড়া ভোরে বিছানা ছাড়তে খুব কষ্ট হয়। কোনো রকমে বিছানা ছেড়ে চোখমুখ ধুয়ে গায়ে শার্ট চাপিয়ে বের হয়ে আসে। তেজগাঁও থেকে অটোতে, বাসে, তারপর রিকশা-এতগুলা বদলি করে, সকালের জ্যাম ঠেলে খালাম্মা ম্যাডামের বাড়ি পৌঁছতে প্রায়ই ৯টা বেজে যায়।
খালাম্মা ম্যাডামের কথা মনে হলে তার মেজাজটাই খারাপ হয়। তার চেয়ে আয়েশা ডারলিং, রোজিনা অথবা শেলি ডারলিংয়ের কথা ভাবাই ভালা। ঘষে ঘষে ডলে ডলে লাক্স সাবানের ফেনা তুলতে থাকে ক্রমাগত। এই ফেনা দেখতে দেখতে ওর মনে পড়ে, টেলিভিশনে লাক্সের অ্যাডভারটাইজ। দীপিকা খুব সুন্দর সেক্সি এখন দীপিকারে কারিনার চাইতে সুন্দর লাগে। মুখ টিপে হাসে আর চোখ বুজে আবেশে সাবান ঘষতে থাকে। ফেনায় ফেনায় নিমজ্জিত হতে থাকে ইসুব, ফেনা তুলতে ভালো লাগে ঘষে ঘষে বুকে, বগলের তলায়, নাভির ফোকরে, ক্রমেই নাভির নিচ থেকে তলপেটের নিচে আরো… আরো নিচে, ফেনায় ভরে ফেলতে থাকে, কী সুন্দর সুবাস লাক্স বিউটি সোপের, ম্যাডামের পছন্দ ভালো, ম্যাডাম আপা ভালো, সে ফেনা তোলে আর মনে মনে আওড়ায়-ম্যাডাম আপা, আপনে খুব ভালা। তখন ওর মনে পড়ে মেরুনার কথা, মেরুনা একটু কালা, তবে চেহারাডা সুন্দর, মায়া আছে চোখ দুইটা আর ঠোঁটে, একটু বাডি; কিন্তু মেরুনার বুক, কোমর খুব উঁচা, কামিজের ওপর দিয়া মনে হয় ছোটখাডো দুইটা কদু বইয়া আছে, আহ, খুব সুন্দর, একদিন মেরুনার বুকে হাত দিতে হইব… ওর ফেনা তুলতে ভালো লাগে… ফেনার কোমল নিমজ্জনে সে যেন ক্রমেই ডুবে যেতে থাকে অদ্ভুত শিহরণে।
আনন্দ মেলা
রাতে বাসায় ফিরে দেখে জসিম, মতিন আর খোকা ওরা তিনজন টিভি দেখে। ইসুবকে দেখে জসিম প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে-ভাতিজা আইছ, আইজও তোমার খালাম্মার খপ্পরে পড়ছিলা?
হ, আর কি? রোজই তো হ্যায় আজাইরা ঘুরতে বাইর হয়, আর খালি কয় আমি তো তেমন কুনহানে যাই না, সন্ধ্যার পর মাঝে মইধ্যে খালি কদ্দুর আত্মীয়স্বজনরে একটু দ্যাখতে যাই। এইডাও একটা চালাকি। ম্যাডাম আপায় গ্যাস লয় সকালে, আর না হইলে দুপুরে, আর গাড়ি রাখতে যাইতে হয় খালাম্মা ম্যাডামের বাসায় সন্ধ্যায়। আর নইলে রাইতরে। খালাম্মা ম্যাডামে একদম বোরকা পিন্দা রেডি থাকে, গাড়ি নিয়া যাওনের লগে লগে হ্যায় বাইর হয়। ম্যাডাম আপার কেনা গ্যাস দিয়া হ্যায় হ্যার কাম সারে, এমুন চালাকের চালাক হ্যায়, কোনো দিন গ্যাস লয় না। যদি গ্যাস শ্যাষ হইয়া যায়, তাইলে স্যায় তখন কয় ত্যালে চালা। তাইলে পরদিন ম্যাডাম আপাকে তখন গিয়া বেশি দাম দিয়া ত্যাল কিনতে হয়। হ্যায় য্যান ত্যাল খরচ না করে, এই ডরে ম্যাডাম আপা রোজই তিন শ টাকার গ্যাস লয়। প্রথম দিকে ম্যাডাম আপায় বুঝত না, হ্যার এই সব দুই নম্বরি বুদ্ধি একটু কম আছে।
ইসুবের কথায় ঘরের ভেতরে হাসির রোল ওঠে। মতিন এক মুঠ মুড়ি গালের ভেতর ঢেলে খচর খচর করে চিবাতে চিবাতে বলে-তুই দেখি মামা একদম হাসিনা-খালেদার গেঁড়াকলে পড়ছস?
মতিনের কথায় সমর্থন জানিয়ে জসিম বলে, ঠিকই কইছস তুই মতিন-তারপর ইসুবের দিকে তাকিয়ে বলে-ভাতিজা কাইল যাইবা নাকি আনন্দমেলা করতে?
সেইডা আবার কী জসিম ভাই?
আমগো মালিকের গারমেন্টের শ্রমিকরা সব কাইলকা বনভোজন করতে যাইতাছে-এইটার নাম আনন্দমেলা। অফিসের সব বড় বড় অফিসার, সুপাইভাইজার, স্যারের পোলা সগলের সামনে আমারে ডাইকা কইল-জসিম, তোর কাইল ছুটি, যা, ফ্যাক্টরির সবার সঙ্গে তুইও যা পিকনিক করতে, আর হ্যাঁ, শোন যদি চাস তাইলে তুই তোর দুই-তিনটা বন্ধুবান্ধবও নিয়া যাইস, আমি মোবারককে বলে দিচ্ছি। মোবারক বুঝছস, শালা হইলো সুপারভাইজার, স্যার আমারে আলগা খাতির করে বইলা আমারে খুব জেলাছ করে। -তো যাবি নাকি ইসুব তুই কাইল?
যাইতে তো মন চায়; কিন্তু কাইল যে ডিউটিতে যাইতে লাগব?
আরে দূর, সেই দিন কী শিখলি? আমি শালায় ক্যামন অভিনয় কইরা বাড়ি থিইকা ঘুইরা আসলাম, আর তুই এক দিন ছুটি করতে পারবি না? ভাতিজা, তোমারে দিয়া কোনো কাম হইব না মামা।
তাইলে কী কন? কাইল সকালে ফোন কইরা কাইন্দা কমু মা মইরা গ্যাছে?
আবে হালায় কয় কী? মশা মারতে কামান দাগা, কাইল হইলো গিয়া ওয়ানডে ইমার্জেন্সি। তুই সকাল দশটার দিকে ফোন দিয়া কইয়া দিবি, রাইতরে অনেকবার বমি আর পায়খানা। সারা রাইত খালি হাগছস, হাগতে হাগতে অখন আর উইঠা খাড়ানির শক্তি নাই। এইডার ওপরে আর কোনো কথা আছে?
যেমন ওস্তাদের ওস্তাদি যেমন, তেমন সাগরেদের কাজ। ভোর ছয়টার সময় সে খালাম্মাকে মিসকল দেয়। সে জানে, সকাল ছয়টার সময় খালাম্মার ফোন অফ থাকে। আজানের পর ফজরের নামাজ পড়ে পুনরায় ঘুমাতে যায় খালাম্মা, এই সময় তার ফোন ধরবে না; কিন্তু একটা প্রমাণ থাকল, সে খালাম্মাকে ফোন দিয়ে না-পাওয়ার কারণে পরে খালাম্মার কাজের মেয়ে আলো এবং পরিশেষে ম্যাডাম আপাকে জানিয়েছে।
এ সবই জসিমের ওস্তাদি বুদ্ধি, বেশির ভাগ সময়ই এ কারণে ইসুব জসিমকে ডাকে ওস্তাদ। জসিমের কথামতো ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ইসুব ম্যাডাম আপাকে ফোন করে বলে-আপা সারা রাইত আমার বমি আর পায়খানা। ম্যাডাম আপার হৃদয়টা কোমল। তাকে বোঝানো সহজ, তাই ইসুব সকাল সকাল ম্যাডাম আপাকে ফোন করে। ইসুবের ডায়রিয়ার কথা শুনে ম্যাডাম আপার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়-স্নেহমাখা কণ্ঠে বলে-ইসুব, তোর শরীরে তো হাড্ডি ছাড়া মাংস নাই রে… এই সব অসুখ প্রতিরোধ করার জন্য রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হয়। শোন, সারা দিন অনেক ওর স্যালাইন খেতে হবে, আর কাগজি লেবুর রস। আচ্ছা ইসুব তুই কয়েক প্যাকেট এক্সট্রা স্যালাইন কিনে নে, আর এক হালি কাগজি লেবু। এটার জন্য যে এক্সট্রা খরচ হবে ভাবিস না, আমি তোকে সেটার পয়সা কাল দিয়ে দেব; কিন্তু খাইস! আমি জানি দুপুরের লাঞ্চের যে টাকা আমি তোকে দিই, সেটা তুই জমিয়ে তোর মা-বাবার জন্য পাঠাস। তোর কাছে যদি টাকা না থাকে তাহলে তুই জোগাড় করে নে, কাল দিয়ে দেব।
জি আপা, জি খামু, জি আপা, আমার খুব ঘুম পাইতাছে, রোজ বাসায় আসতে রাত বারোটা-একটা বাজে, আবার ভোরে ছয়টায় উঠি, আমি আইজ সারা দিন ফোন অফ কইরা দিয়া ঘুমামু।
আর শোন, ভাতটা নরম জাউ বানিয়ে খাস, পেঁপে অথবা কাঁচাকলা দিয়ে ভাত খাবি। আজ সারা দিন ভালো করে ঘুমা। কাল কিন্তু আমার খুব জরুরি আলোচনা অনুষ্ঠান, সেখানে কিন্তু যেতেই হবে। তুই আজ ভালো করে নিজের যত্ন নে, বুঝলি?
জি আপা, আপনে খালাম্মারে একটা ফোন দিয়া কইয়েন, আইজ সারা দিন ওনার ডিউটি করার কথা আছিল, আমি তো ফোন দিছিলাম, ভোরে, ওনারে পাইলাম না। আমি তাইলে কাইল সকালে আসুম ম্যাডাম?
মোবাইলের কানেকশন বন্ধ করে সে জসিম ও মতিন দুজনার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে-দুইটার মইধ্যে একটা বেশি সোজা আর একটা হইল একদম দারোগার মতো চালাক।
এত্ত বড়লোক ক্যামনে হয়
মালিকের তেজগাঁও ফ্যাক্টরির পেছনে ড্রাইভারস অ্যান্ড কেয়ারটেকারস কোয়ার্টারে থাকে জসিম। মালিকের দুটো গাড়ি চালায় জসিম। দুইটা গাড়ির একটা থাকে বাড়িতে আর একটা রাখে ফ্যাক্টরিতে। আগে মালিকের দুটো গাড়ি তার বাড়িতে থাকত। মালিকের মেয়ে একটা নতুন বিএমডাব্লিউ কেনার পর মালিক তার প্রাডো গাড়িটা এখন রাতে ফ্যাক্টরিতে রাখে। মালিকের মার্সিডিজ শুধু বাড়ির গ্যারেজে রাখে। মালিকের বাড়িতে থাকে পাঁচটা গাড়ি। মালিকের প্রাডো প্রায়ই ফ্যাক্টরির কাজেও ব্যবহার করা হয়। আজ মালিকের গাড়ি নিয়ে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে ওখানে রেখে যেতে হবে। জসিমের মালিক এবার নির্বাচন করছে। মালিকের গাড়ি এখন অনেকেই ব্যবহার করবে। ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের খুশি করার জন্যই আজকের এই আনন্দমেলা-পিকনিক।
জসিম সকালে প্রাডো নিয়ে বের হয়। এই প্রথম ইসুবের সুযোগ হয় প্রাডো গাড়িতে বসার। এত বড়! এত্ত সুন্দর! এত্ত দামি গাড়ি! এই রকম গাড়ির ডেরাইভারি করতে পারা যেমনতেমন ডেরাইভারের কাম না। জসিমের মতো পাক্কা ড্রাইভার না হইলে এই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরলেও তো হাত কাঁপব। ইসুব মনে মনে ভাবে। একেবারে পাথর মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে ইসুব সিটের মাঝখানে।
ওর স্তব্ধতা দেখে মনে হয় ওকে বোবায় ধরেছে। জসিম যেন ইচ্ছাকৃতই তার পাশের ছিটে বসতে দিল। গাড়িতে বসে জসিম স্টিয়ারিংয়ের তলে আঙুল দিয়ে টিপে ধরে স্টার্ট দেয়। আর তখন ইসুবের উদ্দেশে বলে-দ্যাখ দ্যাখ, এইটারে বলে পাওয়ার স্টিয়ারিং, এই গাড়িতে স্টার্ট দিতে চাবি লাগে না। তর গাড়িতে তো এই সবের কিচ্ছু নাই। আইজকা চান্স পাইছস, দেইখা ল…। গাড়ি যখন পেছনে ব্যাক গিয়ারে দেয় তখন কথা কয়-দ্যাখ ম্যাজিক দ্যাখ, এইটা দ্যাখতাছস না; এইটাতে চাইয়া থাক। ইসুব চাইয়া থাকে-গাড়ির পেছনে ঘাড়-মাথা ঘুরিয়ে দেখতে হয় না। টিভি স্ক্রিনের মতো স্ক্রিনে পেছনে যাওয়ার দৃশ্য দেখায়। যাইতে যাইতে গাড়ি লাল দাগের কাছে আসলে পিকপিক পিকপিক বেল বাজে! ইসুব নতুন পৃথিবী দেখার মতো নতুন গাড়ির ভেতরের পৃথিবী প্রত্যক্ষ করে অবাক বিস্ময়ে।
গাড়ির দুই ছিটের সামনে যেইখানে রেডিও, সিডি-এসবের বাটন থাকে সেখানে টেলিভিশনের মতো স্ক্রিন দেখিয়ে জসিম বলে-ভাতিজা এইটা কী চিনো?
ইসুব কয়েকবার তীক্ষ্ন দৃষ্টি ফেলে বলে, কী এইটা? ছোট টিভি?
না, ভাতিজা, এইডারে কয় জিপিএস, একদম লেটেস্ট মডেলের গাড়ি তো, জিপিএসের মইধ্যে তোমার ম্যাডামের মতো একজন কথা কয়। কোন দিকে যাইবা, কোন দিক দিয়া যাইতে হইব সব কইয়া দিব আগে আগে। তুমি আর পথ হারাইবা না, বুঝলা। পৃথিবীর যেইখানে যাইতে চাস তরে কইয়া দিব।
হাচা কইতাছেন? যদি ধরেন নবীগঞ্জ যাইতে কই? নবীগঞ্জ কইলে হইব না, ঠিকানা ঢুকাইতে হইব। গুলশান, বনানী, লালমাটিয়া, ধানমণ্ডি-সব কইতে পারে। আয় হায়, কয় কী? আমার তো এইডা দরকার, ঢাকা শহরের সব রাস্তা তো গুলাইয়া ফেলি, আর ম্যাডাম আপায় এর জন্য খালি মেজাজ করে। এই গাড়ির এইটারে কয় বিলট ইন, তবে এইটা এখন আলগাও কিনতে পাওয়া যায়।
আমার খালাম্মা ম্যাডামে যেই কঞ্জুসের কুঞ্জুস, হ্যায় কিনব? কী কইলেন এইটার নাম?
জিপিএস…?
জি…পি…এস? জি…পি…এস… বেশ কয়েকবার মনে মনে আওড়ায় ইসুব নামটা মনে রাখার জন্য। তারপর আমার ম্যাডামরা! হ্যাগো লাগব জিপিএস? হায় রে ঢাকা শহরের অলিগলি সব চিনে একদম চোরের মতো। বোরকা পিন্দা থাকে, এত গল্লিগুল্লি যে ক্যামনে মনে রাখে, ডাইনে যা বাঁয়ে যা, মাগগো মা, আমার টাসকি লাইগা যায়। জ্যাম লাগনের আগে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরাইয়া ল, হেই গল্লি দিয়া যা, বেডির যদি তেমুন ট্যাকা থাকত, তাইলে বেডি আর বাইততে থাকত না, সারা দুইন্না ঘুইরা বেড়াইত।
তর ম্যাডাম দুইটারে আমার খুউব দ্যাখার শখ রে মামা,
পেছন থেকে মতিন ওদের দুজনার কথার ভেতরে মন্তব্য ঢুকিয়ে দেয়। ছিটের সামনে ঝুঁকে আছে সে জসিম আর ইসুবের সঙ্গে কথার বলার সময়। মতিনের কথায় ইসুব পেছন ফিরে তাকায়। মতিনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়, তখন মতিন বলে-কী রে মামা, আমারে দ্যাখতে মালিকের মতো লাগতাছে নাকি দ্যাখ তো মালিকের ছিটে? দ্যাখছস মামা, তরে সামনে বসতে দিয়া আমারে দোস্ত পেছনে দিল, আর আমি এখন দেখতে ক্যামুন মালিক হইয়া গ্যালাম?
হ, মামা ঠিকই কইছেন, আমগো মালিকেরা তো কোনো দিনও ড্রাইভারের পাশে বসে না।
জসিম নিজের মালিকপক্ষের কাছে নিজের পাকাপোক্ত অবস্থান প্রমাণ করার জন্য তাড়াতাড়ি বলে ওঠে-ঠিকই কইছস, তবে আমার মালিক আর সব মালিকদের মতো না, আমার মালিক মাঝেমইধ্যেই আমার পাশে বসে, হ্যার এইসব আজাইরা দেমাগ নাই, আসল বড়লোক বুঝলি না! হ্যায় কথা কইতে কইতে পেরাই-ই আমার সামনের ছিটে বসে। হ্যায় তো বুঝোস না, হাজার কোটি টাকার মালিক; কিন্তু দ্যাখলে মনে হইব আমার মামা-চাচা কেউ হইব, সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পিন্দে, মুখের মইধ্যে সারা দিন পান চাবায়, আর চুলে-দাঁড়িতে মেন্দি দিয়া লাল কইরা রাখে, খুব বেহেশতি বেহেশতি লাগে দ্যাখতে। য্যামোন আল্লায় টাকা দিছে তেমন দিছে একটা কলিজা। দ্যাখতাছস না, ক্যামনে আমার হাতে প্রাডোরে ছাইড়া দ্যায়। দুইডা-তিনডা প্রাডো হ্যার কাছে দুই-তিনডা রিশকার মতো।
ফ্যাক্টরিতে প্রবেশের পরেই ডান পাশে সারিবদ্ধ গাড়ির গ্যারেজের একটিতে জসিম গাড়ি রেখে আসে। ইসুব আর মতিন জসিমকে অনুসরণ করে বাসে উঠে বসে। এ অ্যান্ড কে ফ্যাক্টরি থেকে বাস পিকনিকের জন্য রওনা হলে ইসুবের জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা যোগ হয়। বিশাল সাইজের সাতটা এসি বাস ভরে শ্রমিকরা রওনা হলো পিকনিকের উদ্দেশে। এ অ্যান্ড কে ফ্যাশন আনন্দমেলা বড় বড় অক্ষরে লেখা বড় ব্যানার বাসের সামনে শক্ত করে টানানো। প্রত্যেক বাসে একজন করে লিডার। এই বাসের লিডার হলো জসিমউদ্দিন। এত্ত বড় দলের সঙ্গে এর আগে কোনো দিন পিকনিকে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি ইসুবের। ছয়-ছয়টা বাসভরা সবাই এই ফ্যাক্টরির শ্রমিক। এত শ্রমিক সকলে একসঙ্গে যাবে পিকনিকে! ইসুব ভেবে অবাক হয়, ইসুবের বুকের কাছে না জানি গলার গোড়ায় শ্বাসপ্রশ্বাস দাপাদাপি করে। জসিমের পাশে বসে সে নিজেকে জসিমের নিকটজন ভেবে অহংকারী হয়ে ওঠে। ওস্তাদ! এরা সবাই আপনের মালিকের কাম করে?
হ, হ, তাইলে আর কার? এত্তগুলা শ্রমিকের পিকনিকের খরচাও মালিক স্যারেই দিতাছে। তাও আইজ এক গ্রুপের পিকনিক, আর আগামী সপ্তাহে আরেক গ্রুপের। এই যে দ্যাখতাছস না, এইখানে দুইটা ফ্যাক্টরি। দুই ফ্যাক্টরিতে মালিকের দুই হাজার ওয়ার্কার কাম করে।
ইসুবের কল্পনার সীমা এত বিস্তৃত নয়, সে আর ভেবে কুলাতে পারে না। এবার সে বাসের ভেতরে ঘুরে ঘুরে তাকায়। তার বয়সী অনেক ছেলে। তবে ছেলেদের চাইতে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। কারো কথা কারো কানে প্রবেশ করে না, বাসের ভেতরে শুধু নয়, বাইরেও হিন্দি গানের দাপট। বাস চলতে শুরু হলে বাসের ভেতরে ইসুবের বয়সী একদল ছেলে নাচতে থাকে। ছেলেরা আগে শুরু করলেও খুব তাড়াতড়ি মেয়েদের দল ভারী হয়ে যায়। কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে ছেলেগুলার সঙ্গে তাল রেখে কোমর দুলিয়ে হিন্দি সিনেমার মতো করে নাচছে অনেক মেয়ে।
এই নাচ-গান ইসুবের সমস্ত চেতনা দখল করে। ইচ্ছা করে নাচে-গানে মত্ত ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে গান গাইতে। বাসভরা আনন্দবিহ্বল মানুষগুলার সবাইকে নিজের মনে হয়। কোনো দিন পিকনিকে যাওয়া হয়নি এমন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে। নাচার ইচ্ছা হলেও ইসুব ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে না। বাস এগিয়ে যায়। আশুলিয়া থেকে বের হয়ে গাজীপুর পার হয়ে শ্রীপুর পার হলে বিরাট বাগানবাড়ি মালিকের। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মালিকের বাগানবাড়ি। এক প্রান্তে দাঁড়ালে আরেক প্রান্ত দেখা যায় না।
শ্রমিকদের সবাইকে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হয় সিমেন্ট বাঁধানো হাঁটাপথে। বাগানবাড়ির পেছনে বিশাল দীঘি। দীঘি ভরা পদ্ম। কয়েকটা নানা আকার-আকৃতির নৌকা বাঁধা বাংলা সংস্কৃতির সাক্ষীস্বরূপ। নৌকার পাশেই স্পিডবোট। একদিকে ধানের ক্ষেত, এক পাশে শাল-সেগুনের বাগান, এক পাশে গরু-ছাগলের খামার, মুরগির খামার, পেয়ারা বাগান, সারিবদ্ধ নারিকেল-সুপারির বাগানবাড়ির সীমানা। ধানের গোলা, আর ঢেঁকিঘর প্রদর্শনী হচ্ছে তুলনামূলক উঁচু ভিটার ওপর। এখানে বছরে একদিন ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়। তবে বাগানবাড়ির পেছন দিকে। প্রধান ফটকের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা আলাদা রাস্তা। সেখান দিয়ে শ্রমিকদের সবাই এগিয়ে যায় সারিবদ্ধ।
আগে থেকেই পিকনিকে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয়েছে। বাসের ভেতরে নাচ-গানের সময় সবাইকে সকালের নাশতার প্যাকেট দেওয়া হয়। একটা কলা, ডিম সেদ্ধ আর বনরুটি। আর সেই সঙ্গে একটা করে পানির বোতল।
পিকনিকের সময় গার্মেন্টেসর অনেকগুলা মেয়ে জসিমের পাশে পাশে থাকে। এই মেয়েগুলার সঙ্গে জসিমের খুব খাতির। সারা দিন জসিম ওদের সঙ্গে একসঙ্গে খায়, গল্প করে, দীঘির পাশে বসে আড্ডা দেয়। ওদের ভেতরে কয়েকজনের সঙ্গে ইসুব ও মতিনেরও খাতির হয়। ময়না, বেবি, আয়শা-ওদের সঙ্গে ইসুবের খাতির হয়। মোবাইল নম্বর বিনিময় হয়। এই মেয়েগুলাকে ইসুবের খুব ভালো লাগে। মেয়েগুলা খুব বুদ্ধিমতী মনে হয়। ওরা একটাও মাইনষের বাসায় কাজের বুয়ার কাম করে না। ওদের আত্মসম্মান বইলা ব্যাপারটা আছে। সারা দিন কথায় কথায় অরা অনেকবার এই কথাটা বলে। ওরা ইসুবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে নাটকে দেখা শহরের বুদ্ধিমতী মেয়েদের মতো কথা বলে।
এই মেয়েগুলা আসলে জসিমকে খুব পছন্দ করে, সেইটা ওদের কথাবার্তায় বেশ উপলব্ধি করতে পারে ইসুব। মেয়েগুলার মধ্যে কয়েকজন মতিন ও ইসুবের সঙ্গেও খুব হাসি-মশকারা করে কথা বলে। ওদের কথা বলার ঢংও ইসুবের ভালো লাগে। গ্রামে দেখা মেয়েগুলার থেকে এই মেয়েরা আলাদা। ওরা পিকনিকের আনন্দ হইচইয়ের ভেতরেও নিজেদের আন্দোলনের কথা বলে। মিছিলের কথা বলে। ওরা মিছিল এবং ইউনিয়ন ইউনিয়ন কী জানি কথাবার্তা আলাপ করে। ওরা মালিকের নির্বাচনের কথাও আলোচনা করে। তখন নিজেকে ইসুবের খুব অপাঙক্তেয় ও বেকুব বেকুব মনে হয়। ওর তখন মনে হয়, এখনো সে এই ঢাকা শহরের যোগ্য হয়ে ওঠেনি। যেদিন সে জসিম ওস্তাদের মতো একটা পাডো গাড়ি চালানির মতো ডেরাইভার হবে, সেদিন সে এই মেয়েগুলার যোগ্য হবে।
এই যাত্রায় রক্ষা
সকালেই দ্বিধা-সংকোচ পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় ইসুব। গতকাল সারা দিন সে মোবাইল ফোন অফ করে রেখেছে। রাতে পিকনিক থেকে বাড়ি ফিরে দেখে সতেরোবার মিসকল খালাম্মা ম্যাডামের। বিচলিত বোধ করে রাতেই। না জানি কাল সকালে কত গালমন্দ আছে কপালে! দরজার ওপরে কলবেলে চাপ দিতে বুক দুরুদুরু করে। কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মনে মনে সে বাক্য গঠন করে খালাম্মা ম্যাডামকে কারণ দর্শানোর। কতটা বেগতিক ছিল বমি ও পায়খানা, যমের সঙ্গে কিভাবে যুদ্ধ করে সে ফিরে এসেছে, সেসব আওড়ায় কয়েকবার। তারপর দরজার কলবেলের বুকে ভীরু আঙুলে চাপ দেয়।
হাসতে হাসতে আলো দরজা খুলে দেয় কয়েক সেকেন্ডের মাথায়। দরজা খুলে হাসিমুখে দাঁড়ায় আলো-কী, কাইল কী হইছিল? আপনে নাকি হাগতে ছিলেন? কী, কয়বার গ্যাছেন হাগতে? প্যান্ট, লুঙ্গি বিছানা এগুলি খারাপ করেন নাই তো? হিহিহি… হি…হিহিহি… হাতের তালু দিয়ে হাসি বাধা দিতে চেষ্টা করে আলো।
আলোর ঠাট্টায় বুকের ওপর থেকে ভারী একটা পাথর যেন গড়িয়ে যায় পর্বতশৃঙ্গ থেকে একেবারে গিরিখাদে। দীর্ঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চোরের মতো ভেতরের দিকে উঁকি দিয়ে এবার ইসুব বলে-ওই ফাজিল, লাগে য্যান তুই হাগোছ না? তর কোনো দিন প্যাট খারাপ হয় নাই?
যান, ভাগেন; আমি কি আপনার মতো উল্টাসিদা খাই নাকি? কী খাইছিলেন? হাতি না ঘোড়া? হিহিহি… হিহিহি…
কী ব্যাপার, সকাল সকাল খুব ফুর্তিতে আছস? কি, আজরাইলে বাড়িতে নাই? ইসুবের এই মন্তব্যে এবার চোরের মতো আলো ভেতরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বলে-কাইল আপনারে পাইলে খাইয়া ফ্যালাইত নানু, কই গ্যাছিলেন? আপনে নাকি বাড়িতে আছিলেন না? আসলে কন তো, লাইন মারতে গ্যাছিলেন?
হ, তর লগে, তরে নিয়া গ্যাছিলাম না ফ্যান্টাসি কিংডমে, আর বাঁচলাম না! যাহ… ফাজিল ছেমড়ি। আমারে দ্যাখলেই খালি ফাইজলামি করতে মন চায়, না?
আরে আমার কথা না, নানুয়ে তো আপনার বাসায় মোস্তাফা নানারে পাঠাইছিল, হ্যায় আইয়া কইছে আপনে বাসায় আছিলেন না। এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে মুহূর্তের মতো বিহ্বল হয়ে পড়ে। এই মোস্তাফা মিয়াই আজকের চাকরির সন্ধানদাতা। জসিমের সম্পর্কে মামা। জসিম মোস্তাফা মামাকে একটা কামের খোঁজ দিতে বললে সে-ই এই চাকরির খোঁজ দেয়।
ইসুব ভাবে, কী ডেনজারাস রে বাব্বা! কী রকম চিকন বুদ্ধি রাখে এই মহিলা, বাপ রে বাপ! ক্যামনে হ্যার মাথায় আইল বাড়ি পর্যন্ত খোঁজ লাগানির কথা। কথাটা কয় আসলেও ঠিক, স্যায় নিজে নিজের কথা কয়-আমি হইলাম র্যাবের বাবা, বুঝলি, আমার লগে চালাকি কইরা পারবি না, কত হাতি ঘোড়ায় গ্যালো তল, আর তুই তো দুই নম্বরি লাইসেন্সের দুই নম্বরি ড্রাইভার।
এ সময়ে ভেতর থেকে খালুজানের কণ্ঠস্বর শোনা যায়-আলো, কার সঙ্গে কথা কস? ড্রাইভার আসছে নাকি?
জি নানা, ইসুব ভাইয়ে আইছে, চাবি লইতাম বলি, নানু কইছে বলি ইসুব ভাই আইলে চাবি দিতে।
হ্যাঁ, হাঁ দিয়া আস, আসি চা দিই যা। ভেতর থেকে অনুমতি পেয়ে আলো ইসুবের সামনে চাবি দুলিয়ে দুষ্টামি করে। আপনের কিন্তু খবর আছে, ইসুব সাহেব ঠিক হই যান।
যা ছেমড়ি, ফাইজলামি করিছ না। চাবি নিয়ে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি বেয়ে নামে ইসুব। এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করে না।
নতুন গল্প
আজ ইসুব খুব সতর্ক থাকে, গাড়িতে ওঠে। যত তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে পৌঁছানো যায় ম্যাডাম আপার বাড়িতে। গতকাল ম্যাডাম আপা বলেছিল, সে যেন আজ যেমন করে হউক নয়টার ভেতরে পৌঁছায়। রাস্তা ফাঁকা পেলে টেলিভিশনে দেখা রেসিং কারের মতো ছুটতে চায়। মহাখালী ফ্লাইওভার থেকে বের হয়ে সে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয় প্রায় এক শ। ভাগ্য যেন সকাল থেকে আজ বেশ সুপ্রসন্ন। সকাল সকাল খালাম্মা ম্যাডামের গালি খাইতে হইল না। আবার রাস্তাও ফাঁকা। তখন ওর মনে পড়ে, আজ তো শনিবার। সরকারি সাপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিন। কাইল তো শুক্রবার আছিল।
নিচে পৌঁছানোর আগেই সে রেলগেটের কাছ থেকে ফোন দেয়-আপা, আমি আইসা গ্যাছি যে। সে জানে, ম্যাডাম আপা নামছি বলার পরও আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা লাগে। তবে সব দিন না, মাঝে মাঝে একেবারে নিচে নেমে এসেও দাঁড়ায়ে থাকে। এই মহিলাডার এই জিনিসটা ধরা খুব কঠিন লাগে ইসুবের কাছে। দুই মাস হইয়া গ্যালো, দুই মহিলারে সে সারা দিন ডিউটি দিতাছে। আল্লায় কত কিছিমের মাইয়া মানুষ যে তৈরি করছে।
গাড়ি পার্কিংয়ে পার্ক করে সে নতুন ভাবনায় আক্রান্ত হয়। সকালবেলাটায় কোনো রকমে আল্লায় বাঁচায়ে দিল। কিন্তু রাইতরে? রাইতরে কী কইবে সে খালাম্মা ম্যাডামরে? হঠাৎ তার মাথায় দ্রুত বুদ্ধি খেলে যায়। সে বাড়িতে ছিল না, জসিম তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন বোধ হয় মোস্তাফা মামায় গেছিল। একসিলেনট নতুন ইংরেজিটা সে গতকালই শিখেছে পিকনিকে গিয়ে। নিজের বুদ্ধিতে সে নিজেই গর্ববোধ করে!
হঠাৎ সে তাকিয়ে দেখে, এলিভেটরের সামনে দিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে ম্যাডাম আপা, সঙ্গে মেরুনা। মেরুনার হাতে দুইটা ব্যাগ। দেখা মাত্র ইসুব প্রায় দৌড়ে আসে ম্যাডামের কাছে, হাত বাড়িয়ে দেয় মেরুনার হাত থেকে ব্যাগ দুটো নেওয়ার জন্য।
গাড়িতে দ্রুত বসে ম্যাডাম আপা মেরুনার উদ্দেশে বলে-তুই সামনে বস মেরুনা, দিলু আপাকে ওঠাতে হবে বনানী থেকে। ওনাকে ধানমণ্ডিতে নামাতে হবে। ড্রাইভিং সিটের পাশের ছিটে মেরুনা বসায় ইসুব মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে ম্যাডাম আপা বলে, বনানী থেকে খালাম্মা ম্যাডামকে উঠাতে হবে-দুশ্চিন্তা তোলপাড় করতে থাকে ইসুবের ভেতরটায়। খালাম্মা মহিলাটা সব সময় বলে, কেউ তার সঙ্গে সত্য বলল নাকি মিথ্যা বলল সেইটা সে পরের ওয়াক্তের নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে চোখ বন্ধ করলেই ধরতে পারে।
খালাম্মা ম্যাডামের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর পূর্বেই গাড়ি থেকে ম্যাডাম আপা ফোন দিয়ে বলে-দিলু আপা নামেন, আমি এসে গেছি।
বাতাস বের হওয়া বেলুনের মতো চুপসে যায় ইসুব খালাম্মাকে দেখা মাত্র। শুরু করে মনে মনে দোয়াদরুদ পড়া। কিন্তু দোয়াদরুদে বিশেষ কাজ হয় না। দিলরুবা বেগম গাড়িতে উঠেই শুরু করে তার ঝাঁজালো প্রশ্ন-কী রে, তুই কাইল কই গেছিলি?
বদান্যতা প্রকাশের স্থায়ী ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে বলে-কাইল তো আমার ডায়রিয়া হইছিল, তাই আইতে পারি নাই।
চোপ মিথ্যুক, আমি মনে করোস বই আছিলাম? তুই যদি হাগতে হাগতে মরতে আছিলি তাইলে বাইরে গেলি ক্যামনে?
আমারে তো হাসপাতালে নিয়া গেছিল আমার বসে।
বস মানে? তুই বস পাইলি কই? তর বস তো আমি!
না, না, হেই বস না, আমারে যে ভাইয়ে ঢাকা শহরে আহনের বুদ্ধি দিছে, ডেরাইভারি শিখাইছে, বাসায় থাকতে দিছে, হ্যারে আমি বস ডাকি।
ওহ, তাইলে তোমার তো দেখি অনেক বস। হুতা কাট…, হুন কাইল মিছা কথা কইছস ক্যান? কই গেছিলি? কাইল যদি তর ডায়রিয়া হয় আইজ তুই কামে আইলি ক্যামনে? তর চেহারাসুরত দেখি তো মনে হইতাছে না তর কাইল এত্ত খারাপ ডায়রিয়া হইছিল!
আমি তো সারা দিন কাইল ঘুমাইছি। ওষুধ খাওনের পর তো সারা দিন খালি ঘুমাইলাম।
হুন, এরই, আমি কিন্তু সব হিসাব রাইখতেছি, ব্যাতনের সময় সব হিসাব বাইর হইব, তুই মনে কইরছত তর চালাকি আমি বুঝুম না, আর এমনে এমনেই ব্যাতনের টাকা গুনি দিমু।
ইসুব খালাম্মার এই সব কথার কোনো উত্তর দেয় না, গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের ওপর হাত রেখে মনে মনে ভাবে, মাস শ্যাষ হইয়া আসতেছে, পেতি্নর পেতি্ন বেডি কি জানি ঝামেলা পাকায়।
পাশে চুপচাপ মেরুনা বসে থাকলেও ওর ঠোঁটের কোনায় মনে হয় দুষ্টামি মাখা হাসি। এরই মাঝে ডাইনে বাঁয়ে দেখার ফাঁকে সে কয়েকবারই মেরুনার মুখের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনেছে। খালাম্মার ওপরের রাগ-ক্রোধ-ক্ষোভ এবার মেরুনার ওপর যেয়ে পড়ে। ছেড়ির হাসির কী আছে! তুই তো গাড়িতে বইসা লাগে যেন ব্যাগম সাহেব হইছে। তর চাইতে সুন্দরী গার্মেন্টের কত মাইয়া এখন আমার লগে লাইন মারার জন্য খাড়ায়া আছে।
দিলরুবা আপার বকাঝকা কমানোর জন্য সোমা আক্তার প্রসঙ্গ বদলায়। সে দিলরুবা আহমেদের বকাঝকা প্রসঙ্গে কোনো উত্তর না দিয়ে বলে-আপা, আমি একটু কেনাকাটা করতে যাচ্ছি, আপনি যাবেন আমার সঙ্গে? সময়ই করতে পারছি না, আজ শনিবার হাতে একটু সময় আছে, রাস্তাতেও জ্যাম একটু কম, তাই মেরুনার জন্য কিছু কেনাকাটা করব। ঈদ তো এসে যাচ্ছে। আমি আবার ঈদের ভিড় সহ্য করতে পারি না। তাই আজই ওর জন্য কয়েকটা সুন্দর সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ট কিনব, সেই সঙ্গে সেন্ডেল, এই চুড়িদারি যা যা লাগে।
কই যাইবা? ভাবছি ইস্টার্ন প্লাজাতেই যাব, কারণ আমার একটু বাজার দরকার। মেরুনা নাকি কোনো দিন বসুন্ধরা সিটি দেখে নাই, সেইটা আরেক দিন দেখাব। ইস্টার্ন থেকে ওর কেনাকাটাগুলা শেষ করে হাতিরপুল বাজার থেকে বাজার করব। তারপর আমাকে যেতে হবে লালবাগ।
লালবাগে কী?
আমার একটা কাজ আছে লালবাগে।
আমি যতক্ষণ ইস্টার্ন প্লাজায় কেনাকাটা করব, ততক্ষণে আপনাকে বাসায় নামায়ে দিয়ে আসতে পারবে।
চলো, আমি যাইতো পারি। অসুবিধা নাই, তবে কই কী বেশি কেনাকাটা করিও না, মেরুনার মায়ে ওর বিয়া দেওনের জন্য উঠিপড়ি লাইগছে। সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ট-এসব কিনি টাকা-পয়সা নষ্ট না করি সেগুলি একবারে দিয়ো হ্যার বিয়ার সময়, কামে লাইগব।
আপা ওর বয়স তো মাত্র চৌদ্দ, এখনই ওর কী বিয়ে দেবে?
আরে, গরিবের মাইয়া চৌদ্দ-পনেরোতে বিয়া না দিলে পরে বিয়া হইতে চায় না।
অসম্ভব! আপনি ওর মাকে বলে দেন, এখন সে মেরুনার বিয়ে দিতে পারবে না। আমি মেরুনাকে পালব। ওকে পড়ানোর জন্য পাশের বাসার ভাবিকে রেখে দিয়েছি। পড়াশোনা করিয়ে দেখেশুনে আমি ওর বিয়ে দেব, ঠিক যখন বিয়ের বয়স হবে তখন। এখন থেকে মেরুনার সব দায়িত্ব আমার। ওকে বিয়ে দেওয়ার আগে আমি ওকে পড়াশোনা শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখাব।
কামের ছেড়িগোরে টোপ দেওনের জন্য অনেকেই এসব কয়, করি দ্যাখাও, তার পরে কইয়ো।
আমি টোপ দেওয়ার জন্য এসব বলছি না আপা। আমি কোনো রকম অপ্রয়োজনীয় কথা বা কাজ করা পছন্দ করি না।
আহা রে, রাগো ক্যান? তোমার যখন কোনো পোলাপান নাই, স্বামীর লগেও থাকো না, তখন তোমার যদি মন চায় একটা পোলাপান মানুষ করতে তাইলে আমারে কও আমি তোমারে সুন্দর ফুটফুটা দেইখা একটা এতিম মাইয়া আনি দেই। তুমি হ্যারে লেখিপড়ি পালক লই মানুষ করো। মেরুনারে কিয়ের পাইলবা? ছেড়ি অন যুবতী হই গ্যাছে, দেইখতে-শুইনতেও ভালা না, কালা বাডি, মডি-এইটারে সঙ্গে লই ঘুইরতে বলিও তো ভালা লাইগব না তোমার!
আপা আমার সুন্দরী মেয়ে পালার দরকার নেই। আমি মেরুনার মতো একটা মেয়েকেই পালতে চাই। যখন আমি ওর নামে টাকা-পয়সা, জমি লিখে দেব, তখন সেই সবের জন্য মেরুনা এমনিতেই সুন্দরী হয়ে যাবে। আসলে সুন্দরী মেয়েদের তো সবাই পালতে চায়; কিন্তু যারা বাডি, খাডি তাদের তো কেউ কেউ ভালোবাসবে, যত্ন করবে। কী বলেন? মেরুনাকে তাই আমিই রাখব, আর কোথাও যাবে না মেরুনা।
কদু মার্কা ও কদু
থেমে গেল একেবারে। আর এগোচ্ছে না। ঢাকা শহরে এ মাসের পুরোটা এমন যাবে। মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায় ঢাকা শহর মুখরিত। শহরের আনাচ-কানাচ, গলিঘুপচি-সর্বত্র এখন মিছিল, মিটিং, পথসভা। এবার নির্বাচনী প্রচারণায় আরো যোগ হয়েছে কান্ধসভা। ভবিষ্যৎ নগর পিতারা এবার নগরসন্তানদের কাঁধে উঠেও বক্তৃতা করছে। এই অভিনব উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় এখন ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচেও মিটিং হচ্ছে। শ্যামলী রোডে, লিংক রোডে প্রবেশ করেছে। রাস্তাটা একেবারে শেষ মাথায় যাওয়ার পর এমন সরু হয়ে যায়, সেখানে একটা রিকশা প্রবেশের উপায় থাকে না। হঠাৎ গাড়ি থেকে দেখা গেল, বিশাল মিছিল আসছে।
মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের কণ্ঠ সোচ্চার, চারপাশে ধ্বনিত হচ্ছে-তোমার পিতা আমার পিতা নগরপিতা, নগরপিতা। মিছিলের মাঝখানে পড়ে সোমা আক্তার ভয়ে কুঁকড়ে যায়। কী হতে কী হয়ে যায়! মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে কেউ গাড়ির গায়ে লাথি মারে, কেউ হাত দিয়ে কিল মারে, গুঁতা দেয়, থাপ্পড় দেয় চটাং চটাং।
ভয়ে ইসুব প্রায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে-ম্যাডাম আপা আমি কি করুম এখন? কোন দিকে যামু?
কোথাও না, একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। একটুও আগাইস না, মিছিলের পোলাপানরা কিন্তু ভয়ানক খ্যাপা থাকে। মাইরা লম্বা কইরা দেবে।
তিন ঘণ্টা আজ মিছিলের জ্যামে আটকে বসে থাকে। মিছিল হালকা হওয়ার পর ধীরে ধীরে গাড়িগুলো এগোতে থাকে। আজ আর সামছুলের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। যেভাবে মিছিল আটকে গেছে গলির এই মাথায়, সারা দিন লাগবে মিছিল সৃষ্ট যানজট খুলতে। এখানে মিটিং হবে কোথায়। ইসুবের ভেতরে দৃষ্টি ফেলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন যুবকের কাঁধের ওপরে ভবিষ্যৎ নগরপিতা চড়ে বসে। তাকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যুবকেরা। নগরপিতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সেই অবস্থাতেই বক্তৃতা দেওয়া শুরু করে। অতি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা-ভাইসব! আমি আপনাদের সেবায় প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দিয়ে দেব, আপনারা আপনাদের যোগ্য প্রার্থী বেছে নেন, আমি, একমাত্র আমিই আপনাদের যোগ্য নগরপিতা হতে পারি। এই বক্তৃতার কিছুর প্রতিই ইসুবের আগ্রহ নেই, ইসুব বসে থাকার এই সময়ে জানতে চায়-আপা গান শুনবেন?
এই সময়ে ইসুবের মোবাইল বেজে ওঠে-ইসুব ঘুরে ম্যাডাম আপার দিকে তাকিয়ে বলে, আমার মায়ে ফোন করছে, কদ্দুর কথা কইতে পারি আপা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল, আমি তোকে গাড়ি চালানির সময় কথা বলতে নিষেধ করেছি। কিন্তু তাই বলে তোর মার সঙ্গে তো কথা বলতে নিষেধ করিনি, যা যা, কথা বল-
হ, কও মা, না রে মা, আইজ এখন তো মিছিলের মইধ্যে আটকাইয়া আছি। হ, না, না, এখনো তো ব্যাতন দেয় নাই, আইজ তো সবে মাসটা শ্যাষ হইল, কাইল-পরশু দিব মনে হয়। আমি কাইল সকালে চামুনে, আইচ্ছা, আমার কাছে কয় দিনের খাওনের টাকা জমছে, সাত শ টাকা জমছে, আমি পাঠাইয়া দিমুনে বিকাশ কইরা। তুই রাখ, সন্ধ্যার সময় আমি বিকাশ কইরা তরে ফোন দিমুনে।
মায়ের সঙ্গে কথা শেষ করে হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে ইসুব লাফিয়ে নামে গাড়ি থেকে। সোমা আক্তার কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে এগিয়ে যায়। কয়েক গজের মাথায় একটা মিনি ট্রাক। লতাসহ তাজা কদু দিয়ে সাজানো হয়েছে মিনি ট্রাকটা। একেবারে দৌড়ে সে ট্রাকটার কাছে চলে যায়। লাফ দিয়ে টেনে ধরে কদুর লতা। টেনে নামিয়ে নেয় দুটো কদু। দুই হাতে দুইটা কদু নাচাতে নাচাতে ইসুব ফিরে আসে।
এই এইটা কি করলি তুই ইসুব? এমন কইরা তুই ওদের গাড়ি থেইকা লাউ পাইড়া আনতে গেলি ক্যান? এখন যদি তোকে ধরে ওরা মাইর দিত তো কী করতি?
দুইটা কদুর জন্য বুঝি আমারে মারব? এগুলি তো গেরামে গরুতেও ঠিকমতো খায় না। আমগো গেরামে এত্ত কদু হয় বুঝলেন ম্যাডাম আপা, যখন খাইয়া শেষ করা যায় না, ঠিকমতো বেচাবিক্রি হয় না, তখন কত কদু যে গরুরে খাওয়ায়। আর এই ঢাকা শহরে কদুর কত্ত দাম!
ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ ভিড়ের ভেতর থেকে কয়েকটি ছেলে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরে ওদের গাড়ি। ইসুব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা টান দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ফেলে-এই হালার পুত কদু লতা ধইরা টান দিছস ক্যান? আমগো লগে লাগতে আইছস, খানকির পোলা, তগো নৌকা ধইরা আমরা টানি?
একটা কদু পইড়া যাইতে আছিল, হ্যার লাইগা ভাবলাম মাটিতে পইড়া নষ্ট হইয়া যাইব, তার থেইকা আমি নিলে কামে লাগব, পাকাইয়া খাইলে কামে লাগব।
এই খানকির পোলা কী ভাবলি? তর বাপের কিনা কদু? মুহূর্তে কয়েকজন ছেলে চড়াও হয় ইসুবের ওপর। ইসুবকে টেনে নামিয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। গাড়ির ভেতরে বসে সোমা আক্তার বুঝে উঠতে পারে না, তার এখন কী করা উচিত। উঠতি বয়সের উদ্ধত আচরণের ছেলেগুলা হয়তো মানসম্মানের তোয়াক্কা করে না; কিন্তু সোমা আক্তার! কয়েক মিনিটে ইসুবের ওপর মাইরের পরিমাণ বাড়তে থাকে। মারতে মারতে ওকে রাস্তার ওপর শুইয়ে ফেলেছে এখন।
এবার সোমা আক্তার গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায়। এই ছেলেরা থামো, থামো চিৎকার করে ডাক দেয় সোমা আক্তার। দুই হাত দুই দিকে তোলে। সোমা আক্তারের কথা কারো কানে প্রবেশ করে না। সোমা আক্তার অসহায়ের মতো এবার একেবারে ইসুবের শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েকজন যুবকের দিকে তাকিয়ে অনুনয় করে। আপনারা বিশ্বাস করেন, ও কোনো দল করে না। আমার গাড়ি চালায়, আমরা জ্যামে বসে ছিলাম। একটা কদু ট্রাকের পেছনে পড়ে গেলে ও সেটা দেখে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে এসে কদুটা তুলে নেয়।
একটা কদুর জন্য আপনারা একটা গরিব ছেলেকে এভাবে মারতে পারতেছেন?
সোমার চিৎকার বা কথা মিছিলকারীদের ভেতরে কানে প্রবেশ করে না। তারা উল্লাস করে পেটায়। মনে হয়, এও নির্বাচনী প্রচারণার ধরন। এবার সোমা রাস্তার ওপর জমে থাকা উৎসুক মানুষদের প্রতি আবেদন জানায়। আপনারা প্লিজ হেলপ করেন, ওকে মারা থামান। কয়েকজন পথচারী এবার সোমা আক্তারের কথায় মনে হলো হারানো সংবিত ফিরে পেল। তারা ইসুবকে টেনে তুলে গাড়ির উদ্দেশ্যে পিঠে ঠেলা দিয়ে বলে-যা, গাধা, ভোদাই কোথাকার, যা ভাগ।
ইসুব হাতের পিঠে চোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে এসে বসে।
সোমা আক্তার কী বলবে ভাষা খুঁজে পায় না। শুধু বলে-যা, যা হওয়ার হইছে, দ্যাখ তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার চেষ্টা কর।
রোজিনা
ওভার ডিউটি শেষ করে ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে আসতে রোজিনার রাত প্রায় এগারোটা বেজে যায়। ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে রোজিনা এসে নিউ ফখরুদ্দিন ভাই বিরিয়ানি অ্যান্ড মোরগ পোলাও রেস্টুরেন্টে এসে অপেক্ষা করবে। ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি পপুলার হওয়ার পর এই রেস্টুরেন্টে রোজিনার সঙ্গে দেখা করতে পয়সা খরচা করতে হয় না। চা-বিস্কুট থেকে মোরগ পোলাও পর্যন্ত সব কিছুর বিল রোজিনা দিয়ে দ্যায়। আর হাসতে হাসতে বলে-হিসাব রাখিছ, কত খাইলি। আজ ইসুবের পকেটে কয়েক দিনের লাঞ্চের টাকা জমেছে। দুই প্যাকেট মোরগ পোলাও আর নইলে কাচ্চি বিরিয়ানি কেনাই তো যায়। কিন্তু তাইলে লগে লগে সব টাকা শ্যাষ। তখন ওর মনে পড়ে মায়ের ফোনের কথা। থাউক তার চাইতে রোজিনারটা খাওয়াই ভালা। কিন্তু প্রেম করতে গেলে একটু আধটু খরচা তো করতে লাগবোই। তা না হইলে তো ছেমড়ি আবার আরেকটার লগে লাইন মাইরা যাইব গা।
রোজিনার সঙ্গে পরিচয় হাঁটতে হাঁটতে। তখনো ম্যাডামদের এই গাড়ির চাকরি হয় নাই। জসিম ভাই বলল-ইসুব কাম পাস আর না পাস, রোজ সকালে উইঠা গোসলটোসল কইরা বাসা থেইকা বাইর হইয়া রাস্তায় রাস্তায় আজাইরা হাঁটবি। হাঁইটা হাঁইটা ঢাকা শহরের হাবভাব শিখবি। তরে তো দেখতে গ্যারাইম্মা গ্যারাইম্মা লাগে। শরীল থেইকা গ্যারাইম্মা, গ্যারাইম্মা ভাবখানা না সরাইলে চাকরি পাইবি না। এই ঢাকা শহরে গাড়ির মালিকগো নাক অনেক উঁচা। ড্রাইভার রাখনের সময় ইন্টারভিউ লয়। মাথা থেইকা পাও পর্যন্ত খুঁডাইয়া খুঁডাইয়া চেক করে, তার পরে কি না এপনমেন্ট দেয়।
ঢাকা শহর চেনার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে বহুদূর চলে যায়। দোকানের সামনে থামে। তেজগাঁওয়ের কত ফ্যাক্টরি, কত অপিস। সব কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে সে শহুরে হওয়ার প্রয়াস চালায়। সেদিন মডার্ন এপারেলের সামনে দাঁড়ায়। লাইন দিয়ে গারমেনটের মাইয়ারা যায়। সে রাস্তার উল্টা পাশ থিকা দাঁড়ায়ে দ্যাখে। দুপুরে হ্যারা লাঞ্চ বেরেকে বাইর হয়। তখন একদিন রোজিনার সঙ্গে পরিচয়। রোজিনাই জিগাইছিল আগে, কী কাম খুঁজোস?
না, আমি ডেরাইভারি করি। গারমেনটের কাম খুঁজি না। এখন অফ আছি, কাম নাই, হাঁটতে বাইর হইছিলাম।
আমি সকালে গরম ভাত খাইয়া বাইর হই, তাই দুপুরে খালি এক কাপ চা খাই, চল যাই চা খাই। রোজিনা চা কেনে, ইসুব চা নিতে ইতস্তত করে। রোজিনা বুঝতে পারে, আরে বুজছি ল, খা, আমি দিমুনে তর চায়ের দাম। সেই শুরু। তারপর দুপুর থেকে বহু দিন রাতে, কাজের শেষে রোজিনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। বেতন পেয়ে রোজিনা এক শ-দু শ টাকা দিয়েছে পকেটে গুঁজে। রোজিনার সঙ্গে এভাবে প্রেম হয়। রোজিনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় ইসুব।
খিলখিল করে হাসে রোজিনা, হাসতে হাসতে বলে-বোকায় চুদছে নাকি? প্রেম হইল আর লগে লগে বিয়া বইতে পাগল হইয়া গ্যালাম। খাড়া, মন ভইরা পেরেম কইরা লই। তর মতলব টতলব বুইঝা লই। গারমেন্টে কাম করতে করতে আমরাও অনেক চালাক হইয়া যাই বুঝলি? লাত্থি-গুঁতা তো কম খাইতে হয় না। যেই ছেমড়ি যত বেশি লাত্থি-গুঁতা খাইয়া বড় হয়, সেই ছেমড়ি তত বেশি হারামিগুলারে চিনতে পারে।
তাইলে তুই আমারে বিয়া করবি না? আমারে হারামজাদাগো দলে ফালাইয়া দিলি?
করুম না যে এইটা তো কই নাই একবারও! তবে তরে আমি পরীক্ষার তলে রাখুম। দেখুম তুই সত্যই আমারে ভালোবাসোস, নাকি মধু খাইয়া যাবি গা। যদি বুঝি তুই খালি মধু খাওনের মতলবে আইছস, তাইলে তর মুখের মইধ্যে বিষ দিয়া তর বেইমানির বারোডা বাজাইয়া দিমু। হিহিহি… হাসে রোজিনা।
রোজিনার কথায় টাসকি লাইগা যায়। বাব্বারে বাবা, ছেমড়ি এত্ত চালাক। এই কয় মাসে কত্ত কথা হইল; কিন্তু বোমা মারলেও প্যাটের থেইকা আসল কথাটা বাইর করা যায় না। কত দিন কত রকমের মিঠা কথা কইতে কইতে কত টাকা জমছে এই কথাটা বাইর করতে। শালী শোইল-বাইমের মতো পিছলা, জিগানির লগে লগে সুরুৎ কইরা পিছলাইয়া যায়, আর নাইলে এক্কেবারে সাপের মতো ফস্ … ক্যান, এইডা জিগাস ক্যান? আমারে ভালোবাসোস না আমার টাকারে?
আজ ইসুবের ইচ্ছা হয় না রোজিনার সামনে আসতে। কিন্তু আসতেই হয়। কাজে জয়েন করার পর থেকে আজ পর্যন্ত আর দেখা করতে পারেনি।
ইসুবের চেহারায় দৃষ্টি পড়তেই খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে রোজিনা। হাসতে হাসতে বলে-কী রে, তর চেহারা পাল্টাইয়া দিছে কে রে? ইস্! দিছে তো আইচ্ছা মতো বানানি, কার লগে গেছিলি মাস্তানি করতে?
ইসুব ভেবেছিল, ওর চেহারার এই অবস্থা দেখে রোজিনা দুঃখে কাতর হয়ে কাইনদা ফালাইবে। মন খারাপ কইরা বলবে-ইসুব! কে তোমারে এমন করে মারল? চলো এক্ষুনি চলো, তোমার জন্য ক্রিম কিনে আনি ওষুধের দোকান থেইকা আমি তোমারে ব্যথা লাঘবের মলম কিনা দিই।
সিনেমার নায়িকারা কত সুন্দর করে নায়ককে আদর করে মাইরপিট কইরা ব্যথা পাইলে। সেইটা নাই-ইহ, খানকির ঝি খানকি কি না হাসে, খানকি গো মতো হাসতে হাসতে গড়ায়ে পড়ে। পরান ভরে হাসার পর সে সামনে দাঁড়ানো আক্কাসকে বলে-দ্যাখ মাস্তানি করতে গ্যাছিল কদুর লগে, মাইনষের লগে না। গায়ে নাই এক কেজি মাংস আবার যায় মাস্তানি করতে, আক্কল হইছে, আর কোনো দিন যাইবি না, হুন আমার সুপারভাইজারে সব সময় কয় খানার আগে আর মাইরের পরে… এইটা হইলো বুদ্ধিমানের ফর্মুলা। আর তরে আমি যত্ত দিন দ্যাখছি সব করছ উল্টা, তুই আহোস খানার পরে, এই যে ডেকচির পোলাও এখন তলানিতে, এখন তুই আইলি, আর যখনই মাইরপিট লাগে তুই ট্যাংরা মাছ, যাস সবার আগে লাফাইয়া।
এত্ত বড় বেইজ্জতির কথা। খাড়া, যত্ত দিন লাগে তর লগে প্রেম করুম, তর লগে অভিনয় কইরাই যামু। আমি তরে কাজের ঘর পর্যন্ত নিয়া ছাড়ুম, তারপর দেখবি ইসুব মাস্তান কারে কয়। আমার লগে ইয়ার্কি মারোন সেই দিন বুঝবি। ইসুব এই সব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সাবধানে সিগারেটের আগুনটার ওপরে নখের টোকা দিয়ে দিয়ে ছাই ফেলে।
খেপা কুকুরেরা ভালো ম্যাডাম
পাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাওয়ায় গালিতে চামড়া মোটা হইয়া যাইব।
আজও সন্ধ্যার আগে এসে পৌঁছতে হলো খালাম্মার বাড়িতে। এখানে আসতে হয় বলে মনে মনে সে নিজের ভাগ্যটাকে গালি দেয়। রাস্তায় জ্যামে বসে থাকতে থাকতে যখন সে খালাম্মা ম্যাডামের বাড়ি এসে পৌঁছে, তখন রাত প্রায় আটটা ঘড়িতে। খালাম্মা ম্যাডাম তার মেয়ে ও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নামে। খালাম্মা ম্যাডামের মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইসুবের চোখে শরম লাগে। বোরকা পরা খালাম্মার সঙ্গে তার মেয়েটাকে আর ছেলেটাকে দেখলে মনে হয় বিদ্যাশ থেইকা আইছে সবে মাত্র। মোটাগোটা ছোটখাটো একটা হাতির বাচ্চার মতো মেয়েটা। মনে মনে বলে, আল্লা না জানি কয়জনের খাওন একটা খায় এই হাতির বাচ্চাডা। সে একটুখানি পর পর দৃষ্টি ঘুরিয়ে মেয়েটাকে দেখে অবাক বিস্ময়ে। মেয়েটার পরনে চামড়ার মতো টাইট পায়জামা। ওপরে গেঞ্জিটাও এত্ত টাইট, বুকের দিকে চোখ পড়লে মনে হয় ব্রেসিয়ার পইরা খাড়াইয়া আছে। খালাম্মা ম্যাডাম তার এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইসুবের তখন মনে পড়ে মেরুনা সম্পর্কে সেদিন তার মন্তব্য-মেরুনা যদি বাডি, খাডি, কালা হয় তাইলে তার মাইয়াডা কী? তার মাইয়াডা যে বাডি, খাডি, হাত্তি… বলে একা একাই মুখ টিপে হাসে।
এ সময় ইসুবের মোবাইল বেজে ওঠে-লাইলাহা ইল্লাল্লাহ…। ইসুব হ্যালো বললে ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠ-হ্যালো তুমি কোথায়? একটা ফোন দাও না, আমি তোমাকে কতবার ফোন দিই বলো তো?
আমি এখনো ডিউটিতে, ডিউটিতে আসি ভোর ছয়টায়, বাড়ি যাই রাইত বারোটা-একটা, ফোন দিমু ক্যামনে তুমিই কও? আইচ্ছা এখন রাখি, পরে ফোন দিমু।
আরো মিনিট দশ অপেক্ষার পর গিটার হাতে নেমে আসে খালাম্মা ম্যাডামের ছোট ছেলে রাসেল। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, ছেঁড়াফাড়া জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে হাতাকাটা গেঞ্জি গায়ে। গিটার হাতে নেমে আসলে খালাম্মা ম্যাডাম বলে-আবার গিটার ক্যান রে বাবা?
এইটা নিতে হবে জনির জন্য। জনি আসবে এইটা নিতে আম্মু। এই কথা শেষ না করেই সে ঘুরে তাকায় ইসুবের দিকে, তারপর বলে-কী রে, তুই নাকি বহুত মাস্তান হইছস? আম্মার লগে দুই নম্বরি ধান্দাবাজি বন্ধ কর, কাইল কামে আসছ নাই, তুই নাকি আম্মারে মিথ্যা কথা কইছস? বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ফিক্স কইরা দিমু। সাবধান, ভালো হইয়া যা…।
গুলশান কেএফসি পর্যন্ত আসতে নয়টা বেজে যায়। আজ রাস্তায় জ্যাম অনেক বেশি।
কেএফসির সামনে বসে থাকে নয়টা থেকে প্রায় বারোটা পর্যন্ত। গাড়ির বাইরে অনেক ড্রাইভারের সঙ্গে সেও অপেক্ষা করে। এপাশে গাড়ির লম্বা লাইন। সব বড়লোকেরা আসে, গাড়ি থেইকা নাইমা যায়। গাড়ি কোথায় নিয়া ডেরাইভাররা পার্ক করে, সেইটা তাদের দ্যাখার বিষয় না। হ্যারা মুরগির মাংস ভাজা আর আলু ভাজা খাইতে যায়। কেএফসির মুরগি নাকি খাইতে অনেক মজা। বিদেশি মুরগি ভাজারে কয় কেএফসি। অপেক্ষারত অনেক ড্রাইভারদের সঙ্গে নানা রকম কথার ভেতর দিয়ে এসব তথ্য জানতে পারে ইসুব। বিদেশি মুরগা কী দিয়া ভাজে ভাই? একজন ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করে সে উত্তর দ্যায় হালারপুত, ভোদাই! মুরগা আবার কী দিয়া ভাজে এইডা জিগানির কথা হইল?
ড্রাইভারের কামটার এই একটা জিনিস ইসুবের খুব ভালো লাগে। রোজ রোজ অনেক ডেরাইভারের সঙ্গে পরিচয় হয়। কত জনের কত রকমের কথা, কত আলাপ। সাহেব, ব্যাগম সাহেব, হ্যাগো বকাঝকা, খাইচরামি, চাকরির ব্যাতন, পারমানেন্ট, সিনিয়র ডেরাইভার-এই সব গল্পগুলা শুনতে ভালোই লাগে। তাদের সঙ্গে ফোন নম্বর বিনিময় হয়। তবে বয়সটা বেশি হয়নি বলে ওকে কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। সবাই চায় সিনিয়রগিরি দেখাইতে। ইসুব তখন মনে মনে বলে, খাড়া কয়টা বছর যাউক, তখন দেখুম!
ক্ষুধায় পেটটার ভেতরে গরু মোইষ সব ডাকাডাকি হাম্বাহাম্বি শুরু করেছে। গাড়ির ভেতরে ঝিমিয়ে আসে দেহটা। বারোটা নাগাদ ভরা পেটে কোক-পেপসির ঢেকুর তুলে হেলেদুলে বের হয় খালাম্মা ম্যাডাম তার সন্তানদের নিয়ে। অর্ডার দেওয়া খাবার সবটুকু শেষ করতে পারেনি, অথবা বাড়িতে অর্ডার দিয়ে আগামীকাল সকালে খাবে বলে নিয়ে এসেছে। পলিথিনের ব্যাগের ভেতরে দাড়িয়ালা কেএফসির ছবি সংবলিত কাগজের বাকসে দুলছে মুরগা ভাজা।
গাড়ির ভেতরে সবাই প্রবেশ করার পর ইসুব যখন গাড়ি ছাড়ে তখন গাড়ির ভেতরে বিদেশি স্টাইলে মুরগা আর আলু ভাজার সুগন্ধে বাতাস মৌ মৌ করছে। ইসুব ঘন ঘন নিঃশ্বাস টেনে বুকের ভেতরে নেয় আর ছাড়ে। আর মনে মনে ভাবে-নাহ, বিদেশি মুরগি ভাজার গন্ধটা অনেক সুন্দর। এই গন্ধ নাকে আসার পর ইসুবের খুব ইচ্ছা হয় পেটভরে বিদেশি স্টাইলে মুরগি ভাজা খাইতে।
গাড়ি রেখে তাকে এখন রিকশা, বাস, সিএনজি-এই সব পালাক্রমে বদলে বাড়ি যেতে হবে। বাড়ি যেতে আজ প্রায় রাত দুটো বাজবে। গাড়ি থেকে নেমে চাবি ফেরত দেওয়ার সময় খালাম্মা বলে, কাইল সকাল সাতটার ভেতরে চইলা আসবি। গাড়ি ধুইয়াধাইয়া তারপর সকাল নয়টার মইধ্যে সোমা ম্যাডামের কাছে যাইতে হইব।
এখন বাজে রাত একটা, রিকশা, বাস, সিএনজি ধইরা বাসায় যাইতে যাইতে রাইত বাজব কম কইরা হইলেও দেড়টা। তারপর কাইল সকাল সাতটার মইধ্যে ক্যামনে আসুম? আমি ঘুমামু কখন আর উঠুম কখন?
অই কুত্তার বাইচ্চা, আমার লগে মুখে মুখে তর্ক করবি না, বেয়াদপের মতো তর্ক করলে একদম জেলের ভাত খাওয়াইয়া ছাড়ুম কইলাম! বদমাইস, বেয়াদপ কোথাকার।
আমি তর্ক করলাম কই? আপনেরে কইলাম আমি এত রাইতরে গিয়া ক্যামনে সকাল সাতটার সময় আসুম?
এইডা কওয়াতে আপনে আমারে কুত্তার বাচ্চা কইয়া গালি দিতাছেন?
দুইজনার এই রকম কথার শব্দে এলিভেটরের সামনে থেকে এগিয়ে আসে খালাম্মার গিটার ছেলে অপু, গিটারের রিডে হাত রেখে টুং টাং শব্দ তুলে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে জানতে চায়-আম্মু কী হইছে?
আরে দ্যাখ না, হারামজাদা বেয়াদপ আমার মুখে মুখে তর্ক করে, কয় কিনা সকাল সাতটায় আইতে পাইরব না!
এই বাস্টার্ড, মাদার ফাকার তর্ক করতাছস এত্ত রাইতে? তোমার খুব ত্যাল বাড়ছে, আম্মারে খুব হার্ড টাইম দিতাছ, যাও, ভালোয় ভালোয় এখন ফুটো, সকালে ঠিক টাইমে চইলা আইসো, নাইলে তোমারে সকালে ফিক্স করুম। যাও, এখন গুড নাইট। গিটারের তারে তখনো সে টুং টাং শব্দ তুলেই চলেছে।
বেতন দেওয়া নিয়ে ঝগড়া
জি আপা, বলেন, কী খবর?
আমি সিদ্ধান্ত নিছি ইসুবরে আর রাখুম না, আরেকটা ড্রাইভার খুঁজতাছি, অরে আই বিদায় করি দিমু।
কেন আপা, বিদায় করে দিতে হবে কেন? এখন তো বেশ ভালোই চালাচ্ছে। আমি তো আপনার কথামতো গাড়িতে উঠেই চোখকান খোলা রাখি। কোন দিক থেকে কেউ এসে গাড়িতে ধাক্কা দিল নাকি, ও কোনো ভুল করে কি না। এই সব আমি তো তীক্ষ্ন খেয়াল রাখি একেবারে পাহারাদারের মতো।
না, না, তুমি যা-ই বলো, প্রথম দিন থেইকা যে শুরু করছে, আর থামাথামি নাই। ট্রাফিক পুলিশরে টাকা দিয়া গাড়ি ছাড়াও, ব্যাটারি ডাউন করা, ঠিকমতো গ্যাস না নিয়া ত্যালে গাড়ি চালানি, ভাবতে পারো আমি কত টাকা গচ্চা দিছি ওর জন্য। ওরে গাড়ি দেওনের এক মাস আগে আমি বত্রিশ হাজার টাকা খরচ কইরা গাড়ির রং করাইলাম। হারামজাদায় আমার গাড়ির সামনেটামনে গুঁতা লাগাইয়া এইবার বত্রিশ হাজার না, আমার তো পঞ্চাশ হাজারেও সারব না।
আসলে আপা বাচ্চা ছেলে তো, তাই প্রথম প্রথম দুই-একটা ভুল করেছে। এই দুই মাসে বেশ ভালো চালাচ্ছে, আর ডিউটি তো ঠিকমতোই করছে। আমার কোনো কমপ্লেন নাই আপা সত্যি কথা বলতে। ও যা চালায় আমার চলে যায়। তা ছাড়া গাড়িটাও তো আপা অনেক পুরনো হয়ে গ্যাছে। প্রায়ই গাড়িটা রাস্তায় আটকে যায়, যখন-তখন, কী ভয়াবহ অবস্থা, ও তো এসব ঝামেলা সামলে গাড়িটা তো চালাচ্ছে।
কী কইলা তুমি? আমার গাড়ি পুরান হইয়া গ্যাছে? কত টাকা বাঁচাইছ আক্কেল আছে তোমার? শরম করল না আমার গাড়িরে পুরান কইতে।
কী আশ্চর্য! পুরনো গাড়িকে পুরনো বলব না তো নতুন বলব?
হ, নতুন কইবা, পুরান কইবা না। কত কষ্ট কইরা আমি নিজে রিকশা-সিএনজিতে চইলা তোমারে গাড়িটা দিয়া রাখছি সেইটা ভুইলা গ্যালা? লজ্জা করতাছে না? খুব তো ফুটানি মাইরা রিপোর্টিংয়ের কাম করতাছ আমার পুরান গাড়ি দিয়া। কত টাকা বাঁচাইছ আমার গাড়ি দিয়া?
আমি যত টাকা বাঁচাইছি, তত টাকা আপনি ইনকাম করেছেন-এটা তো জানেনই। তবে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাকে এত সহযোগিতা করার জন্য। আচ্ছা রাখি এখন।
শুনো তুমি রাখো আর যা-ই করো, হারামজাদাটারে ব্যাতন দিবা না, এইটা আমার হুকুম।
শোনেন, আপনাকে আমি গাড়ির ভাড়া বাবদ সেটা দিলেই হলো, বেতন দিই বা না দিই সেইটা আমার ব্যাপার, এটা নিয়ে নাক গলানোর কোনো অধিকার আপনার নাই।
আইচ্ছা, আমার লগে বাড়াবাড়ি কইরো না, সবে মাত্র ড্রাইভার গেল; এইবার কিন্তু আছে কামের ছেমড়ি, আমি কিন্তু সেইটা ধইরা টান দিলে তোমারে কামের ছেড়ির কাম করতে হইব।
আচ্ছা, সেটা দেখব বলে সোমা আক্তার মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
হাতিরপুলের বাজারের মোড় আসার আগেই সোমা আক্তার বলে-ইসুব সাহেব, একটু থাইমো তো হাতিরপুল বাজারে। কয়টা মাছটাছ কিনি। এই হাতিরপুল বাজারের সামনে দিয়ে পার হওয়ার সময় কখনো সোমা আক্তার একটু না থেমে পার হয় না। এখানে বাজারে নামতে তার খুব ভালো লাগে। গাড়ি থেকে নেমেই বাজার করা যায়। শাকসবজি থেকে শুরু করে একেবারে মাছ-মাংস-সব কিছুই রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে বাজারের চরিত্রে সাজানো। কিশোরী বালিকা যেমন শাক ক্ষেতে শাক কুড়ায় নেচে নেচে, সোমা আক্তারও যেন তেমনি মনের আনন্দে এই দোকানি, সেই দোকানির সামনে যেয়ে বাজার করে হাতিরপুল বাজারে নেমে। শাড়ির কুঁচিগুলা জুতমতো চেপে ধরে গোড়ালি থেকে অনেক ওপরে তুলে কাদাপানি ডিঙায়।
ওহ… হাতিরপুল বাজারের পাশ দিয়ে যাবে, এই হিসাব বোধ হয় আগে থেকেই মাথায় এসেছিল, আর সেই কারণেই মেরুনাকে সঙ্গে করে আনা! এখন ইসুব বুঝতে পারে মেরুনাকে কেন সঙ্গে করে এনেছে।
এই মেরুনা এখন ওর পাশে বসে আছে। ম্যাডাম আপা ওরে পড়ালেখা শিখাইব। জমি লেইখা দিব, টাকা-পয়সা খরচ কইরা বিয়া দিব। এই মেরুনার সঙ্গে পেরেম করতে পারলে…এইডারে বিয়া করতে পারলেও ভাইগগোটা কদ্দুর খোলে। একটু চান্স নিয়া দ্যাখলে হয় না? ঘন ঘন তাকায় মেরুনার মুখের ওপর দৃষ্টি আরোপ করে।
না, তুমি হারামদাজা বদমাইশটারে ব্যাতন দিবা না, এত্ত বড় সাহস! আমারে কি না কয় গালি দেবেন না, শুয়ারের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, আমারে ধমক দিয়া কথা কয়।
দ্যাখেন দিলু আপা, অনেক মানুষই আছে বাবা-মাকে তুলে, জাতগুষ্টি ধরে গালি না দিয়ে শয্যা ত্যাগ করতে পারে না। তখন সে গরিব না ধনী, তার পেটে ভাত আছে কি নাই সেটা তার মনে থাকে না। আপনি ওর বাবা-মা চৌদ্দগুষ্টি ধরে গালি দিয়েছেন, তাই সে হয়তো আপনাকে বলেছে ওভাবে গালি দিতে না। এটাতে সে অন্যায় করেছে বলে তো আমার মনে হয় না। বাবা-মা জাত-গুষ্টি ধরে গালি দিলে বেশির ভাগ মানুষই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, সেটা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই হয় আপা।
খালাম্মার পোলা
আজকে ইসুবকে ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে ডেকে তোলে ফোন দিয়ে খালাম্মা ম্যাডাম। এরই ইসুব, উইঠছসনি কোনো? আমি জাইনতাম তুই উইঠবি না, থাক্ পোলাপান মানুষ, আইচ্ছা, উঠ, উঠি চলি আস তাড়াতাড়ি, আইজ আমার পোলা আসতাছে বিদ্যাশ থেইকা। অনেক কাম, সময় নাই আমার হাতে, আসি পড় তাড়াতাড়ি। তুই এক কাম কর, একখান সিএনজি করি চলি আস, আমি আইজ তরে সিএনজির ভাড়া দিই দিমু।
কত নামে ডাকে ইসুব জসিমকে, কখনো ওস্তাদ, কখনো বস, কখনো ব্রাদার। এই ওস্তাদ বস কম্পানির ড্রাইভার কেয়ারটেকার কোয়ার্টারে এই কামরাটা বরাদ্দ পেয়েছে। সেই কামরার ভেতরে একটা মাত্র চৌকি জসিমের। সেটা এক পাশ্র্বে। দেয়ালের বাকি চারপাশ ঘেঁষে তিনটা বিছানা পাতা মেঝের ওপরে। এরই এক পাশ্র্বে ইসুবের বিছানা পাতা। সেখানে ফোন বাজলে ফোনের রিংয়ে অন্যদের ঘুম ভেঙে যায়। বিশেষ করে জসিমের। জসিম যেহেতু এই কামরার মালিক; সুতরাং তার ঘুম ভাঙার প্রতি সবার তীক্ষ্ন নজর।
ইসুব বিরক্ত হয়ে মোবাইলের পেছনে এমন করে চাপ দেয় যে নিজের আঙুল মটকে ওঠে। আর তখন সে মোবাইলের উদ্দেশে গালি দেয়-শালার পুত, বাজনের আর সময় পাইলি না।
জসিম তখন ঘুম জড়ানো গলায় বলে-ইসুইববা, যা বাইর হ, শালার পুত, তরে একটা নতুন কাম নিয়া দিমুনে। অখন বাইর হ।
বাসি মুখেই ইসুব গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে বের হয়ে আসে। রাতের অপূর্ণ ঘুম তখনো ওর চোখের পাতা ভারী করে রেখেছে। সিএনজির জন্য দাঁড়িয়ে থেকে।
মেরুনা বিষয়
এই গাড়িতে বসলে দুই ম্যাডামের কত কথা জানা যায়, সাংসারিক, ব্যক্তিগত, চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য কত রকমের ব্যাপার যে জানা যায়। স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকলেও কান পেতে রাখা হয়। জ্যামে বসে দুই মহিলা যত রকমের কথা, গল্প, আলাপ-আলোচনা, ঝগড়াঝাঁটি করে সব কিছুরই নীরব সাক্ষী সে। ম্যাডাম আপা যখন গাড়িতে থাকে, খালাম্মা ম্যাডাম সেই সময়টাতেই ফোন করে। সুতরাং তাদের দুইজনার ভেতরে যে কথাবার্তা হয়, সবই ইসুবের জানা হয়ে যায়।
না, না, আপা, আপনি ওর ভাইকে বলে দেন মেরুনা এখন যাবে না।
না, না, হউক না ওর আপন ভাই, আপন বাপ আসলেও এখন নিতে পারবে না। ওকে গ্রামে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে-আমি সেটা ভালোই জানি।
কী বললেন, বেতন?
আমি তো সেদিনও আপনাকে বললাম, মেরুনা এখন গ্রামে যাবে না।
ও আমার কাছে থাকবে, আমার কাছে থেকে বড় হবে, আমি ওকে বড় করে বিয়ে-শাদি যা দেওয়ার দেব। আপনি মেরুনার ভাইকে চলে যেতে বলেন।
রাস্তায় লাশ
নিকুঞ্জ সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস নিয়ে মেইন রোডে বের হয়ে আসতে গিয়ে লম্বা জ্যামের কারণে সময় লাগে প্রায় পনেরো মিনিট। পিঁপড়েও এর চাইতে জোরে চলে। বড় ম্যাডাম বিকেলে ফোন করে ছোট ম্যাডাম আপাকে বলেছে, আজ যেন একটু তাড়াতাড়ি গাড়িটা ছেড়ে দেয়। ছোট ম্যাডাম এই জন্য গ্যাস নিয়ে বিকেলের ভেতরে ফিরে আসছিল। বড় ম্যাডামের ডিউটি করতে গেলেই মেজাজটা খুব চড়ে যায়। আজ আবার ছোট ম্যাডামের ডিউটি! ইস! শালার কপালটাই খারাপ।
জ্যামে বসে থাকার সময়ই একবার ফোন এলো বড় ম্যাডামের। কথাতে বোঝা গেল যে, এটা বড় ম্যাডাম। কারণ এপাশ থেকে উত্তর দিল, ছোট ম্যাডাম আপা-জি না, আপা, জি না, এই যে বসে আছি জ্যামে। হ্যাঁ, না, কতক্ষণ যে লাগে আল্লাহ জানে।
ইসুব, ওপাশের জ্যাম তো মনে হচ্ছে আরো লম্বা?
জি ম্যাডাম, অনেক লম্বা, ওই দ্যাহেন, ইয়ারপোর্ট ছাড়াইয়া উত্তরা পর্যন্ত গ্যাছে মনে হইতাছে। ডান দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে গাড়ির এসকেলেটরে চাপ দেয়, আবার ব্রেক কষে এভাবে এগোতে এগোতে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে-ম্যাডাম দ্যাখেন একটা একসিডেন হইছে, আহ হা রে, এক্কেবারে ভত্তা কইরা রাইখা গ্যাছে।
কোথায় কোথায়? সোমা আক্তার প্রায় লাফিয়ে ওঠে দেখার জন্য। কিন্তু সোমা আক্তারের নজরে আসার আগেই গাড়ি এগিয়ে যায় কিছুটা। হয়তো এ সময়ে সোমা আক্তারের দৃষ্টি কিছুটা আড়াল হয় ওপাশে বড় বাসের কারণে।
ইসুব ঘাড় ঘুরিয়ে সোমা আক্তারের উদ্বিগ্ন চেহারার ওপর নিরুদ্বেগ দৃষ্টি ফেলে ওর স্বভাবসুলভ চিবানো কথা বলার সেই ভঙ্গিমায় বলে-ম্যাডাম আপনে মনে হয় ডরাইছেন?
না না, ডরাইনি, রাস্তাঘাটে অ্যাকসিডেন্টে মরা মানুষ কখনো দেখিনি তো, তাই একটু দেখতে চাইলাম।
দ্যাখতে তো পাইবেন, আমরা তো ঘুইরা আসুমই, ততক্ষণে যদি আবার লাশটা থাকে, পুলিশে না নিয়া যায়।
তুই কখনো রাস্তাঘাটে অ্যাকসিডেন্টে মরা মানুষ দেখেছিস?
আয় হায়, ম্যাডাম যে কী কঅঅয়! আমার ভাই একখান তো রোড অ্যাকসিডেন্টে মরল গত মাসে।
হ, আপা, আমার বড় কাকার পোলা, আমগো বংশের প্রথম পোলা, হ্যায় তো গত মাসে অ্যাকসিডেন্টে মরল।
কী করত? ড্রাইভারি?
জি, খুব ভালো গাড়ি চালাইত, তার পরও দ্যাখেন! কয় না হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে, হ্যার থেইকা খারাপ চালায় কত ডেরাইভার আপা, গাড়ির কিছু হয় না, আর এত্ত ভালো গাড়ি চালাইয়াও দ্যাখেন ক্যামনে মরল।
ও আচ্ছা, কী হয়েছিল? ওই যে টেরাকের লগে মনে হয় টক্কর দিত গেছিল, এক্কেবারে গাড়িসুদ্ধা দিছে হান্দাইয়া।
সোমা আক্তার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইসুবের নির্বিকার অভিব্যক্তির দিকে। তুমি তার পরও ড্রাইভারের কাজটাই বেছে নিলে কেন?
ডেরাইভারের কামটা একবার শিখতে পারলে মনে করেন সব থেইকা সোজা। ঝামেলা কম, আমার মায়ে চায় নাই আমি ডেরাইভারের কাম শিখি, আমার মায়ের তো আমি একটাই পোলা, আর সবগুলি তো মাইয়া। মায়ে তাই ডরায় বেশি।
তুমি অন্য কিছু শিখলেই পারতে?
আমার মায়ে চায় যে আমি বিদ্যাশ যাই; কিন্তু আমি বিদ্যাশ-বুদেশ যাইতে চাই না, আমগো গেরামের আত্মীয়স্বজন, ভাইবেরাদোর তো অনেকেই গ্যাছে, যা অবস্থা হ্যাগো… নাহ, আমার বিদ্যাশের শখ নাই, একবার দালালগো খপ্পরে পড়লে জীবন শ্যাষ। আমি দ্যাশে থাকতেই অনেক ভালোবাসী।
পিলপিলিয়ে গাড়ি এগোয়, এরই মাঝে দিলরুবা আহমেদের ফোন আসে। সোমা বলে-আপা একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, খুব জ্যাম, কতক্ষণ যে লাগে… জি জি আপা, জি, পৌঁছেই ছেড়ে দেব।
দিলরুবা আহমেদ ফোন করলেই ইসুবের অভিব্যক্তি বদলে যায়। কখনো মনে মনে একটা অশ্লীল গালি দেয়। রাতে দিলরুবা আহমেদের ডিউটি করতে হবে ভেবে ইসুবের খুউব রাগ হয়।
এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গাড়ি এগোতে থাকে একই গতিতে। ঠিক এয়ারপোর্টের সামনে থেকে গাড়ি ঘুরে আসে খিলক্ষেতের দিকে আসার জন্য। জ্যামে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত সোমা আক্তার মোবাইলে ফেস বুক ওপেন করে। আজ সারা দিন একবারও যাওয়া হয়নি, ফেসবুকে সোমা আক্তার কখনো নিজের ছবি ডাউন লোড করে না বা ওয়ালেও কিছু লেখে না, নিজের ছবি ডাউনলোড করা অথবা ওয়ালে কিছু লেখার চাইতে বেশি ভালো লাগে বন্ধুবান্ধবদের নানা ভঙ্গিমায়, নানা রকম ছবি দেখা ও নানা রকম মন্তব্য পড়া।
আজ সোমা আক্তার সরাসরি ড্রাইভিং সিটের পেছনে বসেনি। যেদিন সে কোনাকোনি বসে, সেদিন থেকে থেকে ইসুব আড়াআড়ি বাঁয়ে তাকায়। ম্যাডাম যেন বুঝতে না পারে সে ম্যাডামকে দেখছে এমনভাবেই পেছনে আড়াআড়ি তাকায়। যখনই সে পেছনে তাকায়, তখনই সে রাস্তায় সরাসরি তাকায়। যাতে ম্যাডাম তার এই ঘুরে তাকানোকে মনে করে সে রাস্তার পেছনটা দেখছে।
ম্যাডামের হাতে খুব সুন্দর একটা মোবাইল ফোনসেট। সেইটা দিয়ে সে ইন্টারনেটে যায়, ফেসবুকে যায়। তার যদি একটা মোবাইল ফোনসেট থাকত, তাহলে সে ফেসবুকে যাইতে পারত। জসিমের একটা স্যামসাং ফোনসেট আছে। জসিমের মালিক অনেক বড়লোক। জসিমের বেতন ভালো, পারমানেন্ট। জসিম কম্পানির মালিকের গাড়ি চালায়; কিন্তু বেতন পায় কম্পানি থেকে। গত বছর ঈদের বোনাসের টাকা দিয়ে জসিম স্যামসাং মোবাইল কিনেছে।
হঠাৎ এ সময়ে জ্যাম কমে আসে, গাড়ি আগের থেকে তুলনামূলক দ্রুত চলে। এবং দ্রুত তাদের গাড়ি এসে যায় সেই স্থানে, যেখানে যেখান ইসুব মৃত মানুষটাকে দেখেছে।
দূর থেকে তখনো নজরে আসছে রাস্তায় ওপরে পড়ে থাকা মৃত মানুষটাকে। ইসুব পেছনে ঘুরে তাকিয়ে হেসে বলে-ম্যাডাম… আপনার দিলটা কেমন? মানে?
মানে জিগাইতাছি মরাকাটা মানুষ দেখলে সহ্য করতে পারেন?
মরা মানুষটা কি রাস্তার ওপরে পড়ে আছে?
ওই তো দেখা যাইতাছে, আর কদ্দুর পরেই আমরা ঐটার পাশ দিয়া যামু। দ্যাখতে চান? যদি দ্যাখতে চান তাইলে গাড়ি কদ্দুর চাপাইয়া নিমুনে। দেইখেন।
ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে সোমা আক্তার। না না, আমি বাব্বা ওসব দেখতে চাই না। আমি কোরবানি শয্য করতে পারি না। গরু জবাই তো দূরে থাক, আমি মুরগি জবাই পর্যন্ত দেখতে পরি না। আর আর… গাড়ির ভেতরে বসেই হাঁপিয়ে ওঠে সোমা, না বাব্বা, তুই যতটা পারিস দূর দিয়ে যা, আমি এসব দেখতে চাই না।
ম্যাডামের কথায় ইসুব খুউব মজা পায়। এত্ত ডরাইলা? এইডারে কয় বড় লোকের ঘরের মানুষ। কিচ্ছু সহ্য করতে পারে না, মরাও না জ্যাতাও না। সব মাইনষেই ডর। হঠাৎ ওর মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি আসে। ইচ্ছাকৃত সে গাড়ি লেন বদলে দ্বিতীয় লেনে আসে যে লেনের ওপর মৃত মানুষটা পড়ে আছে।
ইসুব তীক্ষ্ন দৃষ্টি ফেলে দেখে, তখনো মৃতদেহটা রাস্তার ওপরে পড়ে আছে। ইসুব ইচ্ছা করে ওর গাড়ি মৃতদেহের একেবারে পাশ ঘেঁষে চালায়। যখন একেবারে মৃতদেহের সমান্তরালে ইসুব ডাক দেয়-ম্যাডাম আপা, দ্যাখেন, কদ্দুর দ্যাখেন, এই রকম খাঁটি মরা দৃশ্য আবার কবে দ্যাখতে পান, এইটা একটা বাস্তব সিনেমা। সিনেমা-নাটকে যেই সব দ্যাখায় সেইগুলি তো হইলো নকল, মেকআপ, আর এইটা হইল কি না আসল। কথা বলতে বলতে ইসুব গাড়ির স্ট্যার্ট ঘ্যাস করে বন্ধ করে দেয়।
চিৎকার করে ওঠে সোমা আক্তার-কী… কী… ক…কী হইল?
আপা স্টার্ট বন্ধ হইয়া গ্যাছে।
কেন? কেন? কেন? তুই বন্ধ করলি নাকি বন্ধ হয়ে গেল?
আরে কী মুশকিল, আমি বন্ধ করুম ক্যান? গাড়ি এইডার তো কোনো মা-বাপ নাই, যখন-তখন মন চাইলেই বন্ধ হয়, এইডা কী আপনে জানেন না?
মৃতদেহের ওপরের অংশের ওপর দিয়ে চলে গেছে হয়তো বাস অথবা ট্রাক। মাথাটা ফেটে ঘিলু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে চারপাশে। নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে একেবারে পুরোটাই। অর্ধেক মাংসপিণ্ড, বাকিটা নাড়ি-ভুঁড়ি মিলেমিশে রক্তের ভেতরে ভাসছে। মৃতদেহটা ঠিক রাস্তার মাঝখানে। বাঁয়ের লেন দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে পিলপিলিয়ে। মৃতদেহটার বরাবর একেবারে ডান পাশ্র্বে দুটো পুলিশ ভ্যান। ভ্যানের পাশে কয়েকজন পুলিশ হয়তো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কারণ তাদের হাতে ওয়াকিটকি, দূর থেকে দেখেই অনুমান করা সম্ভব তারা সবাই ব্যস্ত। কিন্তু তাদের কারো নজর এপাশে মৃতদেহের ওপর নয়।
হঠাৎ মৃতদেহের পাশে একটি গাড়ি থেমে যেতে দেখে একজন ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে আসে। হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি এগিয়ে নিতে। পুলিশের কথা মান্য করার পরিবর্তে ইসুব সোমা আক্তারের দিকে ঘুরে বলে-আপা, খারাপ লাগলেও দ্যাখেন, একটু কষ্ট কইরা দেইখা লন। দ্যাখেন আপা একটা মাইয়া আছিল। দ্যাখেন ম্যাডাম একটা পাও আলগা হইয়া একদম এই ধারে আইসা পড়ছে, দ্যাখছেন ছেলোয়ার, পায়ের নখে নখপালিশ! আহারে কার জানি মাইয়া। ইস্…।
একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলার পরও সোমা আক্তার ডান পাশে মাথা ঘুরিয়ে রেখেছিল; কিন্তু সেই মুহূর্তে ইসুব বলে, ম্যাডাম একটা মাইয়া মাইনষের পাও, অমনি সে ঘুরে তাকায়। ততক্ষণে একজন পুলিশ এগিয়ে গালি দিয়ে বলে-এই, হারামজাদা এইখানে গাড়ি থামাইছস ক্যান?
না স্যার, থামাই নাই; গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হইয়া গ্যাছে।
তাড়াতাড়ি টান, যা টান…টান…।
স্যার কদ্দুর ঠেলা দিতে লাগব। কথাটা বলে মনে মনে হাসে ইসুব, এখন একটা চান্স, ট্রাফিক শালার পুত, চুতমারানি, এইবার আসো, গাড়ি ঠেইলা যাও, এইখানে গাড়ি থাইমা থাকা এখন মুশকিল।
সোমা আক্তার গাড়ির ভেতরে বসে অস্থির হয়ে ওঠে। এইটা একটা কথা, গাড়িটা আর স্টার্ট বন্ধ করার জায়গা পাইল না, ইসুব এইটা কথা?
আমি কী করুম ম্যাডাম আপা, গাড়ির ইঞ্জিনের ওপর তো আর আমার কোনো হাত নাই, এই গাড়িটা যে ক্যান ভাড়া নিতে রাজি হইছিলেন! এই গাড়ি নিয়া রাস্তায় নামলে বেইজ্জত হওন ছাড়া আর উপায় নাই।
দুজন ট্রাফিক পুলিশ এসে গাড়িতে ধাক্কা দেয়। ইসুব গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের ওপর হাত রেখে এসকেলেটরে চাপ দেয় হালকা করে, কয়েকবার ইচ্ছাকৃত হার্ডব্রেক করে গাড়িটাকে ঝাঁকি লাগায়, কয়েকবার হালকা ব্রেক করে গ্যাসে পা চেপে ধরে, এ রকম কয়েকবার করে এসকেলেটর চেপে ধরে। গাড়ি স্টার্ট নিয়ে বেশ কিছু দূর এগিয়ে এলে মুখ টিপে হাসে আর বলে, আইজকা একটা কামের মতো কাম হইল!
মানে, কামের মতো কী কাম হইল?
এই যে ছ্যাঁচা ভত্তা একটা লাশের সামনে গাড়িটা থাইমা গ্যাল… হিহিহিহি…
কী আশ্চর্য? এইটা কামের মতো কেমন করে হইল? আমি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আরে আপাআআ, দ্যাখেন নাই কায়দামতো ট্রাফিক পুলিশরে দিয়া গাড়ি ঠ্যালাইলাম, বাপের জন্মে এই কাম করাইতে পারতাম, কয় না, কারো ঘরে আগুন, আর কেউ কয় হেই আগুনে মরিচ পুড়া দিয়া লই…হিহিহিহি…।
সোমা আক্তার বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে-ইসুবের চেহারা ভরা ব্যঙ্গ-ইয়ার্কি।
কই তুমি?
নিজের ভাগ্যকে গালি দেয় জসিমের কপালের কথা স্মরণ হতেই। কপাল, দুইটা ফকিন্নি মালিক জুটছে আমার কপালে, একটারও পয়সা নাই ঠিকমতো গাড়ি পালানির আবার গাড়ি চড়ে, আজাইরা ফালতু। মাইনষে গাড়ির মালিক শুনলেই মনে করে কত বড় লোক, আইজকাল আর গাড়ির মালিক হইলেই বড়লোক হয় না। বোরকায়ালি খালাম্মাও গাড়ির মালিক আর ম্যাডামের মতো টিইপা টিইপা টাকা গনানি মানুষগুলারেও মাইনসে মনে করে গাড়ির মালিক।
চাবি রাইখা যা
ভোরে এসে আজ দরজার বেল বাজাতেই দরজা খুলে দাঁড়ায় খালাম্মা ম্যাডাম। বুকের ভেতরে দিল-কলিজা সব ধপাস করে লাফিয়ে ওঠে খালাম্মা ম্যাডামকে দেখা মাত্র। সালাম খালাম্মা না, মানে খালাম্মা ম্যাডাম।
কী রে, কিয়ের লাই আইছত?
জি, স্তব্ধ মূর্তির মতো অপলক তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড ইসুব, তারপর বলে-জি, চাবি নিতে।
অই চাবি কি তোর বাপের গাড়ির নাকি রে হারামজাদা…চাবি নিতে আইছি! কিয়ের চাবি? তুই কি মনে করছস ঘোড়া ডিঙায়া ঘাস খাইয়া যাইবি আমি দিলরুবা আহমেদরে বোকা বানাইয়া। জিন্সের প্যান্ট পিন্দননা ম্যাডাম আফা পাইছস, তাই না? আমি তগো হ্যাডম ভাইঙা দিমু না।
যা, চাবি নিতে লাগব না, তোর চাকরি খতম, তরে আর গাড়ি চালাইতে হইব না। তুই মনে করছিলি যে আমারে ডিঙাইয়া ম্যাডাম আপারে ত্যাল দিয়া চাকরি ঠিক রাখবি তাই না? অখন রাখ, দেখি তুই ক্যামনে চাকরি ঠিক রাখস।
আপনে আমারে ভুল বুঝতাছেন খালাম্মা ম্যাডাম, আমি আপনারে বেশি মাইন্নো করি, আপনেই তো আমারে চাকরি দিছেন, আমি তো আপনার চাকরি করি, আমি কি হ্যার চাকরি করি নাকি খালাম্মা ম্যাডাম? হাতের ভেতরে হাত কচলাতে কচলাতে বিনয়ের সঙ্গে ইসুব করুণভাবে কথাগুলো বলে।
ওর করুণ বিনয়ী ভাব প্রদর্শন আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে দিলরুবা আহমেদকে। এবার গলা ছেড়ে খেপা নেকড়ে যেন ঘেউঘেউ করে ওঠে-আরে বাব্বা, বাঁইচলাম না, আমারে মাইন্নো করে! ত্যাল মারোছ ম্যাডামের ঠ্যাংয়ে আর অ্যাকটিং করোস আমারে মাইন্নো করোছ? গান শুনাইতে আইছস আমারে? যা ভাগ, তর চাকরি আইজ থেইকা নট। তরে আর আমার গাড়ি চালাইতে হইব না।
না ম্যাডাম এইটা কইবেন না, আমার চাকরিটা খুব দরকার খালাম্মা, আমি তো আপানার কথামতো কাম করতাছি।
চোপ হারামজাদা আরেকটা কথা কইবি না, এইখান থেইকা যা, ভাগ, আমি তরে আর আমার বাসার বাড়ির সামনে দ্যাখতে চাই না। যা, গেলি?
খালাম্মাকে মেজাজ, রাগ, ক্ষোভ ঝাড়তে দিয়ে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আরো কিছুক্ষণ খালাম্মা ম্যাডামের রাগ বর্ষণ হওয়ার পর ইসুব বলে-খালাম্মা আমার ব্যাতনটা দিবেন খালাম্মা?
ব্যাতন কিসের?
আমারে হিসাব করতে হইব, তর লাইগা কত টাকা গচ্চা দিতে হইছে আমারে। পুলিশরে ফাইন দ্যাও, ব্যাটারি চার্জ দ্যাও, গাড়ির শরীরে ঘষা-গুঁতা লাগাইছস যে সেগুলি ঠিক করতে কত টাকা লাগব সব হিসাব-নিকাশ কইরা যদি দেখি টাকা পাইবি, তাইলে দিমু আর নাইলে দিমু না। আমি এক পয়সা তর রাখুম না, আমি হারামির পয়সা খাই না, তবে আমি এক পয়সা ছাড়ও দিমু না।
এইটা আপনে কী কন? গাড়ির শরীলে আমি কি ইচ্ছা কইরা গুঁতা লাগাইছি? আরেকটা গাড়ি আইসা গুঁতা লাগাইয়া দিলে আমি কী করুম? ট্রাফিক পুলিশে আমারে ধরছিল, কারণ আপনে গাড়ির কাগজ-ডকুমেন গাড়িতে রাখেন নাই।
অই হারামজাদা, কুত্তার বাচ্চা আমার লগে মুখে মুখে তর্ক করতাছস, তোর মুখ কিন্তু আমি এখনই জুতাইয়া ভাইংগা দিমু কইলাম।
ক্যান জুতা মারবেন ক্যান, আমি কী করছি? আপনে তো আমার বাপ-মা তুইলা গালি দিতাছেন? আমারে গালি দ্যান, আমার মা-বাপরে গালি দিবেন ক্যান? আমার দোষে হ্যারা ক্যান গালি খাইব?
ইসুবের এবং খালাম্মা ম্যাডামের এই সব কথার ভেতরে খালাম্মা ম্যাডামের ছোট ছেলে অপু উঠে আসে চোখ ডলতে ডলতে-মাতালের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হইছে আম্মা? এত্ত চিল্লাবিল্লা ক্যান সকাল সকাল? কী হইছে?
দ্যাখ না অপু, এই হারামজাদা আমার লগে মুখে মুখে তর্ক করতাছে, এত্ত বড় সাহস, আমি ভালো মানুষ বইলা এখনো অর বেয়াদপি সইজ্জো করতাছি, অন্য কেউ হইলে এক্ষণে অরে পুলিশে দিত।
দিলরুবা আহমেদের তর্জনগর্জন, লাফানি শেষ হয় না, বীরের মতো এগিয়ে আসে অপু মাথার চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে। ক্ষুধার্ত খেপা বাঘের মতো দাঁতমুখ খিঁচিয়ে যেন লাফিয়ে পড়ে ইসুবের ওপর, চটাং চটাং কয়েকটা এলোপাতারি থাপ্পড় মারে ইসুবের গালে, মাথায়। ইসুব কিছু বলতে চেয়ে পারে না, যতবারই মাথা তোলে ততবারই ইসুবের গালে এসে পড়ে কঠিন চড়-থাপ্পড়। ক্রমাগত থাপ্পড় দিয়ে তারপর ইসুবের ঘাড়ে ধরে ধাক্কা দিয়ে বলে-এখনো সময় আছে, ভাগ, আর একটা কথা বললে এখনই তরে থানায় পাঠামু।
মাথা নিচু করে ইসুব সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে-তখনো ওর কানে আসতে থাকে-আমার ভাইগ্না পুলিশের আইজি কি বাল ফালাইতে হইছে? কী মনে করতাছস? তর মতো ড্রাইভারের হ্যাডম দেইখতে? খাড়া, আমি তরে যদি জেলের ভাত না খাওয়াই তাইলে আমার নাম দিলরুবা আহমেদ না।
দশতলা ভবন ইসুব পায়ে হেঁটে নেমে আসে। বাইরে বের হওয়ার সময় গেটের কাছের দারোয়ানের দৃষ্টি যেন ওকে তাড়া করে। হাঁটতে হাঁটতে ইসুব বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে। তারপর সে ধীরেসুস্থে ম্যাডাম আপার নম্বরে ডায়াল করে। শান্ত-বিষণ্ন কণ্ঠে বলে-একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার সব কিছু। অপর প্রান্ত থেকে সোমা আক্তার শুধু হুঁ, হা… এই ধরনের সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়।
আমি এখন কী করুম আপনে কন আপা, গাড়ির চাবি তো দিল না!
গাড়ির আসল মালিক তো উনি, চাবি না দিলে আমি তো জোর করতে পারি না, এটা তো বুঝতে পারছিস, তাহলে আপাতত আমারও গাড়ি নেই। তুই একসময় এসে আমার কাছ থেকে তোর বেতনের টাকাটা নিয়ে যাইস।
আপা একটা কথা কই? বল? কিছু মনে করবেন না তো?
আপা, আমার ব্যাতনের টাকা, এইটা আমার হক, আমার কষ্টের কামাই, কন? আমি তো কাম করছি নাকি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই, আমি তো অস্বীকার করিনি যে এটা তোর কষ্টের কামাই না?
আপা আমার টাকা তো উনি মাইরা দিতে চায়, এর জইন্নো তো উনি আমারে পোলা দিয়া মাইর খাওয়াইল, আমি তো আপা গরিব মানুষের পোলা, আমি তো হ্যার পোলারে মারতে পারুম না, তবে আপা আমি হ্যারে আমার টাকাটা মাইরা নিতে দিমু। কী হইব, না হয় এক মাস উপাস করুম, এক বেলা খামু, এক বেলা খামু না; কিন্তু আমি আপা আমার টাকাটা হ্যারে মাইরা নিতে দিমু।
কী বলিস তুই এটা ইসুব? তোর মাথা ঠিক আছে? এটা তোর সারা মাসের বেতন।
হউকগা আপা, আপনে খালি টাকাটা আমার হাতে দ্যান আপা, আমি টাকাটা নিয়া গিয়া হ্যার সামনে ফিকা ফেইলা দিয়া আসুম। আপনে আমারে এইটুকু সাহায্য করেন আপা, আমারে খামাখা, অন্যায়ভাবে মারনের এইটুকু শোধ লইতে দ্যান।
সোমা আক্তার কিছু বলার জন্য আমতা আমতা করে, ওর ঠোঁট দুটো তখন ভারী হয়ে এসেছে, সে কিছু বলতে চায়; কিন্তু বলতে পারে না।
ঢাকা শহর
ম্যাডাম আপার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ হয় না। সে জানে ম্যাডাম আপার সঙ্গে কথা বললে সে এটাই বলবে। নরম কোমল মিষ্টি আদর মাখা সুরে বলবে, গাড়িটা তো আমার নয় ইসুব। যার গাড়ি সে যদি না রাখে আমি কী করতে পারি। আমি যেটুকু পারি তোর বেতনটুকু পরিশোধ করে দিতে পারি। সেটা যে ম্যাডাম আপা দিবে সে বিষয়ে তার সন্দেহ নাই।
তার পরও ম্যাডাম আপার সঙ্গে ফোনে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে তার মানসিক যন্ত্রণা হয়তো কিছুটা লাঘব হয়। ম্যাডাম আপার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে সে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। কখনো ক্রমাগত হেঁটে, কখনো বিরতি নিয়ে সে হাঁটতে থাকে। যখনই চার রাস্তার মোড় আসে সে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এই ঢাকা শহর ওর কাছে কখনো একটা উত্তাল সমুদ্রের মতো মনে হয়, কখনো মনে হয় বিস্তীর্ণ আকাশ আবার কখনো মনে গভীর জঙ্গল।
বেইলি রোডের মোড়ে এসে সে কোমরে ডান হাতের ঠ্যাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই রাস্তায় ম্যাডাম আপা সেই দিন তাকে দাঁড় করায়ে রাখল। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক যেখানটায় ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেখানটায় এসে দাঁড়ায়। মাথার ওপরে বড় বড় হরফে লেখা-টাঙ্গাইল কুটির। এইখান থেকে ম্যাডাম আপা শাড়ি কিনে আনে। ম্যাডাম আপা শাড়ি পরলে খুব সুন্দর লাগে। কিন্তু ক্যান যে জিন্সের প্যান্ট পরে ছ্যাড়াগো মতো! এই প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায় না। আবার জিন্সের ওপরে সেইটাও ছ্যাড়াগো শার্টের মতো কোর্তা! চুলগুলাও তো ব্যাটাগো মতো ছোডও। হ্যারে আসলে কেউ কইব যে হ্যারে ব্যাডাগো মতো লাগে, মাইয়া মাইনষের মতো সুন্দর লাগে না।
টাঙ্গাইল কুটিরের সামনে থেকে একটু বাঁয়ে এগিয়ে ওর চোখে পড়ে ফখরুদ্দিন। টাঙ্গাইল কুটির থেকে শাড়ি কিনে সেদিন ম্যাডাম আপা খাইতে গেল বান্ধবীরে নিয়া। ম্যাডাম আপার বান্ধবীটা কী সুন্দর! একদম খাঁটি বাঙালি নারী। শাড়িশুড়ি পিন্দা আইল, দ্যাখতে কী সুন্দর লাগল। ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানিটা খাইতে খুব ভালো লাগে সেদিন। ম্যাডাম আপা দিল আর বলল-এই ইসুবগুল, চাইনিজ খাইতে তোমার বমি আসে, তাই আইজ একদম খাঁটি মোগলাই আনলাম। এই বিরিয়ানিও কিন্তু বাঙালিদের খাবার না। এইটা মোগল বাদশাহদের বাদশাহি খাবার। বাঙালির আসল খাবার হইলো মাছ আর ডাইল। সেদিনের কথা মনে হইলে ইসুব হাসে। ফখরুদ্দিনের দিকে কয়েকবার তাকায়।
তারপর সেই ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে হাতিরপুল আসে। হাতিরপুল কাঁচাবাজারের সামনে এলে পুনরায় তার মনে পড়ে ম্যাডাম আপার কথা। এইখানের কাঁচাবাজার ম্যাডাম আপার খুব প্রিয়। এইখানে কই জানি তার বাপের বাড়ি আছিল। একদিন তো সেইটাই কইল। এই দুই মাসে একদিনও সে ম্যাডাম আপার ভাইবোইন, মা-বাপ কারো কথা শুনে নাই তার মুখে। আইচ্ছা এই বোরকায়ালী খালাম্মার সঙ্গে তার এত খাতিরটা হইলে ক্যামনে। ম্যাডাম আপা তো ডাইরেকট কয় সে ধর্ম মানে না, সে নারী অধিকারে বিশ্বাস করে। আর এই বেডি খালাম্মা তো সারা দিন পারলে মসজিদের ভিতরে হান্দায়া থাকে। এই বুঝি নামাজরোজার তরিকা। আবার নাকি হজ করছে। হইব না, মাগি বদমাইশ, তর নামাজ-হজ কিচ্ছু হইব না। আমি গরিব মানুষরে অত্যাচার করোস, খাড়া দেখবি আল্লায় তোগোও একদিন এই অন্যায়ের ফল দিব। আল্লার মাইর দুইন্নার বাইর।
পথের দুই পাশের নানা রকম দৃশ্যের ভেতরে ঢুকে পড়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা সে প্রায় ভুলে গিয়েছিল সকালের অপমান ও যন্ত্রণার কথা। হঠাৎ স্মরণ হতেই সে উত্তেজিত বোধ করে, রাগ ক্রোধ সরীসৃপের মতো গ্রাস করতে থাকে, মাগির ঘরের মাগি, খানকির ঘরের খানকি, ভণ্ড হাজি এইসব গালি দিতে গিয়ে লক্ষ করে, তার ঠোঁট দুটো তখন থরথরিয়ে কাঁপে।
হাতিরপুল বাজার ধরে হাঁটতে হাঁটতে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত যখন আসে। কারওয়ান বাজারের ভেতরে সে কোনো দিন প্রবেশ করেনি। সে হাঁটতে হাঁটতে কারওয়ান বাজারের ভেতরে প্রবেশ করে। অবাক বিস্ময়ে সে যেন এক নতুন ঢাকা প্রত্যক্ষ করে। এত এত দোকান, এত এত পাইকার, এই সবের কিছুই সে দেখেনি আজও। দুই মাস। ইসুব তখন অনুভব করে সে খুব পিপাসার্ত। পানির কথা স্মরণ হতেই নিচের ঠোঁট দিয়ে ওপরের ঠোঁট চাটে। ঠোঁট চাটতে চাটতে সে রাস্তার দুই পাশে খোঁজে। তখন তার নজরে পড়ে রাস্তার ওপরে সার দেওয়া চায়ের দোকান। তিনটি চায়ের দোকানের দোকানিকে চোখ দিয়ে যাচাই করে সে একটার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্লাস্টিকের ব্যাগে ঝোলা কেকের টুকরা, পাউরুটি, বনরুটি, বিস্কুট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করে সে একটা বনরুটি খায় আর এক কাপ চা তুলে নেয়। এই মধ্যদুপুরে ঠোঁট পর্যন্ত শুকিয়ে মলা শুঁটকির মতো খটখটে, তখন এক কাপ চা খুব অপর্যাপ্ত মনে হয়। চায়ের কাপের শেষ বিন্দু পর্যন্ত সে লেহন করে তুলে নেয়।
তখন তার মনে পড়ে, বিকেলে কোথাও গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে হলে ম্যাডাম আপা তাকে প্রায়ই কুড়ি টাকার একটা নোট এগিয়ে বলেছে-যা, ইসুব আমার দেরি হলে চা কিনে খেয়ে নিস। ম্যাডাম আপার কুড়ি টাকা থেকে বাঁচিয়ে সে দশ টাকা খেয়ে তখন সে আত্মগতভাবে বলে-কী রে জ্বালা, এই ম্যাডামে দেখি আমারে পেতি্নর মতো ধরছে। খামাখা কদ্দুর পর পর মাথার মইধ্যে ঢুইকা পড়ে ক্যান?
সারা দিন মনের ওপর দিয়ে খুব যন্ত্রণা গেছে। রাতে জসিম ভাইকে পুরা ঘটনা খুলে বলতেই জসিম ভাই পিঠ চাপড়ে বলে দিল, যাউকগা, যা হবার হইছে, আমরা তো আর এই বড়লোকগুলার সঙ্গে টক্কর দিয়া পারুম না, গরিবের লগে এইডা নতুন কোনো ঘটনা না। এইটা বড়লোকরা সব সময়ই করে, আর করব। এখন ভাত খাইয়া লঅ, দেখি তরে একটা কাম নিয়া দিতে পারি নাকি, ভাবছিলাম পুরান-ধুরান গাড়ি চাইলাইয়া হাতটা পাকুক। তারপরে ভালা দেইখা একটা মালিক জোগাড় কইরা দিমু। যাকগা, যা খা গিয়া।
জসিম ভাই, কী কইরা কী করি? চলুম ক্যামনে, খামু কী? হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে ইসুব, আমারে খামাখা মাইরটা দিল, আপনে বিশ্বাস করেন জসিম ভাই, পোলা তো না আস্তা মাস্তান। ব্যাতন না দেওনের পেলানডা বেডি কিন্তু আইজা না, এক্কেরে পরথম দিন ধইরাই করছে। খালি ডর লাগাইত-রোজ একবার শুনাইত আমি কিন্তু তর ব্যাতন থেইকা কাইটা রাখুম।
শহরের ক্ষুধার্ত কুকুরেরা
আইচ্ছা, যা ভাত খাইয়া ঘুমা। আইজ পূর্ণিমার মা তর কদু রান্না করছে চিংড়ি দিয়া। তর পছন্দের সাদা মুরগি করছে, যা খা গিয়া, আর যাইস না হ্যাগো বাসায়। ব্যাতন দিবো না বুজতেই পারতাছস। গ্যালে আবার যদি মাইরপিট করে তাইলে সমস্যা। বড়লোক গো লগে প্যাচাল করতে নাই! হ্যাগো লগে ঝামেলা দ্যাখলেই সইরা যাবি। এইটা হইলো আমার ফরমুলা। তর আর কী, এই রকম বহুত কিচ্ছা আছে আমগো জীবনে। জসিমের পাশ দিয়ে খোকা বলে-তরে তো আর পাবলিকের সামনে পিটায় নাই, আরে আমারে ব্যাতন তো দ্যায়ই নাই, পাবলিকের সামনে জুতা দিয়া পিটাইছে, তার পরও একটা রাও করি নাই, করলে তো জ্যালের ভাত খাওয়াইতো।
জসিম খোকাকে থামিয়ে দিয়ে বলে-সারা দিন নিশ্চয়ই ঠ্যাঙ্গানি আর পিটানি ছাড়া আর কিচ্ছু খাস নাইকা? যা, ভাত খা গিয়া। জসিমের কথায় ইসুব এবার ডুকরে ওঠে। ওর এই ডুকরে ওঠা দেখে জসিম ভয়ানক খেপে ওঠে। ক্ষিপ্ত হয়ে বলে
-অই চুতমারানি ভোদায়, কি শুরু করলি মাইঝ রাইতরে? মাইয়া মাইনষের মতো যদি কানবি তো আমার ঘর থেইকা বাইর হ… হালায়… যা, বাইরে গিয়া চুরি পিন্দা, ঘোমটা দিয়া বইয়া বইয়া কানগিয়া, হালার পুত, আমি কই কী আর পাবলিকে করে কী! কইতাছি যা, ভাত খা, না, চোকখের জলের বন্যা বহাইতে আইছে, যা, গা, বাইরে গিয়া কাইন্দা আস, ঘরের ভিতরে এই সব কান্দোন ফান্দোন আমার ভালো লাগে না। যা, বাইর হ… সারা দিন কাম কাজ কইরা আসনের পর এই সব প্যানপ্যানানি ভালো লাগে! জসিমের ধমকে ইসুবের কান্নার গতি থমকে যায়।
প্রত্যেক শুক্রবার রাতে জসিম মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ায়। মাসে ঘরভাড়া আর খাওয়া খরচ বাদে দুই হাজার টাকা গুনে দিতে হয় জসিম ভাইকে। যতদিন চাকরি পারমান্যান্ট না হয় তত দিন দুই হাজার টাকা দিতে হবে। জসিম ভাই নিজে ভালো খায়। সবার পাক একসঙ্গে হয়। জসিমকে সবাই মাস পহেলা ঘরভাড়া আর খাওয়ার টাকা একসঙ্গে দিয়ে দেয়। যারা ভাড়া থাকে তারা সবাই জসিম যা খাওয়ায় তাই খায়। কারো আলাদা কোনো মতামত নেই। সকালের নাশতা আর দুপুরের ভাত যার যার নিজস্ব খরচে খেতে হয়। সারা দিন কাজের শেষে রাতে ঘরে ফিরে মোটামুটি ভালো খেতে পারে জসিমের বুদ্ধি ও ব্যবস্থায়। মাসে চার দিন মুরগির মাংস আর চার দিন গরুর মাংস বরাদ্দ। বাকি দিনগুলোতে গুঁড়া মাছের সঙ্গে তরকারি। তবে ডাল আর তরকারির পরিমাণ মোটামুটি অনেক থাকে।
যেদিন মুরগির মাংস থাকে সেদিন ইসুবের মন দিল খুউব ভালো থাকে। মুরগির মাংস ইসুবের বেশি পছন্দ। জসিম ভাই বড় সাইজের একটা সাদা মুরগি কিনে আনে সব সময়। বাজার জসিম নিজে করে রোজ সকালে কাজে যাওয়ার আগে। ফার্মের মুরগিগুলোকে জসিম ভাই ডাকে সাদা মুরগি, আর দেশি মুরগিগুলোরে কালা। ঢাকা শহরে আসার আগে ইসুব কোনো দিন সাদা মুরগির মাংস খায়নি। মনে পড়ে মায়ের হাতে রান্না মুরগির মাংসের কথা। ওগুলোর নাম এখন ঢাকা শহরে দেশি মুরগি। অনেক শক্ত, রান্না করতে অনেক সময় লাগে। সাদা মুরগির মাংস রান্না করতে সময় বেশি লাগে না। পূর্ণিমার মা চুলায় বসায় আর যেন লগে লগে নামায়।
জসিমের ধমকে ইসুবের কান্নার বেগ কমে আসে। বাথরুমে নীল ড্রামে ধরা পানি লাল মগে তুলে দাঁড়িয়েই চোখ-মুখ ধোয়। হাত দিয়ে মুখের পানি পুছতে পুছতে ফিরে আসে।
রাতে বাড়ি ফিরে টেলিভিশন দেখা অথবা তাস খেলা এই দুটো জসিমের খুব প্রিয়। জসিম টেলিভিশনের মালিক। জসিম যেইটা পছন্দ করে সেইটাই দেখে। জসিম ভাইয়ের মালিক এই টেলিভিশনটা বিনা পয়সায় দিয়ে দেয় তাকে। বাসার সমস্ত টেলিভিশন বদলে যখন বড় এলসিডি ফেলাট স্ক্রিন টিভি আনে তখন ফেলে দেওয়ার বদলে জসিম ভাইকে এই পুরনোটা দিয়ে দেয়। সঙ্গে টিভি স্ট্যান্ড। এই গল্প জসিম ভাই প্রায় শোনায়।
ঘরের দরজা বন্ধ করে টেলিভিশন দেখতে দেখতে জসিম ঘুমায়। রাত এগারোটার পরে বাসায় আসলে তখন জানালার আলো অথবা টেলিভিশনের আলোয় সাবধানে ভাত খেতে হয়। ঘরে আলো জ্বালানো নিষেধ রাত এগারোটার পর। জসিম ভাইয়ের কপাল সব দিক দিয়া ভালো। ঘটনা ভিন্ন। ঘরে কতজন ভাড়া থাকে সেটা গোপন রাখার জন্য অন্ধকার করে রাখা। ড্রাইভার ও কেয়ারটেকার কোয়ার্টারে সবাই দুইজন-তিনজন রুমমেট রাখে কিন্তু কেউ এইটা কাউরে জানাইতে চায় না। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।
জসিমের ঘরে একখান মাত্র চৌকি যেটাতে জসিম শোয়। বাকি তিনজন মেঝেতে মাদুরের ওপর কাঁথা অথবা চাদর বিছায়ে। একটা টেলিভিশনের স্ট্যান্ড জসিমের চৌকির উল্টোদিকে। পূর্ণিমার মা ছোট বাটিতে মাংস আর ডালের ভাগ দিয়ে রেখে যায়। ইসুব ঘরে ঢুকে ভাতের ওপর মুরগির মাংসের তরকারি ও ডাল ঢেলে নিয়ে বিছানার কোনায় খেতে বসে। জসিম ভাই, আর খোকা ভাই খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফেলেছে ইসুব ঘরে ফেরার আগেই। গোসলখানা থেকে ফিরে ইসুব দেখে জসিম ভাই ও খোকা ভাই শুয়ে টেলিভিশন দেখে। কদুর তরকারি, মুরগির মাংসের ঝোল ডাল সব একসঙ্গে মাখায়, অন্যদিন হলে ইসুব হয়তো আগে কদুর তরকারি, তারপর মুরগির মাংস, তারপর ডাল এভাবে ভাগে ভাগে খেত। মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় ছোটবেলা থেকে ইসুবের অভ্যাস মাংসের টুকরাটা সে থালের প্রান্তে রেখে দেয়। তরকারি, ঝোল, ডাল যা কিছুই জোটে আগে সেগুলো দিয়ে ভাত শেষ করে আস্তে আস্তে সে মাংসের টুকরাটা খায় রসিয়ে রসিয়ে। আজ একসঙ্গে সব কিছু মাখায়ে মুখে ভাত দেয় কিন্তু ওর চোখ তখন ভরে ওঠে অশ্রুতে। অন্যদিন হলে ইসুব হয়তো আয়েশ করে ভাত খেত আর জসিম ভাই যতক্ষণ টেলিভিশন দেখত সেও চোখ আটকে রাখত টেলিভিশনের পর্দায়।
ইসুব আস্তে আস্তে ভাতের নেলা মুখে দেয়। মতিন ঘুমিয়ে নাক ডাকছে। টেলিভিশনের শব্দের কারণে মতিনের নাকডাকা এখনো প্রবল হয়নি। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো গড়িয়ে পড়েছে মেঝের এপাশে, যেখানে ইসুব খেতে বসেছে। এই জানালায় কোনো শিক নেই। ভারী কাঠের পাল্লা দুইটা দুই পাশে খোলা থাকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। ঘুমানোর সময় জানালা বন্ধ করে দেয় ইসুব। যেদিন থেকে ইসুব এই ঘরের রুমমেট হয়েছে সেদিন থেকে এটা ওর দায়িত্ব।
বারান্দায় টিমটিমে তিনটে বাল্ব জ্বলে। যদিও খুব ম্লান সেই আলোর কারণে ফ্যাক্টরির পেছনে ড্রাইভার অ্যান্ড কেয়ারটেকার কোয়ার্টারে যাতায়াতের পথ অন্ধকার থাকে না। আচমকা জসিমের ঘরের দরজার ওপর ধুপধাপ, দুমদাম ধাক্কা পড়ে। জসিম উঠে বসে। কপালের মাঝখানে গভীর ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুগপৎভাবে জসিমের মোবাইল বেজে ওঠে। ফ্যাক্টরির গেট থেকে সরে গিয়ে হাফিজ ফোন করেছে জসিমকে। এপাশ থেকে হাফিজ কী বলতেই হাফিজ ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে-জসিম ভাই পুলিশ গ্যাছে আপনার ঘরে, ইসুবরে খুঁজতাছে, হ্যারা খবর নিয়া আইছে ইসুবে আপনার ঘরে থাকে, হ্যায় মালিকের গাড়ি থেইকা টাকা পয়সা, সোনা গয়না চুরি করছে।
লাফ দিয়ে ওঠে জসিম। তখন আর সময় নেই জসিমের হাতে ইসুবকে সরানোর। দরজার ওপর পুলিশ। জসিম ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে কে? একদিকে সে জিজ্ঞেস করে কে? কে…রে…এত্ত রাইতরে? অন্যদিকে সে বাঁ হাত দিয়ে ইশারা করে, জানালা দেখিয়ে ইসুবকে চাপা কণ্ঠে বলে-ভাগ ইসুব, ভাগ, জানালা দিয়া ভাগ, পুলিশ আইছে তরে ধরতে, তাড়াতাড়ি ভাগ… জানালা দিয়া লাফ দে…যা…ভাগ…
দুম…ধাম…দুমদুম ধাম…দুম দুম…দুম… ক্রমাগত শব্দ হতে থাকে… ক্রমেই ধাক্কার গতি এত প্রবল হয়, মনে হয় দরজা ভেঙে পড়বে পুলিশের পায়ের ও রাইফেলের আঘাতে।
আরে হইছেটা কী? এত্ত জোরে ধাক্কান ক্যান? দরজাটা কি ভাইঙ্গা ফালাইবেন নাকি? সময় দিবেন তো বিছনা থেইকা উইঠা আইসা খুলতে বইলা? জসিম দরজা খুলে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনজন পুলিশ কনস্টেবল হামলে প্রবেশ করে জসিমকে ধাক্কিয়ে। পুলিশ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলে জসিম ইচ্ছাকৃত সুইচ অন করতে দেরি করে। ইসুব ভাতের থালা ফেলে গেছে। ভাতের থালায় তখনো অর্ধেক ভাত, থালের প্রান্তে মুরগির মাংসের টুকরা। পুলিশের বুটের আগায় ধাক্কা লেগে ইসুবের ভাতের থালা উল্টে যায়। ছড়িয়ে যায় ঘরের মেঝেতে থালের ভাত ও মুরগির মাংসের টুকরা। পুলিশরা আলো জ্বালাতে বললে জসিম অলস হাতে আলো জ্বেলে দেয়। ঘরের ভেতরে আলো জ্বলে ওঠার কারণে জানালার ওপাশে অন্ধকার ঘন হয় ওঠে। উজ্জ্বল হলদে বৈদ্যুতিক আলোর ভেতরে দ্রবীভূত হয়ে যায় চাঁদের কোমল জ্যোৎস্না।
জসিম যখন সরে দাঁড়ায় তখন বাইরে দেয়ালের ওপর ধপ করে পতনের শব্দ। ধপ শব্দের সঙ্গে ওহো…মারে …মা… চাপা যন্ত্রণা জড়ানো কাতরানি যুগপৎ মিশে যায়। প্রথমে অন্ধকার দেয়ালের ওপর, অতঃপর দেয়ালের ওপর থেকে নিচে পতন ঘটে। ফ্যাক্টরির দেয়ালের ওপর সিমেন্টের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে সরু পেরেক উল্টো করে গাঁথা নিরাপত্তার জন্য। ওপর থেকে চিৎ হয়ে পড়ার কারণে দেয়ালের ওপরের পেরেকে একেবারে গেঁথে যায় ইসুবের পৃষ্ঠদেশ। তখনই ইসুবের গলা থেকে বের হয়ে আসে মা…আ…রে… যন্ত্রণা লাঘবের চিরন্তন ডাক। পর মুহূর্তে ইসুব গড়িয়ে পড়ে দেয়ালের ওপাশে ঘন অন্ধকারে। দোতলা সমান দেয়ালের ওপর থেকে অন্ধকারে গড়িয়ে পড়ে ইসুবের মনে হয় হাত-পা সব ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। ধারালো পেরেক গাঁথার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে ওর সারা দেহ। পিঠের ওপর অগণিত ছিদ্র দিয়ে রক্তের ফিনকি। ফিনকি দিয়ে ছুটতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় বাদামি পলিয়েস্টার শার্টে। ভিজে উঠেছে ওর বাদামি শার্টের পেছনের অংশ।
ড্রাইভার অ্যান্ড কেয়ারটেকার কোয়ার্টারের পেছন দিয়ে চলে গেছে তেজগাঁও রেললাইন। রেললাইনের এপাশে আবর্জনার স্তূপ। ময়লা জমতে জমতে খালটা বদলে পচা ডোবা হয়ে গেছে। এই খালের বাতাসে এখন শহুরে আবর্জনার পচা গন্ধ। গুলশান, বনানী, মহাখালীর বহু গার্মেন্টের কুচি কাপড় ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টের উচ্ছিষ্ট সব এখানে ফেলা হয়। রাতের অন্ধকারে বেওয়ারিশ কুকুর ও রাতপ্রাণীদের আগমন বেড়ে যায় তেজগাঁও রেললাইনের এপাশে।
ইসুব আবর্জনা স্তূপের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে কঁকিয়ে ওঠে। কঁকাতে কঁকাতে উঠে দাঁড়ায়। গভীর অন্ধকারের ভেতরে ওর অবস্থান মিশে গেলেও ধরা পড়ার ভয় দূরীভূত হয় না। ভয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর এবং দাঁড়ানো থেকে দৌড়ানোর চেষ্টা করে পুনরায় ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। কয়েকটা ক্ষুধার্ত কুকুর এই আর্তশব্দে ঘেউ ঘেউ শুরু করে। অন্ধকার রাতে মানুষের পলায়নপর দশা কুকুরের বৈশিষ্ট্য প্রবল করে তোলে। শহুরে ক্ষুধার্ত কুকুরের দল হয়তো ইসুবকে কামড়ানোর জন্য এই মুহূর্তে প্রকৃত কুকুর হয়ে ওঠে। ওরা দলবদ্ধ হয়ে দাবড়াতে থাকে ইসুবকে। ডানে-বায়ে ভীত শঙ্কিত দৃষ্টি ফেলে ইসুব রেললাইনের ওপর দিয়ে দৌড়াতে থাকে কিন্তু কুকুরগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠে না আহত পা নিয়ে। ডজন খানেক কুকুর ওকে প্রায় ধরে ফেলার উপক্রম হয়। এতগুলো ক্ষুধার্ত কুকুর এই মধ্যরাতে তাকে ধরতে পারলে নিশ্চয় ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য ইসুব তখন লাফ দিয়ে পড়ে ডোবার পচা দুর্গন্ধ পানিতে। মধ্যরাতে ডোবার পানিতে ঝপাত করে ভারী একটা শব্দ হয়। সেই শব্দ লক্ষ্য করে কুকুরগুলো তখন ঘেউ ঘেউ করে চলে বিরতিহীন।