যুদ্ধ শুরুর পর যেভাবে বদলে গেছে রাশিয়া

:
: ২ years ago

রুশ আক্রমণে ইউক্রেনের চেহারা এখন বিকৃত-বীভৎস। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বেশিরভাগ শহর। কখন যেন শত্রুপক্ষের বোমা এসে পড়ে বাড়িতে, সেই ভয় নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত পার করতে হচ্ছে ইউক্রেনীয়দের। দুই মাস আগের সঙ্গে তাদের আজকের জীবনযাত্রার তফাৎ আকাশ-পাতাল, তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারছে সবাই। কিন্তু ইউক্রেনে যুদ্ধ লাগিয়ে কেমন রয়েছে রাশিয়া। সেখানকার জীবনযাত্রায় কি এর কোনো ছাপ পড়েনি? এর উত্তর দিয়েছেন মস্কোর বিবিসি সংবাদদাতা স্টিভ রোজেনবার্গ। তার লেখাটির চুম্বক অংশ জাগোনিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

মস্কোয় কোনো গোলা এসে পড়ে না। অন্য দেশের সৈন্যরা শহরটিকে অবরোধ করে নেই। ইউক্রেনের মানুষ যে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, তার ছিটেফোঁটাও মস্কোর লোকজনকে সহ্য করতে হচ্ছে না। সাদা চোখে প্রথম দেখলে মনে হবে, মস্কোর সব কিছুই স্বাভাবিক। নিত্যদিনের মতো রোজ গার্ডেন রিং সড়কে যানজট। আমার ঠিক সামনে পাতাল রেলস্টেশন থেকে পিলপিল করে বেরোচ্ছে লোক।

কিন্তু বাস্তবে দুই মাস আগের তুলনায় এই শহরের কোনো কিছুই এখন আর স্বাভাবিক বলা যায় না। রাশিয়ায় স্বাভাবিক জীবন শেষ হয়ে গেছে ২৪ ফেব্রুয়ারি, যেদিন ভ্লাদিমির পুতিন তার সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

কমিউনিস্ট রাশিয়াকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়া যে পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে তাও আমি ভেতরে থেকে দেখেছি। এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই দেশটি আবার বদলাতে শুরু করেছে।

আমি একটি সুপারমার্কেটে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠেছিলাম। অভ্যাসবশত গাড়ির রেডিও ছাড়লাম, টিউন করা রয়েছে ৯১.২ এফএম-এ। একসময় এটি ছিল ‘রেডিও একো অব মস্কো’র তরঙ্গ- আমার সবচেয়ে প্রিয় রেডিও স্টেশন, যেখান থেকে নির্ভরযোগ্য খবর পাওয়া যায়। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ায় সব স্বাধীন মিডিয়া হয় ব্লক করা নাহয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ৯১.২ এফএমে সরকারি রেডিও স্পুটনিক চলে- যেটি ইউক্রেন রুশ হামলার বড় সমর্থক।

গার্ডেন রিং দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় একটি থিয়েটার হলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যার গায়ে বিশাল আকারের ‘Z’ (জেড) অক্ষর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেটি এখন রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রতীক। রুশ রেলওয়ে সদর দপ্তরের বাইরে একই ধরনের একটি ‘Z’ বসানো হয়েছে। পাশ দিয়ে একটি ট্রাক চলে গেল, যার গায়েও ‘Z’ লেখা স্টিকার। গত কয়েক সপ্তাহে ক্রেমলিনের সমালোচক বলে পরিচিত বহু লোকজনের বাড়ির দরজায়, দেওয়ালে এই অক্ষর লেখা স্টিকার সেঁটে দেওয়া হয়েছে।

মস্কোর দোকানপাটে পণ্য ভরা থাকলেও বেচাকেনা কম। ছবি সংগৃহীত

পণ্য আছে, বেচাকেনা নেই
আমি যে শপিংমলে গেলাম, সেখানে বেচাকেনার ভিড় তেমন নেই। বিদেশি ব্র্যান্ডের অধিকাংশ দোকান বন্ধ। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর শত শত বিদেশি কোম্পানি রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। সুপারমার্কেটে জিনিসের কমতি নেই, সব তাকই ঠাসা। গত মাসে বাজারে আতঙ্ক দেখা দেওয়ায় চিনির যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেছে মনে হচ্ছে।

কিন্তু যত ধরনের জিনিস কয়মাস আগেও দোকানে পাওয়া যেত, এখন ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। গত দু’মাস জিনিসপত্রের দামও বেশ বেড়ে গেছে। শপিংমলের বাইরে কথা হয় নাদেযদা নামে এক চিকিৎসকের সঙ্গে। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়েছে যে, আমার বেতনে চলা আর সম্ভব হচ্ছে না।

তবে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর প্রথম দিকে জনমনে যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল, তা যেন এখন আর নেই।

শপিংমল থেকে বেরিয়ে মস্কোর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের দিকে রওয়ানা দিলাম, যেখানে আমি ৩০ বছর আগে ইংরেজি পড়াতাম। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে কমিউনিজমের পতনের পর এখানে আমার ছাত্ররা খুবই আশাবাদী ছিল যে, রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এবং সহযোগিতার একটি সম্পর্ক তৈরি হবে। কিন্ত বাস্তবে তা হয়নি।

ওই ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের ছাত্র ডেনিস বলেন, আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠবো। সূর্যাস্তের পর আবারও নতুন একটি সকাল আসবে। কিন্তু আমি আমাদের সৈন্যদের পাশে রয়েছি। তারা আমাদের সৈনিক। যাই হোক না কেন দেশকে সমর্থন করা আমার দায়িত্ব।

‘পুতিন আমার প্রেসিডেন্ট’ লেখা ব্যাজে প্রেসিডেন্ট শব্দটির বানানে S এর জায়গায় লেখা হয়েছে Z। ছবি সংগৃহীত

বিভ্রান্তি, বিকৃতি
মস্কোয় সেদিন আমার শেষ গন্তব্য ছিল বিশাল সামরিক জাদুঘর যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়বার্ষিকী উদযাপন চলছে। ওই যুদ্ধে ২ কোটি ৭০ লাখ সোভিয়েত নাগরিক মারা গিয়েছিল। মাতৃভূমির জন্য রুশদের আত্মত্যাগের প্রতীক হিসাবে দেখা হয় যুদ্ধটিকে।

তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’কে যেভাবে এই জাদুঘরে তুলে ধরা হচ্ছে তা নিয়ে আমার অস্বস্তি হয়েছে। জাদুঘরের ওয়েবসাইটে মিউজিয়াম শব্দটির বানান বদলে এস (S) এর জায়গায় জেড (Z) করে দেওয়া হয়েছে। জাদুঘরের ভেতর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কিত সুভ্যেনিরের দোকানে Z লেখা মগ বিক্রি হচ্ছে। ‘পুতিন আমার প্রেসিডেন্ট’ লেখা ব্যাজ বিক্রি হচ্ছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট শব্দটির বানানে S এর জায়গায় Z লেখা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, মস্কোর ওই জাদুঘরে ইউক্রেনে নাৎসিদের নিয়ে একটি বিশেষ প্রদর্শনী হচ্ছে। নাৎসিদের হাত থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করার মনগড়া স্লোগান দিয়েই সেদেশে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল রাশিয়া। ইউক্রেন তাদের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নিয়ে একটি বিকল্প সমান্তরাল আখ্যান রুশ জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, যেখানে আগ্রাসন হচ্ছে মুক্তির সংগ্রাম ও আত্মরক্ষা আর সরকারের সমালোচনা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা। আমার মনে হয়, যে রাশিয়াকে আমি ৩০ বছর ধরে চিনি, এখন তার অস্তিত্ব আর নেই।