যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় এক নারীর সন্তান প্রসবের অভিজ্ঞতা

লেখক:
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

এক মাস আগে গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে ছিলেন গাজার বাসিন্দা ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক জুমানা এমাদ। আনন্দের সঙ্গে সন্তান জন্মের অপেক্ষায় থাকা এই মা তার গর্ভাবস্থার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শেয়ার করেছিলেন।

তিনি জানতেন তার একটি মেয়ে হবে। অনাগত সন্তানের জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলেন তার স্বামীও। হাসপাতালে যাওয়ার সব প্রস্তুতিও শেষ করে রেখেছিলেন তারা। তাদের চার বছরের মেয়ে তুলিন তার বোনের আগমন নিয়ে অধীর আগ্রহে ছিল। কিন্তু মুহূর্তেই সব বদলে গেলো।

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা করে বসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। পাল্টা জবাবে গাজায় বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল, যা এখনো চলছে। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত আট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

জুমানা বলেন, আমি আমার পরিবার ও অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চরম আতঙ্কিত ছিলাম। হামলা শুরুর দুই দিন পর ইসরায়েলি নির্দেশনা মেনে মেয়ে তুলিনকে নিয়ে গাজার উত্তরাঞ্চল ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলের এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যাই।

সঙ্গে মেয়ের জন্য কেবল একটা জামা, এক প্যাকেট দুধ আর একটা ছোট ব্যাগের মধ্যে সামান্য কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে পেরেছিলেন তিনি।

ভয়েস ম্যাসেজে জুমানা বলেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার ভয়ে রাতে ঘুম হয়নি। প্রচুর গোলাবর্ষণ শুরু হওয়ায় আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হয়েছিল। আমার মতো গর্ভবতী নারীদের হাঁটতে বের হওয়া উচিত কিন্তু যুদ্ধের কারণে আমরা খাবার কিনতেও বাইরে যেতে পারছি না।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে ভয় আর উদ্বেগের পাশাপাশি বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, ইন্টারনেট বিঘ্নিত হওয়া ও পানি স্বল্পতায় জীবন পুরো ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যেই ১৩ অক্টোবর তার প্রসব বেদনা শুরু হয়।

জুমানার পরিকল্পনা ছিল গাজা শহরের বড় হাসপাতাল আল-শিফায় যাওয়া, কিন্তু তাকে জানানো হয় যে হাসপাতালটির অবস্থা খুবই খারাপ। আল-শিফার পরিবর্তে গাজা উপত্যকার মাঝখানে নুসেইরাতের একটি ছোট হাসপাতাল আল-আওদায় যেতে হয় তাকে।

কিন্তু সেখানে পৌঁছানোও ছিল কঠিন। একদিকে প্রসব বেদনা অন্যদিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছিলেন জুমানা। ট্যাক্সি চালকরা রাস্তায় নামতে ভয় পাচ্ছিলেন, তার ওপর কোনো অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যাচ্ছিল না।

জুমানা বলেন, হাসপাতালের পাশের একটি বাড়িতে তীব্র গোলাবর্ষণ হচ্ছিল, আর সেই শব্দ এতোটাই জোরে ছিল যে আমি ভেবেছিলাম গোলাগুলি হাসপাতালেই হচ্ছে। প্রতি মিনিটে একজন করে আহত মানুষ হাসপাতালে আসছিল। চারদিকে শুধু চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। ওই সময়টাতে আমি শুধু আমার বড় মেয়ের কথা ভাবছিলাম।

 

সেদিন রাতেই কন্যা সন্তানের জন্ম দেন জুমানা, যার নাম রাখা হয় তালিয়া। সেই সময়ের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জুমানা বলেন, তালিয়ার কান্না শুনে মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই এখনো বেঁচে আছি।

বাচ্চা প্রসবের পর জুমানার জন্য কোনো বিছানা পাওয়া যায়নি। ব্যথা ও রক্তপাতের মধ্যেই তাকে হাসপাতালের সোফায় শুয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। যদিও, কিছুক্ষণ পরে তিনি বিছানা পান।

আমি অনেক ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার জন্য বিছানা পাওয়া গিয়েছিল। অন্য নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর হাসপাতালের করিডোরের সোফা আর মেঝেতে শুয়ে ছিল, বলেন জুমানা।

সন্তান জন্ম দেওয়ার পরদিন একটি ভিডিও পাঠান জুমানা, যেখানে ট্যাক্সির ভেতরে সাদা কম্বলে মোড়ানো কন্যাশিশুকে নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে।

 

জুমানা বলেন, হাসপাতাল ছেড়ে পরিবারের কাছে যাওয়ার সময়টাও খুব কঠিন ছিল। বিদ্যুত না থাকায় হাসপাতালের লিফট কাজ করছিল না। ফলে প্রসব পরবর্তী ব্যথা নিয়েই সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে কোলে করে হাসপাতালের চারতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে হয়।

‘হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ি পেতেও বেগ পেতে হয়। আমরা এক ঘণ্টা ধরে ট্যাক্সি খুঁজেছি, কিন্তু কোনো ড্রাইভারই আমাদের নিতে রাজি হয়নি। সকালে গোলাগুলি হওয়ায় তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বেশি ভাড়ার বিনিময়ে একজন আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হন, কিন্তু বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নেমে যেতে হয়।

জুমানা বলেন, এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তান প্রসবের ফলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। কোনো কিছুতে মনোবল পাচ্ছেন না বলে জানান এই নারী।

 

তবে শিশু তালিয়া ভালো আছে বলে জানান তিনি। বাচ্চাটি মা-বাবা ও বোনের মিশ্র চেহারা পেয়েছে। বলেন, যুদ্ধ না থাকলে তালিয়ার জন্মের এক সপ্তাহ পর সুন্দর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। পরিবারের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতাম ও আকীকা দিতাম।

এসব কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে যান জুমানা। তিনি জানেন না, তার পরিবারের জন্য আসলে কী অপেক্ষা করছে। তবে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিতে পেরে তিনি কৃতজ্ঞ। যুদ্ধ ও মৃত্যুর এই জীবনে সন্তানরাই তার আশা বলে জানান জুমানা।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) অনুমান, গাজায় প্রায় ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছেন, যাদের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার নারী আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সন্তান প্রসব করবেন। কিন্তু স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে প্রচুর ভিড় ও ওষুধের পাশাপাশি মৌলিক সরবরাহও শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে গাজার গর্ভবতী নারীদের ভবিষ্যত।

সূত্র: বিবিসি