যাত্রী, ভাড়া, নৌযান- সবই কমেছে ঢাকা-বরিশাল রুটে

:
: ২ years ago

স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সপ্তাহ না পেরোতেই বরিশাল-ঢাকা রুটের লঞ্চের ভাড়াই শুধু কমেনি, কমেছে নৌযানের সংখ্যাও। যাত্রী কমায় বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের যাত্রীবাহী লঞ্চের সংখ্যাও কমানো হয়েছে। লঞ্চ মালিকরা বলছেন, ব্যবসায়ীক কারণে ভাড়া একটু কমানো হয়েছে। তবে এটা কোনো সমস্যা না।

প্রথম দুই-এক মাস যাত্রী একটু কম হবে। পরে আবারও স্বাভাবিক হয় যাবে। কারণ হিসেবে মালিকরা বলছেন, লঞ্চে পরিবার-পরিজন ও মালপত্র নিয়ে শান্তিতে যাওয়া যায়। বাসে সেটা সম্ভব না। যাত্রীরা লঞ্চেই ফিরে আসবেন।

পরিস্থিতি আগের জায়গায় ফিরে আনতে চেষ্টা করছেন মালিকরা। তারই অংশ হিসেবে গত এক সপ্তাহে ডেকের ভাড়া প্রায় অর্ধেক করা হয়েছে। একইভাবে প্রথম শ্রেণির কেবিনে কমেছে ৫০০ টাকা, আর দ্বিতীয় শ্রেণির সোফার ভাড়া ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে কমানো হয়েছে গত কয়েক দিনে। ভাড়া কমিয়েও যাত্রী মিলছে না লঞ্চে। প্রতিদিন গড়ে কম করে হলেও ৫০ শতাংশ যাত্রী নৌপথ থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। তারা পদ্মাসেতু হয়ে বাসে যাতায়াত করছেন।

লঞ্চ আর ভাড়া দুটোই কমেছে
প্রতিদিন বরিশাল থেকে সাতটি লঞ্চ ছেড়ে যায়। ঠিক একইভাবে ঢাকা থেকে বরিশালের পথে আসে সাতটি লঞ্চ। কিন্তু গত ৩০ জুন বরিশাল থেকে পাঁচটি লঞ্চ ছেড়ে গেলেও ঢাকা থেকে এসেছে চারটি। আর ১ জুলাই বরিশাল থেকে ছেড়েছে চারটি লঞ্চ।

লঞ্চের সংখ্যা কমার কারণ হিসেবে মালিকরা বলছেন, ঢাকা-বরিশাল যাওয়া-আসা করতে একটি লঞ্চের বিভিন্ন ফি ও তেল খরচসহ সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়। টাকা না উঠলে মালিকরা লঞ্চ চালাবেন কীভাবে? আগে একটি লঞ্চের ডেকে ৫০০ থেকে ৭০০ যাত্রী আসতেন। সেখানে শুক্রবার থেকে রবিার পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে এসেছেন ২০০ থেকে ২৫০ যাত্রী।

যদিও গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর লঞ্চগুলোর ডেকের ভাড়া ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ টাকা করা হয়েছিল। সেখানে যাত্রীসংকটে কোনো ঘোষণা ছাড়াই লঞ্চগুলো এখন ডেকের ভাড়া ২০০ টাকা, আবার কেউ কেউ ১৫০ টাকাও নিচ্ছেন। ডেকের পাশাপাশি কেবিনের ভাড়াও বেড়েছিল ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এখন তা কমিয়ে এক হাজার ২০০ টাকার কেবিন এক হাজার এবং ডাবল কেবিনে দুই হাজার ৪০০ টাকার স্থলে দুই হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। কোনো লঞ্চ ৮০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকাতেও কেবিন ভাড়া দিচ্ছে।

এমভি মানামী লঞ্চের কর্মচারী বাবুল মিয়া বলেন, তাদের লঞ্চে ডেকের ভাড়া ৩৫০ জায়গায় ২০০ টাকা করা হয়েছে। দেড় হাজার টাকার সিঙ্গেল কেবিন এক হাজার টাকা এবং ডাবল কেবিন আড়াই হাজার থেকে কমিয়ে দুই হাজার করা হয়েছে। কারণ যাত্রী আগের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। শনিবার ঢাকা থেকে মাত্র শ তিনেক যাত্রী নিয়ে বরিশালে এসেছি।

পদ্মা সেতুর কারণে যাত্রী তিন ভাগের একভাগে নেমে এসেছে বলে জানান সুরভী-৯ লঞ্চের কর্মচারী দিপু মিয়া। তিনি বলেন, সিঙ্গেল কেবিনের যাত্রী এখন বাসে চলে যাচ্ছে। তিন ঘণ্টায় ঢাকা যেতে পারছেন। তাহলে তারা কেন পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করবেন? লঞ্চের সংখ্যাও কমেছে বলে জানান কর্মচারীরা। লঞ্চের সঙ্গে ভাড়াও কমেছে। কিন্তু খরচ তো কমেনি বলে মালিকদের দাবি।

যাত্রী কমেছে ৫০ শতাংশ
বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী কয়েকটি লঞ্চের সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর পর গত কয়েক দিনে ক্রমান্বয়ে কমছে লঞ্চের যাত্রী। সরেজমিনে লঞ্চঘাট এলাকায় ২৬ জুন গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার উদ্দেশে ছয়টি লঞ্চ বরিশাল নদী বন্দর ত্যাগ করেছে। এর মধ্যে এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের ২৪০টির মধ্যে ২১৫টি কেবিনের সিট বিক্রি হয়েছে। অ্যাডভেঞ্চার-১ লঞ্চের ১৬৫টির মধ্যে ৭৫টি, এমভি কুয়াকাটা ২৫০টির মধ্যে ৭৮টি, পারাবাত-১২ তে ২৪০টি ১২০টির টিকিট বিক্রি হয়েছে। সুরভি-৭ এবং পারাবাত-৯ এর অবস্হাও একই। দুটি লঞ্চের প্রায় ৩০ শতাংশ কেবিন খালি ছিল।

২৭ জুন রাতে বরিশাল নদীবন্দর থেকে সুরভী-৯, সুন্দরবন-১০, পারাবত ১৮ ও মানামী লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কোনোটিতে ৫০ শতাংশ, কোনোটিতে ৩০ শতাংশ যাত্রী কম ছিল। শুধু ডেকের যাত্রী কম তা নয়, ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোর প্রায় অর্ধেক কেবিন খালি গেছে। এভাবে যাত্রী কমলে মালিকদের লোকসান গুনতে হবে।

২৮ জুন বরিশাল নদীবন্দরে ছয়টি লঞ্চ নোঙর করা ছিল। রাত সাড়ে ৮টার পর সেগুলো ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। কুয়াকাটা-২ লঞ্চের ২৫০টি কেবিনের মধ্যে ভাড়া হয়েছে ৭৮টি। অ্যাডভেঞ্চার-১ লঞ্চে ১৬৫টি কেবিনের মধ্যে ৭৫, পারাবত-১২-এর ২৪০টির মধ্যে ১২০ এবং সুন্দরবন-১১-এর ২৪০টির মধ্যে ১১৫টি ভাড়া হয়েছে।

এ ছাড়া সুরভী-৭ ও পারাবত-৯ লঞ্চের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদেরও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কেবিন খালি ছিল। যাত্রী কেমন হয়েছে জানতে চাইলে কয়েকটি লঞ্চের সুপারভাইজাররা জানান, যাত্রী সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম। পরবর্তিতে প্রতিদিন যাত্রী বরিশাল থেকে অর্ধেক সংখ্যক কমে আসছে। কিন্তু ঢাকা থেকে সেই সংখ্যক যাত্রী ঈদেও ছুটি কাটাতে বরিশালে আসছেন না।

লঞ্চ স্টাফরা যা বলছেন
সুন্দরবন-১০ লঞ্চের সুপারভাইজার মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, বরিশাল থেকে শুক্রবার রাতে সুন্দরবন-১০ লঞ্চ ছেড়ে যায়। শনিবার সকালে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছে। এরপর বিক্রিত টিকিট হিসাব করে দেখা যায় যাত্রী ছিল ৩৪৭ জন। এছাড়া এক-তৃতীয়াংশ কেবিন খালি ছিল। সব মিলিয়ে বলা যায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেক যাত্রী ছিল।

বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী এমভি মানামী লঞ্চের ব্যবস্থাপক রিজওয়ান হোসেন বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় শতকরা ৩০ শতাংশ যাত্রী কম উঠেছে। সাধারণত ডেকের যাত্রীরা বিকেল থেকেই লঞ্চে আসতে শুরু করেন। কিন্তু শনিবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও বরিশালগামী ঈদেও ঘরমুখো যাত্রী হচ্ছিল না। এটি প্রতিদনের প্রায় একই অবস্থা ছিল। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় যাত্রী কম যাচ্ছে।

মালিকদের বক্তব্য
বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী কুয়াকাটা লঞ্চ কম্পানির মালিক আবুল কালাম খান বলেন, ভাড়া কমিয়ে রাখা হয় ২৫০ টাকা। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী যাত্রী ছিল না। লঞ্চটিতে কেবিনে সিট সংখ্যা ২০৭টি। এর মধ্যে ১৪৩ সিট ফাঁকা ছিল। ডেকে যাত্রীও ছিল ধারণক্ষমতার অর্ধেকেরও কম। একটি লঞ্চ ঢাকা থেকে বরিশাল আসতে জ্বালানি বাবদ খরচ হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এছাড়া স্টাফদের বেতনও রয়েছে।

আবুল কালাম খান আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালুর কারণে নৌপথে যাত্রীর আগ্রহ কমছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলোচনার জন্য ২ জুলাই কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির নেতাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে নৌপথে যাত্রী ফেরাতে করণীয় ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সুন্দরবন লঞ্চের মালিক সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে যাত্রী একটু কমেছে। ব্যবসায়ীক কারণে ভাড়া একটু কমানো হয়েছে। তবে এটা কোনো সমস্যা না। আগামী দুই-এক মাস যাত্রী একটু কম হবে। পরে আবারও স্বাভাবিক হয় যাবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, লঞ্চে পরিবার-পরিজন ও মালপত্র নিয়ে শান্তিতে যাওয়া যায়। বাসে সেটা সম্ভব না।