যশোর ভবদহের জলাবদ্ধতা ১০ লাখ মানুষের দুঃখে পরিণত হয়েছে

:
: ৪ years ago

মোরশেদ আলম, যশোর প্রতিনিধি:: যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা এখন ১০ লাখ মানুষের দুঃখে পরিণত হয়েছে। ভবদহ অঞ্চলের মানুষের পিছু ছাড়ছে না দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা। এর মধ্যেই হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জলাবদ্ধতা নিরসনে তৈরি বিল খুকশিয়ার জোয়ারাধার (টিআরএম)। টানা বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চলের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয় পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকার মানুষেরা।

বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু করে গত বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত নিম্নচাপ হয়ে  মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতে অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার অন্তত ৪০টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। এই সব গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছে পানিবন্দী লক্ষ লক্ষ মানুষ।
যশোর আবহাওয়া কার্যালয় সূত্র জানায়, মে মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ১৮০ মিলিমিটার, জুনে ৩২২ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৩৫৩ মিলিমিটার ও আগস্টে ২৭৫ মিলিমিটার। এই বছর মে মাসে ২৫৮ মিলিমিটার, জুনে ৪১৫ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ২৩৭ মিলিমিটার ও আগস্টের ২৩ তারিখ পর্যন্ত ৩৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তারপরেও নিম্ন চাপের কারনে মাঝারি ধরনের বর্ষা হচ্ছে।  এতে করে পানি আরো অনেক দ্রুত বাড়ছে।

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। অভয়নগর উপজেলা ভবানীপুর গ্রামে শ্রী নদীর ওপর নির্মিত ভবদহ স্লুইসগেট দিয়ে মূলত এলাকার ৫৪টি বিলের পানি নিষ্কাশিত হয়। পলি পড়ে এলাকার পানিনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এতে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃষ্টির পানিতে এলাকার বিলগুলো তলিয়ে গেছে। বিল উপচে পানি ঢুকেছে বিলসংলগ্ন গ্রামগুলোতে।

ভবদহ স্লুইসগেট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের কার্যসহকারী ফারুক আহমদ মোল্যা জানান, ভবদহ স্লুইসগেটের ২১ কপাটের সব কটি পলিতে তলিয়ে গেছে। সেগুলোর পলি পরিষ্কার করার কাজ চলছে। এখন নদী দিয়ে প্রবল জোয়ার আসছে। ফটক দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকছে। কিন্তু ভাটায় কম পানি বের হচ্ছে।পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন ভবদহ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ। পানিবন্দী মানুষদের কেউ কেউ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু সড়কে। অনেক পরিবার ঘরের মধ্যে মাচা করে সেখানে থাকছে।

অভয়নগর উপজেলার, ডুমুরতলা, বারান্দী, দিঘলিয়া, ডহর মশিয়াহাটী, রাজাপুর, সুন্দলী, ভাটবিলা, সড়াডাঙা, হরিশপুর, ফুলেরগাতী, দামুখালী, দত্তগাতী, এবং মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা, সুজাতপুর, কুলটিয়া, লখাইডাঙ্গা, মহিষদিয়া, আলীপুর, পোড়াডাঙা, পদ্মনাথপুর, পাড়িয়ালী, দহাকুলা, কুচলিয়া, পাঁচকাটিয়া, ভুলবাড়িয়া, কুমারসীমা, কপালিয়া, পাচাকড়িসহ আরও কয়েকটি গ্রামের কোথাও আংশিক আবার কোথাও বেশির ভাগ বাড়িতে পানি উঠে গিয়েছে।।

কয়েকটি এলাকা ঘুরে মানুষের চরম দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে গ্রামগুলোর শত শত বাড়িতে পানি উঠেছে। রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় এলাকার অনেক জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি থেমে গেলেও প্রতিদিন এক-দুই ইঞ্চি করে পানি বাড়ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মণিরামপুর উপজেলায় হাটগাছা গ্রামের ধ্রুবা বৈরাগীর বাড়িতে হাটু সমান পানি, হবে বর্ষা অল্প হচ্ছে কিন্তু পানি বাড়তেই আছে। বর্ষা না হলেও ধীরে ধীরে পানি বাড়ছে। তারা উঠানে বাসের ও কাঠের সাকো তৈরি করেছে। সুজাতপুর গ্রামের সুকুমার দাস রাস্তা থেকে ঘরে যাতায়াতের জন্য বাঁশের সাঁকো তৈরি করছে। তিনি বলেছে, ‘উঠোনে দেড় হাত আর ঘরের মধ্যে এক বিঘত জল। ঘরের মধ্যে ইট দিয়ে খাট উঁচু করে সেখানেই থাকছি। কিন্তু জল যেভাবে বাড়ছে তাতে বেশি দিন ঘরে থাকা যাবে না।

অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলা গ্রামের কৃষক শিবপদ বিশ্বাস বলেন, ‘গ্রামের এক শর বেশি বাড়িতে জল উঠে গেছে। ঘরের মধ্যে ইট দিয়ে খাট উঁচু করে সেখানেই থাকছি। আর একদিন ভারী বৃষ্টি হলে রাস্তায় উঠতে হবে।’
অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, সুন্দলী ইউনিয়নে ১৪টি গ্রাম। এর মধ্যে ১২টি গ্রামের আংশিক বাড়িঘরে পানি উঠেছে। এলাকার বিলগুলো আগে থেকেই জলাবদ্ধ হয়ে আছে। এসব বিলে এবার কোনো আমন ধান হয়নি।

উপজেলার চলিশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাদির হোসেন মোল্যা বলেন, ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের অনেক বাড়িতে পানি উঠেছে। এর মধ্যে তিনটি গ্রামের অবস্থা খারাপ।
মনিরামপুর উপজেলার হরিদাসকাটি ইউপি চেয়ারম্যান বিপদ ভঞ্জন পাঁড়ে বলেন, তাঁর ইউনিয়নে ২২টি গ্রাম। ৮টি গ্রামে পানি ঢুকেছে, এর মধ্যে ৫টি গ্রামের অবস্থা বেশ খারাপ।

ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালী বলেন, ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে এলাকার ৪০টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। জোয়ারাধার ছাড়া জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, গত বছর ১০ কিলোমিটার নদীর পাইলট চ্যানেল খনন করা হয়। খননের পর পলিতে নদী হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তেশ্বরী নদীর ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার এবং ভবদহ স্লুইসগেটের উজান ও ভাটিতে শ্রী নদীতে ২০০ মিটার করে ৪০০ মিটার খননের কাজ চলছে।

তিনি জানান, ভবদহের একটি অঞ্চলের পানি আমডাঙ্গা খাল হয়ে ভৈরব নদে যায়। কিন্তু এবার ভৈরব নদে অনেক উচ্চতায় জোয়ার আসছে। এতে পানিনিষ্কাশনের পরিবর্তে ভৈরব নদ থেকে আমডাঙ্গা খাল দিয়ে উল্টো পানি ঢুকছে। এ জন্য আমডাঙ্গা খালের ওপর অবস্থিত ছয় কপাটের স্লুইসগেট বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলে পানি জমে গেছে। জোয়ারের চাপ কমে গেলে দুই-এক দিনের মধ্যে আমডাঙ্গা খাল দিয়ে পানি নেমে যাবে।

যশোরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, গত বছর খনন করা পাইলট চ্যানেল ভরাট হয়ে গেছে। ভবদহ এলাকার পাঁচ-ছয়টি বিলের পানি ভৈরব নদে যায়। কিন্তু এবার ভৈরব নদে অনেক উচ্চতায় জোয়ার আসছে। এজন্য আমডাঙ্গা খালের ছয় কপাটের স্লুইস গেট বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলে প্রায় সাড়ে নয় ইঞ্চি পানি জমে গেছে।