যশোরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের দাফন সম্পন্ন, বাস চালককে পুলিশে সোপর্দ

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

যশোর-মাগুরা মহসড়কে যাত্রীবাহী বাসের চাপায় মারা যাওয়া ইজিবাইকের সাত যাত্রীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার (৮ জুলাই) বাঘারপাড়ার যাদবপুরে স্থানীয় একটি বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তিনজন, সেকেন্দারপুর গ্রামে দুই জন, মথুরাপুর গ্রামে একজন এবং যশোর সদরের সুলতানপুর একজনকে দাফন করা হয়।

নিহতদের দাফনের যখন কাজ চলছে তখন ঢাকা থেকে খবর আসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হেলাল মুন্সির স্ত্রী সোনিয়া মারা গেছেন। ওই দুর্ঘটনায় হেলাল মুন্সির পরিবারের আগেই পাঁচজন মারা যান।

 

গতকালের সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় যশোর কোতয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর মুন্সিপাড়ার আব্দুল মান্নান মুন্সির ছেলে ছোটন হোসেন রয়েল ডিলাক্স নাম বাসের (ঢাকা মেট্টো-ব-১৪-৩৮৭৬) চালকের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন।

এদিকে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত রয়েল ডিলাক্সের চালক মিজানুর রহমানকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন যশোর পরিবহণ শ্রমিক ও মালিক সমিতির নেতারা। শনিবার সন্ধ্যার দিকে মিজানুর রহমানকে তারা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন।

শনিবার নিহতদের জানাজায় ঢল নামে শোকার্ত মানুষের। একসঙ্গে এতোগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ায় গোটা এলাকা শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া নিহতদের পরিবার গুলোতে বিরাজ করছে সুনসান নিরবতা। শোকে বাকরুদ্ধ স্বজনরা। সবাই যেন পাথর হয়ে গেছেন।

 

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার তেঁতুলতলা বাজার এলাকার যশোর-মাগুরা মহাসড়কে একটি ইজিবাইককে চাপা দেয় যাত্রীবাহী বাস। এতে তিন শিশু, নারীসহ সাতজন মারা যান। আজ মারা যান হেলাল মুন্সির স্ত্রী সোনিয়া। মারা যাওয়াদের মধ্যে একই পরিবারের ছয়জন রয়েছেন। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছে দুইজন।

নিহতরা হলেন- যাদবপুর গ্রামের হেলাল মুন্সির দুই জমজ ছেলে হাসান (২) ও হোসাইন (২), হেলাল মুন্সির স্ত্রী সোনিয়া, হেলাল মুন্সির শাশুড়ি মাহিমা (৪৩), খালা শাশুড়ি রাহিমা খাতুন ও তার মেয়ে জেবা (৮), মথুরাপুর গ্রামের ওবায়দুর রহমানের ছেলে ইজিবাইক চালক মুসা (২৭), সদর উপজেলা সুলতানপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে ইমরান হোসেন (২৬)।

আজ সকালে বাঘারপাড়ার যাদবপুরে নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়িতে নিরবতা। গতকাল রাতেই বাড়িতে পৌঁছায় নিহত হেলাল মুন্সির জমজ দুই ছেলে ও শ্বাশুড়ির মরদেহ। হেলাল মুন্সির খালা শাশুড়ি ও তার মেয়ে জেবার মরদেহ পাঠানো হয় পাশ্ববর্তী গ্রাম মথুরাপুরে। হেলাল মুন্সি ঢাকার একটি গার্মেন্সে চাকরি করেন। ঘটনার সকালে তিনি ঢাকাতে চলে যান। ঢাকায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারেন দুর্ঘটনার কথা।

হেলাল মুন্সির স্ত্রী সোনিয়া আজ ঢাকায় মারা যান

 

দুই সন্তানসহ নিকট আত্মীয়দের হঠাৎ চলে যাওয়া হেলাল মুন্সি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। পরিবারের এমন পরিণতিতে নির্বাক হয়ে গেছেন তিনি।

কাঁদতে কাঁদতে হেলাল মুন্সি বলেন, ‘কত সাজানো সংসার ছিলো আমার। হাসি খুশির সংসার। একটা দুর্ঘটনায় সব শেষ। আমার কলিজার হাসান-হোসেন কই, তাদের ছেড়ে আমি কিভাবে থাকবো। স্ত্রীটা আজ আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। কি হবে আমার। যাদের সুখের জন্য আজ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় কাজ করি; তারাই আজ নেই। সব শেষ রে আল্লাহ…..।’

 

হেলাল মুন্সির চোখে সন্তান, স্ত্রী ও স্বজন হারানোর পানি  দেখে আশেপাশের লোকজনও শান্ত থাকতে পারেননি। উপস্থিত অনেকই হেলাল মুন্সিকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়।

নিহত সোনিয়ার চাচা ছোটন হোসেন বলেন, ‘খাদিজার গলায় টিউমার ছিল। এটি অপারেশনের জন্য গতকাল শুক্রবার বিকেলে তারা বাড়ি থেকে ইজিবাইকে যশোরের একটি ক্লিনিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে লেবুতলা এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া গতির একটি বাস তাদের চাপা দিয়ে কিছু দূর সামনে নিয়ে যায়। এতে আমাদের পরিবারের ছয় জন মারা যান। আমার ভাইঝি সোনিয়া ও তার মেয়ে খাদিজা গুরুতর আহত হন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল রাতেই সোনিয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও সোনিয়াকে বাঁচানো গেল না।’

একই উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের সেকেন্দারপুর গ্রামে প্রবাসী সাইদুল ইসলামের বাড়িতেও দেখা যায় শোকের মাতম। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে সেখানে।

সাইদুল ইসলামের বড় ভাই সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম জানান, রাহিমা বেগম মুক্তা ও তার মেয়ে জেবা তাহিরা স্বজনদের সঙ্গে যশোরে ক্লিনিকে যাওয়ার পথে মারা যান। তার ভাই সাইদুল ইসলাম মালয়েশিয়া প্রবাসী। মাস দুয়েক আগে তিনি দেশে এসেছিলেন। সাইদুলের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে সুমাইয়া শিরিন ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেজো মেয়ে রিফা তামান্না পঞ্চম শ্রেণিতে এবং জেবা তাহিরা এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়।

জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, ‘এই ইউনিয়নে এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। একই পরিবারে ছয়জনসহ ৮ জন মারা যাওয়াতে ইউনিয়ন জুড়েই শোকের ছাঁয়া নেমে এসেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসবের সঙ্গে জড়িত বেপরোয়া ড্রাইভাররা। আইনের ফাঁকে তারা বেঁচে যাচ্ছেন। আশা করি এই ঘটনায় জড়িত ড্রাইভারের বিরুদ্ধে আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।’

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, ‘লেবুতলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ইজিবাইক চালকসহ অনেকেই নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একই পরিবারের ৬ জন রয়েছেন। বাস ও ইজিবাইকটিকে পুলিশ জব্দ করেছে।

এদিকে, গতকালের সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় যশোর কোতয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। বাঘারপাড়া উপজেলার যাদবপুর মুন্সিপাড়ার আব্দুল মান্নান মুন্সির ছেলে ছোটন হোসেন রয়েল ডিলাক্স নাম বাসের (ঢাকা মেট্টো-ব-১৪-৩৮৭৬) চালকের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন।যশোর কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ডিলাক্স পরিবহনের চালক মিজানুর যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার পাঠান পাইকপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে।

মামলার এজাহারে ছোটন হোসেন উল্লেখ করেছেন, গতকাল শুক্রবার বিকেল সোয়া ৬টার দিকে খাজুরা বাজার থেকে ইজিবাইক চালক ইমরান হোসেন মুন্নাকে সঙ্গে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা যশোরে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে খাজুরা বাজারে পৌঁছালে রয়েল ডিলাক্সের ওই বাস বেপরোয়া গতিতে এসে ইজিবাইকটি চাপা দেয়। এতে বাসটিও উল্টে যায়। এ ঘটনায় সাতজন নিহত হন। আহত সোনিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। সোনিয়া ঢাকায় মারা যান।

যশোর পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু জানান, লেবুতলায় যে ঘটনা ঘটেছে সেটি মার্মান্তিক ও হৃদয় বিদায়ক। এই ঘটনার সঙ্গে বাস চালক জড়িত কি-না তা তদন্ত করছে পুলিশ। পুলিশকে সহযোগিতার জন্য বাস চালক মিজানুর রহমানকে তাদের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে।

 

তিনি আরও জানান, মহাসড়কে ইজিবাইক, নসিমন, কমিরন, আলমসাধু, থ্রি-হুইলারসহ নানা গতির যানবাহন চলাচল করে। ফলে রাস্তায় বাস, ট্রাক ও অন্য কোনো দ্রুত গতির যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। যশোরের শ্রমিক সংগঠন গুলো ওইসব পরিবহন মহাসড়কে যাতে চলাচল করতে না পারে এজন্য নানা আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। দাবি করা হয়েছে-ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন তৈরি করার। কিন্ত সে দাবি কখনো পূরণ হয়নি। ফলে দুর্ঘটনা লেগেই আছে। এছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করার কিন্তু সে নির্দেশনাও পালন হচ্ছে না।

মিঠু দাবি করেছেন, দুর্ঘটনা রোধে, মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য অবিলম্বে মহাসড়কে ছোট বা কম গতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। তা না হলে দুর্ঘটনা রোধকরা যাবে না।