‘মেয়ে পঙ্গু হয়ে গেল, এখন আমি কী করব’

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

সংসারে অভাব, তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি রোজিনা আক্তার। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। তারপর শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয়। আট বছর আগে পেটের তাগিদে ঢাকায় আসেন তিনি। গৃহকর্মীর কাজে মাস শেষে যা পান, ময়মনসিংহের এক প্রত্যন্ত গ্রামে পাঠিয়ে দেন দরিদ্র বাবাকে। তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। কে জানত, সেই রোজগেরে মেয়েটির পা পিষ্ট হবে বাসের চাকায়! পা হারাতে হবে তাকে চিরদিনের জন্য! শুক্রবার রাত ৯টায় বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় বিআরটিসির একটি বাস বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তার ডান পায়ের হাঁটুর উপর থেকে।

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ডি ওয়ার্ডের ৮০ নম্বর বিছানায় চিকিৎসাধীন রোজিনা। পা হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন ২২ বছরের রোজিনা। এখনও অবিবাহিত তিনি। বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গুসাগাঁওয়ে। বাবার নাম রসুল মিয়া। ছয় বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় রোজিনা।

তিন কাঠার ভিটে ছাড়া কিছুই নেই রোজিনার বাবার। দিনমজুরি করতেন এক সময়। সাত সন্তান ও স্ত্রী মিলিয়ে ৯ সদস্যের সংসার একার পক্ষে চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে তার। সংসারের হাল ধরতে তাই মেয়েকে ঢাকায় পাঠান গৃহকর্মীর কাজ করতে। সেই থেকে গুলশানের নিকেতনে জি-টিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে আসছেন তিনি। থাকেন এই বাসাতেই। ছুটির দিন ঢাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যান মাঝেমধ্যে। এতে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর কোনো বাধা ছিল না কখনও। কারণ দীর্ঘদিন তাদের বাসায় থাকায় পরিবারের সদস্যই ভাবেন তারা তাকে। শুক্রবার বিকেলে তিনি বনানী এলাকায় এক বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে যান। রাত ৯টার দিকে সেখান থেকে নিকেতনের বাসায় ফেরার জন্য চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় মতিঝিল থেকে গাজীপুরগামী বিআরটিসি পরিবহনের বেপরোয়া গতির একটি ডাবল ডেকার বাস চাপা দেয় তাকে। সামনের চাকায় পিষ্ট হয়ে যায় তার ডান পা। হাঁটুর উপর থেকে নিচের অংশ চামড়ায় ঝুলছিল কোনো রকমে। এ অবস্থায় কয়েকজন পথচারী তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান পঙ্গু হাসপাতালে। চামড়ায় ঠেকে থাকা পা’টা শরীরের সঙ্গে রাখা সম্ভব হয়নি তার। বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হয় হাঁটুর উপর থেকে।

গতকাল বিকেল ৩টার দিকে পঙ্গু হাসপাতালের ডি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ৮০ নম্বর বেডে ঘুমাচ্ছেন রোজিনা। শরীরে স্যালাইন চলছে। রক্ত দেওয়ার প্রস্তুতিও চলছিল তখন। ব্যান্ডেজ করা কাটা পা বালিশের উপর রাখা। ডান হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন। বেডের পাশে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে আছেন তার বাবা। মেয়ের দুর্ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে গলা ধরে আসে তার- ‘রাতে খবর পাওয়ার পরই গ্রামের বাড়ি থেকে ছুটে আসি হাসপাতালে। গভীর রাতে যখন পৌঁছাই, মেয়ের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তখন শরীর থেকে। রাতেই মেয়েটা বলেছিল- আব্বা, আমার পা নাই। পঙ্গু হয়ে গেলাম! এখন আমার কী হবে? রাস্তা পার হওয়ার সময় দোতলা একটি বাস আমাকে চাপা দেয়। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই।’

রসুল মিয়া জানান, তিনি ও তার স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। কাজ করতে পারেন না এখন। রোজিনা মাসে ৯ হাজার টাকা বেতনে গৃহকর্মীর কাজ করেন। বেতনের টাকা প্রতি মাসে বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন। এ টাকা দিয়েই কোনো রকমে চলে সংসার ও বাবা-মায়ের চিকিৎসা। এতে সংসারে টানাটানি হওয়ায় বছরখানেক আগে সেজো মেয়ে ১৬ বছরের তানজিলাকে নিকেতনে একটি বাসায় ৬ হাজার টাকা বেতনে কাজে দেন। দুই বোনের ১৫ হাজার টাকায় বেশ ভালোই চলছিল তার। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বাড়ি থাকে তিন মেয়ে ও ৮ বছরের এক ছেলে। পড়ালেখা করে তারা।

রোজিনার গৃহকর্তা জিটিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘প্রায় আট বছর ধরে রোজিনা আমার বাসায় কাজ করে। পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছিল সে। সামর্থ্য অনুযায়ী রোজিনার দায়িত্ব পালন করব আমি।’

রোজিনার পা হারানোর ঘটনায় শুক্রবার রাতেই বনানী থানায় চালক শফিকুল ইসলামকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার এসআই মিজানুর রহমান জানান, ‘ঘটনার পরপরই বাস জব্দ ও চালক শফিকুলকে আটক করা হয়েছে। পরে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। গতকাল সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পাঠানো হয়েছিল আদালতে। একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে।’

হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময় রসুল মিয়া জানালেন, ‘এখন আমি কী করব? মেয়ে পঙ্গু হয়ে গেল! কীভাবে চালাব সংসার? মেয়েটিরই বা কী হবে!’

কাকুতি মেশানো রসুল মিয়ার সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে না। শুধু হাসপাতালের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে তার কাছে।

রোজিনার পাশে থাকার আশ্বাস সড়ক সচিবের :বিআরটিসির বাসচাপায় পা হারানো রোজিনার চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থাটি। গতকাল দুপুরে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোজিনাকে দেখতে যান সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলাম ও বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া। এ সময় সড়ক পরিবহন সচিব রোজিনার চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেন বিআরটিসির পক্ষ থেকে। সচিব জানান, প্রয়োজনে ভবিষ্যতে আরও সহায়তা করা হবে। বিআরটিসির চেয়ারম্যান জানান, রোজিনাকে ধাক্কা দেওয়া বাসের চালক গ্রেফতার হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।