অসুস্থ মেয়ে নবজাতককে চিকিৎসার জন্য ক্লিনিকে ভর্তি করেছিলেন মা। আশা ছিল সুস্থ সন্তানকে নিয়ে ঘরে ফিরবেন তিনি। কিন্তু পাঁচ দিনের মাথায় তার কোলে তুলে দেওয়া হলো মৃত শিশু।
বুকে পাথর বেঁধে সন্তানের লাশ নিয়ে ঘরে ফিরলেন তিনি। নোয়াখালীর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর দাফনের সময় দেখা যায় ছেলে শিশুর মরদেহ। এতেই গণ্ডগোলটি ধরা পড়ে। তবে অনেক নাটকীয়তার পর জীবিত নবজাতক ফিরে পান মা রোকসানা আক্তার।
এমন ঘটনার জন্ম দিয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার গোলপাহাড় মোড়ের চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিক। এ বেসরকারি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে নবজাতক নিয়ে লুকোচুরির অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে শিশুটি বেসরকারি রয়েল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
জানা যায়, গত ১৩ এপ্রিল নোয়াখালীর মাইজদীতে প্রথম সন্তানের জন্ম দেন রোকসানা আক্তার। অসুস্থতার কারণে ওইদিনই তিনি কন্যাশিশুটিকে প্রথমে নোয়াখালীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে নগরীর গোলপাহাড়ের চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
সেখানে ভর্তি থাকাকালে বেসরকারি রোগ নিরূপণ কেন্দ্র শেভরন ও ট্রিটমেন্ট রিপোর্টে শিশুটিকে কন্যাশিশু হিসেবে উল্লেখ ছিল। গত মঙ্গলবার সকালে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করে তুলে দেওয়া হয় মায়ের হাতে। নোয়াখালীর গ্রামের বাড়ি বেগমগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয় মৃত শিশুটিকে। দাফনের আগে গোসল করানোর সময় তারা দেখতে পান ছেলের মরদেহ।
তারপর ফের তারা অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। অভিযোগ দেন নগরীর পাঁচলাইশ থানায়। রোকসানার অনেক অনুরোধের পর নেওয়া হয় জিডি।
রোকসানা আক্তার বলেন, ‘ওই শিশুর মরদেহ নিয়ে আমরা সারারাত অ্যাম্বুলেন্সে বসেছিলাম থানার সামনে। বুধবার ভোরে মেয়ে পাওয়ার কথা জানানো হয়। বলা হয় আইসিইউতে পাশের সিটের শিশুর সঙ্গে বদল হয়েছে। সকালে একটি অ্যাম্বুলেন্সে এসে ছেলের মরদেহ নিয়ে যায়, পরে আমার মেয়েকে ফেরত দেয় চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিক।’
তিনি আরও বলেন, চাইল্ড কেয়ার নাম দিলেও সেটি টাকা বানানোর মেশিন ছাড়া কিছু নয়। আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা যেন আর কোনো মায়ের সঙ্গে না হয়। ওদের আইসিইউতে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। তারা হয়তো আমার বুকের ধনকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। আমি এ ঘটনায় জড়িত ডাক্তারসহ চাইল্ড কেয়ারের সবার শাস্তি চাই।
রোকসানার ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, মঙ্গলবার রাতেই তারা ওই মরদেহ নিয়ে হাসপাতালে যান। পাঁচলাইশ থানায়ও অভিযোগের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাতেই মৃত ছেলেটিকে নিয়ে তাদের মেয়েকে অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করে। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে বলেও জানান জাহাঙ্গীর।
শিশুটির চাচা আলমগীর হিরু বলেন, আমার ভাই মহিউদ্দিন দুবাই প্রবাসী। তাদের বিয়ের ৫ বছর পর প্রথম বাচ্চা হয়। সেটি চুরি করে আমাদের সঙ্গে চরম প্রতারণা করেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, এ ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালককে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঁচলাইশ থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রাথমিকভাবে সাধারণ ডায়েরি নিয়ে বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছিলাম আমরা। আদালতের অনুমতি নিয়ে আমরা শিশুটির ডিএনএ টেস্ট করে মামলা নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথাও ওই মাকে জানিয়েছিলাম। ভাগ্য ভালো মেয়েটিকে তার মায়ের কোলে জীবিত ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।
এ ব্যাপারে চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিকের পরিচালক ডা. ফাহিম হাসান রেজা বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে ঘটনাটি ঘটেছে। পরে আমরা প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে যার মেয়ে তাকে ফেরত দিয়েছি।
ঘটনা শুনে রয়েল হাসপাতালে আসেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ প্রতিনিধি আমিনুল হক বাবু। তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে চাইল্ড কেয়ার কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত থাকতে পারে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
রয়েল হাসপাতালের আইসিইউতে নবজাতককে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ডা. বিধান রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, শিশুটি বেশ অসুস্থ। জন্মের পর ব্রেনে অক্সিজেন পৌঁছেনি। খিঁচুনি ও ইনফেকশন আছে। আমরা মেডিকেল বোর্ড গঠন করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।