কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে স্পেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে একসাথে এত মৃত্যু দেখেনি স্প্যানিশরা। লাশের মিছিল বড়ই হচ্ছে দেশটিতে। ২৪ ঘণ্টায় ৮৩২ জনের মৃত্যুও দেখতে হয়েছে দেশটিকে। এ নিয়ে দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৯০ জনে (শনিবার রাত পর্যন্ত)।
বলা হচ্ছে স্পেন হলো এখন এই মহামারির ‘হটস্টপ’। চীনের উহান থেকে শুরু করে গেল চারমাস এই খেতাব ইরান থেকে ইতালি হয়ে এখন গেছে স্পেনের ঘরে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে একদিকে এই খেতাব যেমন ঘুরছে তেমনি শঙ্কা জাগছে- পরের দেশ কোনটা।
কিন্তু স্পেন ভুলটা কী করেছিল? চীন এবং ইরানে কী হয়েছে স্পেন তা দেখেছে। কাছেই থাকা ইতালির দশা থেকে দেশটি স্পষ্ট দেখেছে কত দ্রুততার সাথে কী ভয়ঙ্করভাবে এ ভাইরাস ইউরোপে বিস্তার লাভ করলো।
ইতালি স্পেনের কাছের দেশ বলেই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস স্পেনে এতটা বিস্তার লাভ করেছে- এমন কথা বলে ফেলারও সুযোগ নেই। কারণটা হলো- ইতালির সাথে স্পেনের কোনো স্থলসীমানা নেই। আবার ইতালির সাথে স্থলসীমানা থাকার পরও ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও স্লোভেনিয়ার অবস্থা স্পেনের চেয়ে অনেক ভালো।
আবার হতে পারে ইতালির সাথে এই স্থলসীমানাটা না থাকাটাই কাল হয়েছে স্পেনের জন্য। কারণ তারা হয়তো ভেবে বসেছিল- তারা বেশ দূরেই আছে। ৯ ফেব্রুয়ারি মাদ্রিদে স্পেনের হেড অব মেডিকেল এমার্জেন্সি ড. ফার্নােন্দো সিমন যা বলেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, পরিস্থিতি স্পেনের হাতেই থাকবে। ৬ সপ্তাহ পর সেই সিমনের মুখ থেকেই দিনে কয়েক শ করে মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে।
১৯ ফেব্রুয়ারি ইতালির বারগামো শহরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল স্পেনের ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া এবং ইতালির ক্লাব আটলান্টা। ভ্যালেন্সিয়ার আড়াই হাজার ভক্ত ও আটলান্টার ৪০ হাজার সমর্থক স্টেডিয়ামে এক সাথে বসে এই ম্যাচ দেখেছিল। এই ম্যাচটিকে বারগামো শহরের মেয়র জর্জিও গোরি ‘দ্য বোম্ব’ বা বিস্ফোরক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, এ ম্যাচ থেকেই বিস্ফোরণের মতো করে ভাইরাস ছড়িয়েছে লম্বার্দিতে।
স্পেনে করোনা ভাইরাসের বিস্তারের শুরুর দিকে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ভ্যালেন্সিয়া খেলোয়ার, ক্লাবটির সমর্থক ও ওই ম্যাচ কভার করা সাংবাদিকরা।
আবার স্পেনে এত দ্রুত ভাইরাসটির এভাবে ছড়িয়ে পড়ার জন্য সেখানকার আবহাওয়া, মানুষের জীবনযাত্রা, ঐতিহ্যও ভূমিকার রেখেছে বলে মনে করা যায়। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে, বা মার্চের শুরুর দিকে, সময়টা বসন্তকাল, আকাশ থাকে পরিষ্কার, তাপমাত্রা মোটামুটি ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর থাকে। মাদ্রিদের ফুটপাতের ক্যাফে এবং বারগুলোতে একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। এভাবে হাসিখুশি থাকাটাই মাদ্রিদের মানুষরা পছন্দ করে। খুব কাছাকাছি বসে একজনের সাথে আরেকজনের গল্প করার দৃশ্য সেখানে খুবই পরিচিত, আবার সামাজিকতার অংশ হিসেবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরার চলও রয়েছে স্প্যানিশদের।
স্পেন লকডাউনে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে, ৮ মার্চ সেখানে স্পোর্টস ইভেন্ট, রাজনৈতিক দলের সম্মেলন এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বড় আয়োজন করা হয়েছিল। এর তিনদিন পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আরেকটি ম্যাচ দেখতে অ্যাটলেটিকো ডি মাদ্রিদের ৩ হাজার সমর্থক যান লিভারপুলে।
পেদ্রো শানচেজের নেতৃত্বাধীন স্পেনের সরকার করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কাজ শুরু করেছিল ধীরগতিতে, তার সাথে ছিল কার্যকারিতার ঘাটতি। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রেরও সঙ্কট ছিল দেশটিতে। ভেন্টিলেটর, চিকিৎসকদের সুরক্ষামূলক পোশাক ও করোনাভাইরাস টেস্ট কিটের মতো উপকরণগুলো এখনও অন্য কোথা থেকে আনা হচ্ছে। পুরো পরিস্থিতিতে খলনায়ক থেকে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে চীন। কারণ বেলা শেষে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট আসছে সেই চীন থেকেই। আর চীন থেকে এই ইকুইপমেন্ট পেতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে সেখানকার চীনা কমিউনিটি। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল যেহেতু চীন, তাই মানুষজনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় এই চীনা কমিউনিটির মানুষদেরই স্পেনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখতে হয়েছিল।
স্পেনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে এই ভাইরাসের কারণে সেটিও ধরা পড়েছে। দেশটির বৃদ্ধাশ্রমগুলোর ব্যবস্থাপনাতেও বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। যার কারণে এগুলো প্রয়োজনীয় কর্মীর অভাব রয়েছে, কোনো সমস্যা মোকাবিলায় সেগুলো অপ্রস্তুত। আবার খরচ কম হওয়ার কারণে সেগুলোতে মানুষের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার স্পেনে লকডাউন শুরুর পর এমন কিছু বৃদ্ধাশ্রম জীবাণুমুক্ত করতে গিয়ে দেশটির সেনাসদস্যরা দেখেন- বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে অসুস্থ মানুষেরা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছেন৷ কয়েকজনের মরদেহও উদ্ধার করা হয়।
স্পেনের প্রাইমারি কেয়ার সিস্টেম (স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অংশ) বেশ উন্নত হলেও দেশটিতে চলে আসা বহুদিনের আর্থিক সমস্যার কারণে সেখানকার হাসপাতালগুলোকেও একধরনের সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে মাথাপিছু সেখানে যত বেড দরকার রয়েছে তার তিনভাগের একভাগ। সেগুলোর পেছনেও হাত রয়েছে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার। এরপরও এ হার যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি।
শানচেজ যখন জরুরি অবস্থা জারি করবেন বলে ঘোষণা দিলেন তারপরও সেটা শুরু করতে তিনি ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছেন।আর এ সময়টাতেই মূলত মাদ্রিদ ও অন্য আরও কিছু শহর থেকে মানুষ অন্য শহরে ছড়িযে যাওয়ার সময় পেয়ে যায়।
এছাড়া সমন্বয়ের অভাবও ছিল। মাদ্রিদের স্থানীয় সরকার স্কুল এবং ইউনিভার্সিটি এক সপ্তাহ আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। যার ফলে দেখা গেল সেখানে বেশ ছুটির একটা ইমেজ তৈরি হলো এবং দেখা গেল বার্ক এবং পার্কগুলো লোকে লোকারণ্য। অনেকে ছুটি কাটাতে সৈকতের দিকেও রওনা হলেন।
স্পেনে লকডাউন শুরু হয়েছে ১৪ মার্চ। সে সময় থেকে বাইরে ঘোরাফেরার জন্য পুলিশ জরিমানা করছে। বাইরে ঘোরাফেরা করা মানুষকে বারান্দা থেকে ডিম মারার মতো ঘটনাও ঘটছে। ফলে আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই হয়তো স্পেনের পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দেশটির মন্ত্রীরা বলছেন, কঠোরতা শিথিল করা হবে ১১ এপ্রিল মাসব্যাপী কোয়ারেন্টাইন-সময় শেষ হওয়ার পর। তারপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে এমন আশা নেই কারোরই।
আর সামনে ভঙ্গুর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার স্পেনের জন্য। এরআগে ২০০৮ সালে স্পেন যখন অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছিল তখন দেশটিতে বেকারত্বের হার গিয়ে ঠেকেছিল ২৭ শতাংশে। সরকারকে ঋণ নিতে হয়েছিল বড় আকারে এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছিল ইউরোপ। সেরকমই একটা অবস্থা এ বছরও হতে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোরতা, চাকরিচ্যুতি, বেতন কাটছাটের মতো যেসব ব্যবস্থা এক দশক আগে নেয়া হয়েছিল সেগুলো এ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থনীতিবিদ টনি রোল্ড্যান বলছেন, ইউরোপিয়ান স্ট্যাবিলিটি মেকানিজমের (ইএসএম) কাছ থেকে স্পেনের প্রয়োজন হবে ২০০ বিলিয়ন ইউরোর। কিন্তু এরজন্যও স্পেনকে অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। স্পেনের এখনকার যুদ্ধটা কেবল ভাইরাসের সাথে, তাকে অবশ্যই হারাতে হবে। স্পেনের জন্য এটাই শেষ যুদ্ধ নয়, সামনে আরও কঠিন সময় আসছে।
সূত্র : গার্ডিয়ান, ডয়েচে ভেলে।