মৃত্যুতে শেষ হলো জীবনের যত দুঃখ নাহিদ পারভীন পলির

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

রাজধানীর মালিবাগে তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী নাহিদ পারভীন পলি ছোটবেলাতেই হারিয়েছিলেন বাবাকে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে বড় হয়েছিলেন মামার সংসারে। বেঁচে থাকার জন্য শুরু করেছিলেন জীবনযুদ্ধ। ভাগ্যের চাকা ফেরাতে চলে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে। কষ্টার্জিত আয়ের টাকা মেরে দিয়েছেন এক স্বজন। দেশে ফিরে হিসাব চাইলে তার ওপর নেমে এসেছিল নির্মম নির্যাতন। বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় এসে কাজ নেন গার্মেন্টে। শুরু করেন ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। শেষ পর্যন্ত বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গিয়ে শেষ হয় তার দুঃখের জীবন।

গত মঙ্গলবার দুপুরে বাসা থেকে খেয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় মালিবাগে সু-প্রভাত পরিবহনের একটি বাস চাপা দিলে নিহত হন পলি। একই সময়ে তার অপর সহকর্মী মিম আক্তারকে ওই বাসটি চাকায় আটকে অন্তত ১৫ গজ দূরে নিয়ে ফেলে। এতে ঘটনাস্থলেই ১৬ বছর বয়সী মিমও মারা যায়। পলি গত চার মাস ধরে ওই এলাকায় আল রাফি গার্মেন্টে কাজ করলেও মঙ্গলবারই কাজে যোগ দিয়েছিল মিম।

পুলিশ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ সূত্র জানায়, ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বুধবার মিমের মরদেহ গ্রামের বাড়ি বগুড়ার গাবতলী নিয়ে গেছেন তার স্বজনরা। কিন্তু পলির কোনো স্বজন না আসায় লাশটি মর্গেই পড়ে থাকে। ওই তরুণী রাজধানীর পূর্ব নয়াটোলার যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেই বাড়ির মালিক তার লাশ নিতে চাইলেও দেওয়া হয়নি।

বাসাটিতে পলির সঙ্গে থাকতেন তার সহকর্মী তানিয়া আক্তার। গতকাল মর্গের সামনে তিনি বলছিলেন, একসঙ্গে থাকার কারণে পলির দুঃখের জীবনের অনেক কিছুই জানেন তিনি। বাবা-মাকে হারিয়ে পলি মামার সংসারে বড় হচ্ছিলেন। বছর পাঁচেক আগে বাহরাইন চলে যান। সেখান থেকে এক নিকট আত্মীয়ের কাছে টাকা পাঠান। কিন্তু দেশে ফিরে দেখেন তার টাকা না জমিয়ে তা স্বজনরা খেয়ে ফেলেছেন। এর হিসাব চাইলে তাকে নির্যাতনও করা হয়।

তানিয়া জানান, পলির আত্মীয়স্বজনরা মিলে অনেকটা জোর করেই তাকে একজন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেন। সেই সংসারও টেকেনি। শেষ পর্যন্ত একজন বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পাঁচ মাস আগে সৈয়দপুর থেকে তিনি ঢাকায় চলে এসে গার্মেন্টসে কাজ নেন। আবার টাকা জমিয়ে বিদেশ চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবার বাসের চাকা তার সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয়। মারা গিয়ে যেন দুঃখের জীবন থেকে বাঁচলেন পলি।

পলির বাড়ির মালিক সুলতান মোল্লা বলেন, মেয়েটি বড় দুঃখী ছিল। তার ভাইবোন বা বাবা-মা ছিল না। এ জন্য তিনি লাশ গ্রহণ করে দাফন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রক্তের আত্মীয় ছাড়া পুলিশ লাশ দেয়নি। এজন্য পুলিশের মাধ্যমে সৈয়দপুরে তার মামা ও মামাতো ভাইকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা ঢাকায় এসে লাশ নেবেন।

এদিকে গতকাল মর্গ থেকে লাশ নেওয়ার সময়ে বিলাপ করছিলেন নিহত মিমের মা জরিনা বেগম। তিনি বলছিলেন, যেই বাস তার বুক খালি করল, তিনি তার উপযুক্ত বিচার চান।

লাইসেন্স ছাড়াই বাসটি চালাচ্ছিলেন চালক : গার্মেন্টসের দুই কর্মীকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলার সঙ্গে জড়িত সু-প্রভাত পরিবহনের বাসটির (ঢাকা মেট্রো ব ১১৯৬১৩) চালক জুনায়েদের লাইসেন্সই ছিল না। তিনি অবৈধভাবে বাসটি চালাচ্ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। মঙ্গলবারের ওই ঘটনার পর দুর্ঘটনাজনিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা হয়েছে।

হাতিরঝিল থানার ওসি ফজলুল করিম বলেন, ‘অভিযুক্ত চালক জুনায়েদকে বুধবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার কথা দাবি করলেও তা দেখাতে পারেনি।’

এদিকে ওই দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়ক আটকে অর্ধশত গাড়ি ভাংচুর করে ও দুটি বাসে আগুন দেয়। তবে ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ওসি জানিয়েছেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত। তাই ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত কেউ অভিযোগও দেয়নি।