মা-বাবা ছাড়া এক কঠিন সংগ্রামের জীবন ছিল সুমন জাহিদের

:
: ৬ years ago

একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের মরদেহ পাওয়া গেছে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের রেললাইনে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায়। খবরটা জানার পর থেকেই মনটা অস্থির হয়ে আছে। এই তো কয়েক মাস আগের কথা— সুমন ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম তার জীবনের কত সংগ্রামের কথা । সেই মানুষটাই আজ লাশ হয়ে পড়ে ছিল রেল লাইনের ধারে!

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের নাম জানা থাকলেও তার একমাত্র সন্তান সুমন জাহিদের সঙ্গে সেইভাবে পরিচয় ছিল না। গত বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাকে নিয়ে একটা অ্যাসাইমেন্ট দেয়া হয় অফিস থেকে। সুমন ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। নাম্বার জোগাড় করে তাকে ফোন দিতেই তিনি বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন। ঠিক হলো, পরদিন দুপুরে তার অফিস শান্তিনগরের ফারমার্স ব্যাংকে দেখা করবো। পরদিন অফিসে গিয়ে দেখা করলাম সুমন ভাইয়ের সঙ্গে। হাসিখুশি, সদালাপী একজন মানুষ। বেশ আন্তরিকতা নিয়েই আমার সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন। নিজের কাজ, ব্যক্তিগত জীবন— এইসব নিয়েই আলাপ চললো কিছুক্ষণ। কিছুটা কাজের ব্যস্ততা ছিল তখন তার। সেগুলো সেরে উনি আমার সঙ্গে গিয়ে বসলেন অফিসের পাশেই কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি মার্কেটে। সেখানে বসে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হলো। জানলাম, তার জীবনের সীমাহীন কষ্টের সব কথা।

সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর, নিজের বাসা থেকে। সুমন ভাই তখন সামনেই ছিলেন। জানালেন, মা তাকে ওই সময় আদর করে বলেছিলেন, ‘সুমন তুমি মামার সাথে খেয়ে নিও। আমি যাব, আর চলে আসব।’ কিন্তু সুমন ভাইয়ের মা আর কোনোদিন ফেরেননি। বিজয় দিবসের পর সেলিনা পারভীনের  মৃতদেহ রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শনাক্ত করেছিলেন তার আত্মীয়রা।

সুমন ভাইয়ের কাছে জেনেছিলাম, মা-হারা আট বছরের এক সন্তানের বেড়ে ওঠার গল্প। যার বাবা থেকেও ছিলেন না। আত্মীয়স্বজনের দয়ায় কখনও এর বাড়িতে, কখনও তার বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু কেউ তাকে রাখতে চাইতেন না। পরে এক মামার দয়ায় পড়াশোনা করেন ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। হোস্টেলে থেকে পড়তেন। তিনি সেইদিন বলছিলেন, বালিশে মুখ বুজে কত রাত যে তিনি কেঁদেছেন তার কোনো হিসেব নেই।  সুমন ভাই বলেছিলেন, ছুটিতে অন্য ছেলেরা বাড়ি গেলেও তার কোনো যাওয়ার জায়গা ছিল না। আবদারেরও কোনো সুযোগ ছিল না। কথা বলতে বলতে কেমন যেন ভারী হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠস্বর। মনে হচ্ছিল, যেন তখনও তিনি সেই ট্রমা থেকে বের হতে পারেননি। আমিও তন্ময় হয়ে শুনছিলাম তার সেইসব কষ্টের কথা। তিনি বলছিলেন, তার ছেলেরা যখন তাদের মায়ের কাছে কোনো কিছুর আবদার করে মনের অজান্তেই তার চোখ ভিজে ওঠে।

কথায় কথায় সুমন ভাই বলছিলেন, আজ দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। কিন্তু তাদের বিচার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারবো কি-না জানি না। কারণ আমার মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল যে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও তার সঙ্গীরা, তার বিচার হলেও সে পালিয়ে আছে লন্ডনে। সুমন ভাইয়ের সেই শঙ্কাই যে সত্যি হবে তা কি তিনি সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন? তার মায়ের খুনিকে ফিরিয়ে আনার আগেই তাকেও রহস্যময়ভাবে প্রাণ দিতে হবে তা কি আঁচ করতে পেরেছিলেন?

সুমন ভাই ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’, ‘প্রজন্ম একাত্তর’সহ আরও অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সুমন ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে রেললাইনে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায়। এটা হত্যা না আত্মহত্যা আমি জানি না। কিন্তু যে ছোট্ট ছেলেটি মা হারিয়ে এতটা সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়েছে তিনি কোনোভাবে জীবনের কাছে হেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন এটা মানতে পারছি না। আবার, যিনি দুই সন্তানের একজন স্নেহময় বাবা আর দায়িত্বশীল স্বামী, তিনি এতটা অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটবেন যে রেলে চাপা পড়ে মারা যাবেন সেটাও মানা যাচ্ছে না। যার একটা জীবন কেটেছে পরিবার ছাড়া, সেই মানুষটি এমন সাজানো গোছানো সংসার ছেড়ে এভাবে রেললাইনের ধারে অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হয়ে পড়েছিলেন এটা কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছে না। সুমন ভাইয়ের এক আত্মীয় বলেছেন, আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কে বা কারা তাকে উত্তর শাজাহানপুরের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপরই রেললাইনের পাশে তার লাশ পাওয়া  যায়।

সুমন ভাইয়ের মৃত্যু কি নিছকই দুর্ঘটনা? নাকি মায়ের মতো তিনিও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন?