শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার সময় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে ঐক্য সৃ্ষ্টি হয়েছিল, তা নেই এবং সে জন্যই সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাবশালী নেতা ড. মাহাথির মোহাম্মদ। সম্প্রতি নিজের শততম জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আইটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

আগামী মাসেই শততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছেন মাহাথির মোহাম্মদ। মালয়েশিয়ার দীর্ঘতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন শেষ করলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে তিনি এখনো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত কিংবদন্তি। বর্তমানে সরকারি কোনো পদে না থাকলেও ৯৯ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ এখনো বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের রাজনীতি নিয়ে আগের মতোই সুস্পষ্ট ও অত্যন্ত দূরদর্শী কথা বলেন।

সাক্ষাৎকারে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাজের প্রশংসা করলেও, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নয় বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বাংলাদেশিদের মধ্যে যে ঐক্য দেখা গিয়েছিল, অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় সেই ঐক্য তিনি আর দেখতে পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, মানুষ শেখ হাসিনাকে সরাতে ঐক্যবদ্ধ ছিল। এখন সেই লোকজনের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছে। প্রত্যেকে চায় তার নিজ নিজ মতামত দেশের সবাই মেনে নিক। আর এতেই নানান সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ‘বিতর্কিত’ শাসনামলের কথা বিবেচনায় নিলে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া উচিত কি না- এমন প্রশ্নে মাহাথির উত্তর দেন দার্শনিক ভঙ্গিতে। বলেন, এটা গণতন্ত্রের একটা সমস্যা। মানুষ যে সবসময় যথার্থ মানুষটিকেই বেছে নেয়, তা নয়; কখনো কখনো ভুল লোককেও বেছে নেয়। বাংলাদেশের মানুষ যদি এখন চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমি মনে করি- তারা একটা ভালো সরকার বেছে নিতে পারবে।

মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে মাহাথির বলেন, তিনি একজন বড় মাপের মানুষ। তিনি যা করেছেন ও দরিদ্রদের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেজন্য নোবেল পুরস্কার তার প্রাপ্য ছিল। তিনি ক্ষমতার লোভ করেননি, বরং দরিদ্র মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।

সম্প্রতি জাপানে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা হয় মাহাথির মোহাম্মদের। তবে সেখানে বাংলাদেশের নেতাকে কোনো পরামর্শ দেননি বলে জানান মালয়েশিয়ার এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর। বলেন, আমি তার (ইউনূস) কথা শুনেছি। আমি জানি, তিনি সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি, বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, তা বলার মতো যোগ্যতা আমার নেই।

অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশকে আসিয়ানের সদস্যপদে দেখতে চান। কিন্তু সেই সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী নন মাহাথির। সমস্যাটা কোথায় জানতে চাইলে তার সংক্ষিপ্ত উত্তর, সমস্যাটা ‘ভৌগোলিক’।

জাপানে মাহাথিরের সঙ্গে ইউনূসের সাক্ষাতের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিসের কর্মীদের পক্ষ এমন আভাস দেওয়া হয়েছিল যে, আসিয়ানে যোগ দিতে বাংলাদেশের আগ্রহের বিষয়ে মাহাথিরের সমর্থনের ইঙ্গিত মিলেছে। তবে সাক্ষাৎকারে ভিন্ন মনোভাবেরই ইংগিত মেলে।

তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বলতে যে ভৌগোলিক সীমা এখন বোঝায়, বাংলাদেশ তা থেকে অনেক দূরে। আসিয়ানকে তো একটা ভৌগলিক সীমা মেনে চলতে হবে, না হলে তো এটি তো দ্বিতীয় জাতিসংঘ হয়ে যাবে।

তবে বাংলাদেশ আসিয়ান প্লাস ফরম্যাটে ‘ডায়ালগ পার্টনার’ কিংবা ‘অবজারভার স্ট্যাটাসে’ আসতে পারে মত দিয়ে তিনি বলেন, আমরা জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তো কথা বলি। একইভাবে বাংলাদেশের সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব।

এদিকে, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মালয়েশিয়ার অবস্থান প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন মাহাথির। রাখাইনে নিপীড়িত সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি জানালেও তিনি বলেন, মালয়েশিয়া ‘যথেষ্ট’ করেছে। এর বেশি সক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা মিয়ানমারকে বোঝাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, তবে এখন পর্যন্ত সফল হতে পারিনি।

গত কয়েক মাসে রোহিঙ্গাবাহী নৌকা ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে মালয়েশিয়া। তবে মাহাথির বলছেন, এখন অন্য দেশগুলোর এগিয়ে আসার সময়। আমাদের এখানে আগে থেকেই অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে। শুধু মালয়েশিয়া নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, এমনকি, মিয়ানমারের পশ্চিম পাশের অন্য দেশগুলোরও সহায়তা করা উচিত। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

বাংলাদেশ এরইমধ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, তখন কেন বাংলাদেশকে আরও দায়িত্ব নিতে হবে- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারের পাশের দেশ। স্বাভাবিকভাবে আপনি কাছের দেশেই যাবেন, লন্ডনে তো না।