প্রায় ২২ বছর দাপটের সঙ্গে মালয়েশিয়া শাসন করে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করা মাহাথির মোহাম্মদের আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া এবং তার নিজ দল বরিসান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে নতুন দল ও জোট গঠন করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ নিঃসন্দেহে একটি বিশাল অর্জন। এই অর্জন আবার এমন একটি দলের বিপক্ষে, যারা উপনিবেশ-পরবর্তীকাল থেকে মালয়েশিয়া শাসন করছে এবং এতদিন পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে তাদের তেমন কোনো নিকট প্রতিদ্ব্বন্দ্বী ছিল না। এমন ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল বলা চলে। তার চেয়েও বিরলতম ঘটনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল গত ১০ মে। বিশ্ব ইতিহাসের প্রবীণতম রাজনীতিবিদ হিসেবে ৯২ বছর বয়সে আবারও প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন মাহাথির। যাকে আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি বলা হয়ে থাকে, তার বীরের বেশে এমন প্রত্যাবর্তন এককথায় যেন এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন।
যদিও ভোটের আগে ক্ষমতাসীন বরিসান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স এবং মাহাথিরের রাজনৈতিক জোট পাকাতান হারাপান- এ দুই দলের মধ্যে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস ছিল, তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে পাকাতান হারাপান জোটের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কোনো রকম পূর্বাভাস ছিল না কোনো জরিপেই; বরং বিষয়টি এমন ছিল যে মাহাথিরের নেতৃত্বে তারা আগের চেয়ে আরও কঠিনতম বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হবে। আর এমন সম্ভাবনার মূল কারণ ছিল মূলত দুটি। প্রথমত, সে দেশের জনগণ এমন এক অর্থনৈতিক শক্তির মালয়েশিয়াকে দেখছে, যদিও এর মূল ভিত্তি মাহাথিরের সময়েই রচিত হয়েছিল, তথাপি এই ধারা চলমান এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা এই ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা চান না। দ্বিতীয়ত, বিরোধী জোট পাকাতান হারাপানের মূল নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনোত্তর সময়ে সমকামিতার অভিযোগে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নেতৃত্বশূন্যতা নির্বাচনে জয়ের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে। এ অবস্থায় জোটটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরকে নিজেদের জোটে ভিড়ালেও এবং দেশের সাধারণ জনগণ তাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখলেও শঙ্কা ছিল যে, তার বয়স ও শারীরিক সামর্থ্য বিবেচনায় পাকাতান হারাপানের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এমনসব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে সে দেশের ২২২ আসনের সংসদে পাকাতান হারাপানের ১২২টি আসনে বিশাল জয় বিশ্ববাসীকে এ কথাই জানান দিল- সে দেশের জনগণও পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। তবে তার জন্য দরকার সঠিকভাবে ডাক দেওয়া। আজ বিশ্বরাজনীতিতে তাই এটাই বহুল উচ্চারিত বিষয়- কী এমন ডাক দিয়েছেন জোটের নতুন নেতা এবং কেনই বা সে ডাকে সাড়া দিয়ে ভোট বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে দেশের সাধারণ মানুষ? প্রথমেই বলতে হবে, মাহাথির এমন এক নেতা, যিনি যদিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন; বরং ক্ষেত্রবিশেষে তার বিরুদ্ধে অনেকেই এমন অনেক সমালোচনায় সোচ্চার এ কারণে যে, তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে কখনও তার বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হতে দেননি এবং তার রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকেই মালয়েশিয়া চালিত হোক-এমনটাই চেয়েছেন সব সময়। সময়ের পরিক্রমায় যখন সবাইকে তার স্বীয় দায়িত্ব থেকে অবসর নিতে হয়, এমনই এক ক্ষণে ৭৭ বছর বয়সে ২০০৩ সালে তার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত আবদুল্লাহ বাদাওয়ি এবং পরে নাজিব রাজাকের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম করে দেন। দল ও দেশের সবার কাছে হয়ে থাকেন অনুকরণীয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। এদিকে ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে ক্রমাগত জমতে থাকে অভিযোগের পাহাড়। একদিকে পশ্চিমা রাজনীতির প্রতি নিজেকে সঁপে দেওয়া (যা ছিল সম্পূর্ণরূপে মাহাথিরের রাজনৈতিক মতাদর্শবিরোধী), অন্যদিকে নিজের ও ছেলের আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলের অনেকেই অবস্থান নিতে থাকেন তার বিপক্ষে, যেখানে একরকম চূড়ান্ত পেরেক ঠোকেন স্বয়ং মাহাথির।
২০১৬ সালে দল থেকে পদত্যাগ করে সবাইকে জানিয়ে দেন- এমন দুর্নীতিতে জড়িতে যে রাজনৈতিক জোট, তার সদস্য হিসেবে লজ্জাবোধ থেকে তিনি সরে এসেছেন। সেই সঙ্গে তিনি এমনটাও উপলব্ধি করতে থাকেন- দেশের জন্য এখনও কিছু করার রয়েছে তার। সম্ভবত তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এ উপলব্ধি কাজ করেছে যে, তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে একদা তার খুব প্রিয় আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে তিনি খুব বেশি অবিচার করে ফেলেছেন, যার আগুনে এখনও পুড়ছেন আনোয়ার এবং এর ক্রমাগত সুযোগ নিয়ে যাচ্ছে নাজিব রাজাকের সরকার, যা আনোয়ারের নেতিবাচক ভাবমূর্তি অব্যাহত রাখার এক প্রয়াসের পাশাপাশি নিজেদের দুর্নীতিকে ঢাকা দেওয়া। এমন হঠকারিতা মানতে পারেননি মাহাথির। নির্বাচনের আগে আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত- এমন বক্তব্য তার মুখ থেকে না এলেও তিনি এটাই সবাইকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, আনোয়ার কম বয়সে কিছু অন্যায় করে থাকলেও তার জন্য সে যথেষ্ট সাজা পেয়েছে। আর এখন যা হচ্ছে তা রীতিমতো তার বিরুদ্ধে অত্যাচার। সে জন্যই তিনি রীতিমতো সরাসরি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন সবার কাছে, তিনি আরেকবার সুযোগ চান জনগণের কাছে, যার মধ্য দিয়ে তিনি তার নিজের কিছু ভুল শুধরে নিতে পারেন। মাহাথির ডাক দিয়েছেন আর জনগণ তা শুনবে না- মালয়েশীয় জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে এতটা অকৃতজ্ঞ তারা নয়। তারা এমনটাই বিশ্বাস করে, মাহাথির আবারও দেশ শাসন করবেন- এটা তাদের জন্য এক বিশাল সুযোগ।
মাহাথিরের এই মহা পুনরুত্থান কেবল মালয়েশিয়া নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যই অনেক দিক দিয়ে অনুকরণীয়। ৯২ বছর বয়সে যখন একজন ব্যক্তি আবারও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ক্ষমতারোহণ করেন তখন আর এমনটা ভাবার অবকাশ নেই যে, তিনি শুধু ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করবেন। আর মাহাথিরের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি একদম যায় না। কারণ তিনি বরাবরই মালয়েশিয়ার জনগণের মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন। দেশের জন্য তার এখনও কিছু করতে পারার চেষ্টা বাকি- এমন উপলব্ধিই দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে, যা নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক পরিসরে রাজনীতিবিদদের প্রেরণা দিয়ে যাবে। তিনিও নিঃসন্দেহে তার দায়িত্বের সম্পূর্ণ মেয়াদে স্বপদে থাকবেন না; বরং স্বল্প পরিসরে কিছু অর্জনের চেষ্টাও আমাদের সব রাজনীতিবিদের জন্য এই বার্তা দেওয়া যে- দায়িত্ববোধই রাজনীতির মূলমন্ত্র।
বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সম্পর্কের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সেই সঙ্গে দু'দেশের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক অনেক অভিন্নতা। স্বাধীনতা-উত্তর মালয়েশিয়া কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে উত্তরণের নেপথ্যে কাজ করেছে সে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। একদা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা মালয়েশিয়া আজ এমন এক অর্থনীতির দেশ, যেখানে ৩ লাখ বৈধসহ প্রায় ৬ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। বর্তমানে দু'দেশের সুসম্পর্কের সূচনাও বলতে গেলে মাহাথিরের সময় থেকেই। আর তার ধমনিতে রয়েছে বাংলাদেশের রক্ত। মাহাথিরের দাদা ছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মরিয়মনগর গ্রামের বাসিন্দা, যিনি ছিলেন জাহাজের নাবিক এবং যুবা বয়সে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়ে সে দেশে আলোর সেতার নামক এক মালয় রমণীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের পুত্র মোহাম্মদ ইস্কান্দারের ৯ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ মাহাথিরও নিঃসন্দেহে চাইবেন তার পূর্বপুরুষের বাস এই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। সে জন্য দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের অভিন্ন ক্ষেত্র অন্বেষণের জন্য বাংলাদেশকেও জোর প্রচেষ্টা নিতে হবে এখন থেকেই।
সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমানে বেইজিং-এর ইউআইবিইতে উচ্চশিক্ষারত
mfulka@yahoo.com
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com