‘তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার’-এই স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১২ সালের ২০ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সকল মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও শিক্ষক কর্তৃক ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল কঠিন, দুর্বোধ্য ও বিমূর্ত বিষয়সমূহকে ছবি, অ্যানিমেশন ও ভিডিও ক্লিপের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করা।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ও মানব জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক বলে বিবেচিত। শিক্ষার এই স্তর পরবর্তী সকল স্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে বলে যথাযথ মানসম্পন্ন উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অপরিহার্য। উন্নতবিশ্বে শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকেই কম্পিউটারকে শিক্ষাদানের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বর্তমানে বিশ্বব্যাপী।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। শিক্ষা উপকরণ ডিজিটালাইজেশন ও তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন শিক্ষার মানোন্নয়নে যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করছে। প্রাথমিক শিক্ষার ডিজিটালাইজেশনের দুটি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া তথা ডিজিটাল ক্লাসরুম এর ব্যবহার এবং অপরটি প্রাথমিক শিক্ষা কন্টেন্ট ইন্টারএ্যাক্টিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল ভার্সনে রুপান্তরকরণ ।প্রাথমিক শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া তথা ডিজিটাল ক্লাসরুম এর ব্যবহার:উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের মতো প্রযুক্তিকেও একটি শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কম্পিউটার বা অন্যান্য তথ্য-প্রযুক্তি ব্ল্যাকবোর্ডের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে ব্যবহৃত একটি আধুনিক শিক্ষা উপকরণ হিসেবে কাজ করছে। এ লক্ষে সরকারের তরফ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম ও স্পীকারের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।
এ শ্রেণি কক্ষকেই বলা হচ্ছে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’।মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমকে ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’ হিসেবেও অভিহিত করা হচ্ছে।প্রাথমিক শিক্ষা কন্টেন্ট ইন্টারএ্যাক্টিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল ভার্সনে রুপান্তরকরণ:এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের (প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি) আলোকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ক ১৭টি বইয়ের ইন্টারএ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্ট তৈরি করা । মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে এ্যানিমেশনকৃত ডিজিটাল কন্টেন্টসমূহ ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠ্য বিষয়কে সহজ এবং পাঠদান প্রক্রিয়াকে অংশগ্রহণমূলক ও শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক হিসেবে পরিণত করা যাবে।
ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্টসমূহ বিনামূল্যে ডাউনলোড করে যে কেউ স্ব-শিক্ষণে বা ক্লাসরুমে ব্যবহারের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট সকল প্রশিক্ষণার্থী হাতে-কলমে স্ক্রিপ্ট তৈরি করা শিখবেন এবং পরবর্তীতে তা তৈরি করতে পারবেন। সর্বোপরি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। প্রাথমিক শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা :বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা লাভ এবং সেটি প্রয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত।জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) সকলের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলা অত্যন্ত জরুরি। মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে নিজস্ব চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী হয়ে সকল শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে মানসম্পন্ন যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্টের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। ডিজিটাল কন্টেন্টসমূহ শ্রেণিকক্ষে ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রেণিকক্ষকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শ্রেণিকক্ষে পরিণত করা, পাঠদানকে অধিকতর ফলপ্রসূ করা, বিষয়ভিত্তিক ধারণা স্পষ্ট করা ও উন্নততর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য স্ব-শিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পরিচিত করানো।বর্তমান অগ্রগতি :বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে কম্পিউটারকে শিক্ষাদানের উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সমূহ নিম্নরুপ -২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের উদ্যোগে ৭টি বিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষক নিয়ে পাইলট আকারে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এ পাইলট কর্মসূচির সফল অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে, এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সারাদেশে পঁচিশ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেছে। এর মধ্যে ২০,৫০০ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তি’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৫ হাজারের বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
শিক্ষকগণ বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল, ধর্ম, বাংলা, কৃষিশিক্ষাসহ প্রতিটি বিষয়ের ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরি করছেন ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশের সকল শিক্ষকদের একটি কমন প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় এটুআই প্রোগ্রাম শিক্ষক বাতায়ন (teachers.gov.bd) তৈরি করেছে। শিক্ষকগণ তাদের তৈরিকৃত ডিজিটাল কন্টেন্ট, ভিডিও, এ্যানিমেশন এখানে শেয়ার করে থাকেন। শিক্ষক বাতায়নে মোট শিক্ষক রয়েছেন ৪৫,০০০ জন, যারা নিয়মিত ডিজিটাল কন্টেন্ট আপলোড করছেন। এখানে ২৫ হাজারের বেশি ব্লগপোস্ট ও ১২ হাজারের বেশি ডিজিটাল কন্টেন্ট রয়েছে। গ্রাম-শহরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে শিক্ষক বাতায়ন। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মনিটরিং ও মেইনটেনিং-এ জেলা-উপজেলা প্রশাসন, জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিস এবং টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সমন্বয় করে কাজ করছে। এটুআই প্রোগ্রাম থেকে একটি অনলাইন ড্যাশবোর্ড (mmm.e-service.gov.bd) তৈরি করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম অনলাইনে ম্যানেজমেন্ট ও মনিটরিং করার জন্য । দেশের সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা বর্তমানে এ ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে প্রাথমিক ও কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমও এ ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে মনিটরিং করা শুরু হবে। আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানের প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার প্রধান শক্তিশালী হাতিয়ার তথ্য-প্রযুক্তি। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের এবং গণিতের মতো বিষয় গুলোর প্রতি আগ্রহী হবে। সে লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় তথ্য-প্রযুক্তির মান সম্মত ব্যবহার, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নিশ্চিতকরণ সহ শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছে এবং ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও তৃণমূল পর্যায়ে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা প্রদানের লক্ষে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইনফো সরকার ফেজ-৩ প্রকল্পের আওতায় POP (Point of Presence) স্থাপনের কাজ চলমান আছে। মাঠপর্যায়ে এ সকল কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে ভিশন-২০২১, ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।