মাদক নিয়ে দুশ্চিন্তায় বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কর্তৃপক্ষ

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

প্রতিষ্ঠার চার বছরেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের। মেডিকেল সেন্টার নেই, শহীদ মিনার নেই, শিক্ষক আর জনবল-সংকট তো রয়েছেই। নেই পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও। প্রচণ্ড ধুলাবালু আর সুরকি মোকাবিলা করেই থাকতে হচ্ছে শিক্ষক-ছাত্রদের।

‘এত কিছু নেই’-এর মধ্যে মাদকের ছোবলও থেমে নেই। অভিযোগ উঠেছে, ছাত্রাবাসে মাদক সেবন ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। এমনই একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েছেন শিক্ষকরা।

যদিও শিক্ষকদের দাবি, ছড়িয়ে পড়া ভিডিও তিন বছর আগের। শিক্ষার্থীদের অভ্যান্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পুরোনো ভিডিও এখন আবার ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে দিন দিন মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। কলেজ প্রশাসন আরও কঠোর না হলে ভয়াবহ রূপ নেবে এই প্রবণতা।

কয়েক দিন আগে ১৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ ও কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছয় শিক্ষার্থী মিলে মাদকদ্রব্য সেবন করছেন। ভিডিও সর্ম্পকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদক সেবনকারীরা সবাই একই ছাত্রাবাসের আলাদা কক্ষের থাকেন (গোপনীয়তার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি)।

মাদক সেবনের সেই ভিডিও গোপনে অন্য একজন একই কক্ষে বসে ধারণ করে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু এই একটি কক্ষ নয়, ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষে এভাবে মাদকের আড্ডা বসে থাকে বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা। মাদক গ্রহণের বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে বহিরাগতদের দিয়ে তাদের শাসানো হয় বলে জানান তারা।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও রসায়ন বিভাগের প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কলেজ ছাত্রাবাসে মাদক সেবনের যে ফুটজে ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলো ২০১৯ সালের আগের। ওই ঘটনায় কয়েকজন ছাত্রকে ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তবে অমি মনে করি যারা মাদক সেবন করেছিল এবং যারা এগুলো ভিডিও করে ছড়িয়েছে, তারা সবাই একই গ্রুপের।

তিনি আরও বলেন, কলেজটি সম্পূর্ণ আবাসিক। এখানে ৪০০ শিক্ষার্থীর প্রতিদিনের খাবার রান্না হয়। এ জন্য একটি হল কমিটিও আছে। এখানে অর্থনৈতিক লেনদেন জড়িত, তাই এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হেনস্তা করতে দ্বন্দ্বের জেরে পুরানো ভিডিওগুলো আবার সামনে নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, মাদক সেবনের ভিডিও কলেজের ইমেজ নষ্ট করছে। আমরা লজ্জিত এ ঘটনায়।

হল সুপার মাসুদুর রহমান বলেন, ওই ঘটনার পরে প্রতিনিয়ত হলে মনিটরিং বাড়িয়েছি। কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই যেকোনো সময়ে সন্দেহজনক ছাত্রের কক্ষে আমরা হাজির হই। তা ছাড়া যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে মাদকে সম্পৃক্ততার, তাদের ব্যক্তিগতভাবে মোটিভেট করছি। অর্থাৎ মাদক সম্পৃক্ততার বিষয়ে আমরাও অবহিত এবং কেউ যেন এতে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য সতর্ক রয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি মাদকমুক্ত ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সতর্কতা বাড়ছে।

শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান বলেন, আমাদের কোনো মসজিদ নেই। তা ছাড়া কলেজটি মূল শহর থেকে অনেক দূরে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বরিশাল শহরে নিতে হয়। কিন্তু রাত-বিরাতে অসুস্থ কাউকে নিতে হলে নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা নেই। বাইরের গাড়ির ওপর ভরসা করতে হয়। এ জন্য আমাদের এখানে একটি মেডিকেল সেন্টার স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। কলেজে নেই শহীদ মিনারও।

আরেক শিক্ষার্থী অপূর্ব কুমার দাস বলেন, কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরের সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারহীন হয়ে রয়েছে। সড়কের ধুলাবালু, সুরকি বাতাসে উড়ে এসে পুরো ক্যাম্পাস আচ্ছাদিত করে দেয়। এতে আমরা খুব দ্রুত রোগাক্রান্ত হচ্ছি। সড়কটি দ্রুত সংস্কার করা জরুরি।

ধ্রুব বিশ্বাস বলেন, ক্যাম্পাসের সাথে বরিশাল শহরের যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। পরবর্তীতে যারা এখানে ভর্তি হবে, তখন তারা ছাত্রাবাসে সিট পাবে বলে মনে হয় না। তাদের বাইরে থেকে লেখাপড়া করতে হবে। সে জন্য হলেও একটি বাসের দরকার। তা ছাড়া ক্লাসের বাইরে শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করার মতো কোনো স্থান আমাদের নেই। এ জন্য আমাদের অত্যাবশ্যকীয় টিএসসি ও অডিটরিয়াম।

আরেক শিক্ষার্থী আজিজুল বলেন, ছাত্রাবাসে পয়োনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। মাশার ভয়াবহ উপদ্রব। এ নিয়ে ছাত্রাবাস পরিচালনা কমিটি দফায় দফায় কলেজ প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। স্যাররাও আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ছাত্রাবাসে থাকতে আমাদের প্রচণ্ড কষ্ট হয়।

তিনি বলেন, বর্তমানে কলেজ ক্যাম্পাস মাদকমুক্ত। তবে প্রথমাবস্থায় মাদক ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন কলেজ প্রশাসন।

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে শিক্ষক সংকট। আমাদের এখানে ত্রিপলি ও সিভিল এই দুটি বিভাগ। এরমধ্যে ট্রিপলি বিভাগে ৪ জন, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে মাত্র দুজন শিক্ষক রয়েছেন। এত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাত্র ৬ জন শিক্ষক দিয়ে চালানো আসলেই দুঃসাধ্য। এতে আমরাও উল্লেখযোগ্য কিছু শিখতে পারছি না।

কলেজ অধ্যক্ষ মো. খলিল উদ্দিন বলেন, আমি মাত্র তিন মাস আগে এই কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছি। এসে জেনেছি ছাত্রাবাসে মাদক সেবনের কারণে পাঁচ শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বর্তমানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কাউন্সেলিংয়ের আওতায় এবং সবার চলাফেরা মনিটরিং করছি। এ ছাড়া তাদের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি।

তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। নবীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কিছু সমস্যা থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। আবার এখানে যে মানের ল্যাব রয়েছে, তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় উন্নত। তবে জনবল-সংকট রয়েছে। বরিশাল শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যাম্পাস। আমরা যদি একটি বাস পেতাম, তাহলে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হতো না। তা ছাড়া শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি তুলেছে, মসজিদ, শহীদ মিনার, টিএসসি, মেডিকেল সেন্টার, আসলেই এগুলোর অভাব রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থায় রয়েছি।

সূত্রঃ ঢাকা পোষ্ট