মস্কোর প্রাণ যে মানুষটি

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

৯০০ বছরের ইতিহাসে কত নামই-না দেওয়া হয়েছে মস্কো শহরকে। মস্কো নিয়ে ১৮৮১ সালে তলস্তয়ের মূল্যায়ন ছিল এ রকম: ‘ধোঁয়া, পাথর, বিলাসিতা, দারিদ্র্যের’ এক শহর। পর্যটক ও বাসিন্দাদের কাছে আভিজাত্য, রক্ত, পবিত্র ও অপবিত্রতার মিশ্রণের শহর ছিল এটি। সোভিয়েত যুগে এ শহরকে বৃহৎ, ধূসর ও নিষিদ্ধ নগর হিসেবে দেখা হতো।

২০০০ সালে তেলের দাম ফুলেফেঁপে উঠলেও এ শহর যেন অলস ও কষ্টকর আবাসই ছিল। বর্তমানে বেশ কয়েকটি অপ্রত্যাশিত শব্দ যুক্ত হয়েছে মস্কোর বর্ণনায়, তা হলো ‘আনন্দদায়ক ও কার্যকর’। গত সেপ্টেম্বরে মস্কোর মেয়র নির্বাচনে ক্রেমলিন-সমর্থিত সার্গেই সোবিয়ানিনকে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত করেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১০ সালে প্রথম দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই মস্কো শহরকে যেন নতুন করে সাজিয়েছেন তিনি। এবারে নির্বাচিত হয়ে আশা করছেন, মস্কো হয়ে উঠবে অতিথিপরায়ণ ও আরামদায়ক।

সম্প্রতি ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টে মস্কোর এই নগরপিতাকে নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

আসলে সার্গেই সোবিয়ানিনের প্রতি অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন পুতিন। বছর বছর ধরে বিক্ষোভ, আর্থিক মন্দা ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা দেখেছে মস্কো। কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে শহরটিকে অবিচলিত পরিচর্যা করছেন সোবিয়ানিন। মস্কোতে রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার এক-দশমাংশ বাস করে। ২০১০ সালে প্রথম নিয়োগ পান সোবিয়ানিন। স্তালিন যুগের পর তিনিই প্রথম শহরটির বড় রূপান্তর ঘটান। বাজেট নিয়ে সীমাবদ্ধতা থাকলেও তিনি পার্কের সংখ্যা বাড়িয়েছেন, শত শত রাস্তা মেরামত করেছেন, কয়েক ডজন মেট্রোস্টেশন নির্মাণ করেছেন, একটি নতুন প্রযুক্তির রেললাইন স্থাপন করেছেন, করেছেন সরকারি সেবার আধুনিকায়ন। ইউরোপের সবচেয়ে বড় শহরটির খুব দ্রুত পরিবর্তন এসেছে সার্গেই সোবিয়ানিনের সময়ে।

এই পরিবর্তন পুতিনের আদালতে সোবিয়ানিনের ভাবমূর্তি দৃঢ় করেছে। বিশ্লেষকেরা সোবিয়ানিনকে ক্রেমলিন টাওয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালে পুতিনের প্রধান স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সোবিয়ানিনকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে উল্লেখ করা হতো। যেভাবে মস্কো শহরের ব্যবস্থাপনা করছেন, তা সবাইকে মুগ্ধ করে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী পদে সংক্ষিপ্ত তালিকায় তাঁর নাম উঠে আসে। অবশ্য সে দায়িত্ব পান দিমিত্রি মেদভেদেভ।

সোবিয়ানিনের আগে মস্কোর মেয়র ছিলেন ইউরি লুজকভ, ১৯৯২ সাল থেকে মধ্যযুগীয় মানসিকতার ইউরি মস্কোর নগরপিতার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সময়ে ঐতিহাসিক ভবনগুলোর অবস্থা সবচেয়ে করুণ হয়ে পড়ে। চাকচিক্যময় শপিং মলের সংখ্যা বেড়ে যায়, ট্রাফিক জ্যামে নাকাল হয় নগরবাসী। এমনকি তাঁর স্ত্রী কনস্ট্রাকশন ম্যাগনেট দেশের সবচেয়ে ধনী নারী হন। সার্গেই এসে এই লুজকভ যুগকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়েন। ‘নতুন মানুষ নিয়ে একটি নতুন মস্কো শহর তৈরি করার’ পরিকল্পনা করেন তিনি

নতুন দায়িত্ব নিয়ে নগর-পরিকল্পনা ও পাবলিক স্পেসের ওপর জোর দেন সোবিয়ানিন। আগের সব যুগে শহরগুলো একটু জায়গা ও কারখানার জন্য যুদ্ধ করেছিল। তিনি মনে করেন, এই শহর এখন কেবল মানুষের জন্য যুদ্ধ করবে। এখন সরকারি মোটরসাইকেল ও স্কুটার শেয়ারিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে চলাচল করতে পারে নগরবাসী।

তবে সমালোচকদের মুখ বন্ধ নেই। তাঁরা বলছেন, কেবল কসমেটিক পরিবর্তন এসেছে। ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় নতুন নতুন রাস্তা তৈরি সম্ভব হয়েছে। সোবিয়ানিনের বেশ কিছু পরিকল্পনা, যেমন: ছোট রাস্তা বাতিল, বয়স্ক ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসন প্রকল্প ব্যক্তিগত সম্পত্তিব্যবস্থাকে বেশ সমস্যার মুখোমুখি করছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা খর্ব করে জীবনযাত্রার মানে উন্নয়ন আনা হয়েছে। চলতি বছরের মেয়র নির্বাচনও ছিল একদম একমুখী। সোবিয়ানিনের বিরোধীপক্ষ বলে তেমন কেউই ছিলেন না। এর আগে ২০১৩ সালের নির্বাচনেও সোবিয়ানিন ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে উতরে যান। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অ্যালেক্স নাভালনি ২৭ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। তবে নাভালনি নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে ফের ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁকে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে হারানো’ হয়েছে। পরে নাভালনিকে আটক করা হয়।

সমালোচনা-আলোচনা যা–ই হোক না কেন, সোবিয়ানিন দায়িত্ব না নিলে মস্কো নগরের অবস্থা যে আরও খারাপ হতো, তা স্বীকার করছেন সবাই।