রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে গত ৯ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) ৮ বছরের মরিয়াম জামান আরফিয়া নামের এক কন্যা শিশু চিকিৎসারত অবস্থায় ‘ভুল চিকিৎসায়’ মারা গেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
ওই হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভুল চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে ডা. মো. মনিরুল ইসলাম ও প্রফেসর ডা. ইসরাত জাহান লাকীর বিরুদ্ধে রাজধানীর আদাবর থানায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর জিডি করে শিশুটির পরিবার।
শিশুটির মা জুবাইদা আলম ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও শ্যামলীতে অবস্থিত স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছেও অভিযোগ জানিয়েছেন।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের একমাত্র মেয়েকে জ্বর আসার পর চিকিৎসক ডা. মো. মনিরুল ইসলামের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করাই। চিকিৎসক রোগীর রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। ডা. মনিরুল নিজে চিকিৎসা না করে প্রফেসর ডা. ইসরাত জাহান লাকীকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। আমার মেয়েকে তারা পানিও খেতে দেয়নি। আমাদেরকে মেয়ের কাছে যেতে দেয়নি। হাই এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেছে। তাদের ভুল চিকিৎসায় আমাদের মেয়ে মারা গেছে।’
আরফিয়ার বাবা-মায়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমোটোলোজি বিভাগের ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আরফিয়াকে যখন দেখি, তখন তার শরীরে ১০৫ ডিগ্রি জ্বর। শিশুটি এক বছর থেকে আমার কাছে দেখাচ্ছে। জন্ম থেকেই ও একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী। জ্বর ছাড়া তেমন কোনা সমস্যা ছিল না। প্রেসার ও পালস ঠিক ছিল। তারপরও রোগী খুব অস্থির ছিল। এসময় ওর বেশ কিছু পরীক্ষা দেওয়া হয়। যার মধ্যে ছিল ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ইউরিন, সিবিসি ইত্যাদি।
‘রিপোর্ট সন্ধ্যা ৬টায় পাওয়া যায়। তার মধ্যে শিশুটির অ্যাজমা এবং সিবিসি পরীক্ষায় ফল খারাপ আসে। তার ইউরিন ইনফেকশন ধরা পড়ে। তার শরীরে লবণের মাত্রা ছিল ১২৬। যা কমপক্ষে থাকার কথা ১৩৫ থেকে ১৪৫। তার চিকিৎসার ভার শিশু বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. ইসরাত জাহান লাকীর ওপর দেই আমি।”
এ বিষয়ে প্রফেসর ডা. ইসরাত জাহান লাকী বলেন, ‘শিশুটির জ্বর হওয়ার পর তারা বাসায় এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে শুরু করে। এক সপ্তাহ আগে শিশুটি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কক্সবাজার গিয়েছিল। ফলে ডেঙ্গুর বিষয়টা সাসপেক্ট করলেও জ্বরের তিনদিন পর ডেঙ্গু টেস্ট পজিটিভ আসেনি। বিধায় ডেঙ্গু পরীক্ষা করার সুযোগ ছিল না। আমি তার চলমান এন্টিবায়োটিক ওরালের পরিবর্তে ইনজেকটেড ফর্মে দেই।’
বাবা-মায়ের সাথে শিশু আরফিয়া (ফাইল ছবি)
ড. লাকী আরও বলেন, ‘পরদিন শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় শিশুটির আবারও জ্বর ১০৫ ডিগ্রি পাওয়া যায়। এসময় তার পালস ও প্রেসার ঠিক থাকলেও প্রচণ্ড পেটে ব্যথা ছিল। কিছু খেলেই ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল। আবার সিবিসি, এক্সরে ও পেটের সিআরপি এবং প্রো বিএনপি টেস্ট করতে দেই। কিন্তু শিশুটির মা এসব টেস্ট করাতে রাজি হননি। শিশুর মা বিকালে বলেন, শিশুটির বাবা এলে সন্ধ্যায় টেস্ট করাবেন। সন্ধ্যায় টেস্ট করা হলে তার প্লাটিলেট কম আসে। লবণের মাত্রা পাওয়া যায় ১২১, যা আগের চেয়েও কম।’
ডা. মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘রাত আটটার দিকে বাচ্চার জ্বর একটু কমলেও অস্থিরতা বেড়ে যায়। সে হাতের স্যালাইন খুলে ফেলে। তার বাবা-মাও এসময় বাচ্চাকে বাসায় নিয়ে যেতে চান। সাড়ে ৯টায় বাচ্চার প্রেসার ফল করে। তখন তাকে পিআইসিইউ-তে নিয়ে যেতে বলি। এসময় বাচ্চার ক্রিটিক্যাল ম্যানেজমেন্ট শুরু হয়। রাত দশটার দিকে শিশুটিতে পিআইসিইউতে নেওয়া হয়। রাত ১০টার মধ্যে শিশুটির চিকিৎসক ডা. লাকী আসেন। এর মধ্যে শিশুটি প্রেসার ফল করাসহ নানাবিধ জটিলতায় শকে চলে যায়। শক ম্যানেজ করা হয়, শিশুটি শক রিকভার করে। এসময় তার বাবা-মা দুজনকেই পিআইসিইউতে ঢোকানো হয় এবং বাচ্চার শারীরিক অবস্থা বিষয়ে বিস্তারিত ব্রিফিং করা হয়।’
ডা. লাকী বলেন, ‘শিশুটি পানি খেতে চাইলে তার নিজস্ব পানি পটে তাকে পানি খেতে দেওয়া হয়। এসময় তার বাবা-মা দুজনই তার বেডের পাশে ছিলেন। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে শিশুটির প্রেসার আবারও ফল করে এবং সাড়ে চারটার দিকে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তাকে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দেওয়া হয়। ভেল্টিলেটরে থাকাবস্থায় সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে শিশুটি মারা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুটি জন্ম থেকে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছিল। এসব রোগীদের বিভিন্ন জটিলতা সবসময় থাকে। তার ওপর সেসময় শিশুটির ইউরিন ইনফেকশন, ব্লাড সেফসিস বা ইনফেকশন হয়েছিল। ডেঙ্গু সাসপেক্ট করছি। প্লাটিলেট কমে গিয়েছিল। এসব থেকে শিশুটি রিকভার করতে পারেনি।’
আরফিয়ার মায়ের কয়েকটি অভিযোগ বিষয়ে প্রফেসর ডা. ইসরাত জাহান লাকী বলেন, ‘ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যুতে আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে শকড। তবে তার মা যে বলেছেন, তার মেয়েকে আমরা পানিও খেতে দেইনি- এটি ঠিক নয়। শিশুটি তার নিজের ব্যবহার করা পানির পটেই পানি খেয়েছে (সিসিটিভি ফুটেজ আছে)। শিশুটির মা আরও বলেছেন, বাবা-মাকে মেয়ের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি- এটাও ঠিক নয়। বেশ কয়েকবার তাদের (বাবা-মা) শিশুটির বেডের কাছে (হাইকেয়ার ও পিআইসিইউ) যেতে দেওয়া হয়েছে (সিসিটিভি ফুটেজ আছে)। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন- অথচ শিশুটিকে ওনারা বাসা থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছিলেন। আমি কেবল ওরাল বাদ দিয়ে ইনজেকটিভ ফর্মে এন্টিবায়োটিক দিয়েছি।’
শিশু আরফিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে আদাবর থানায় করা লিখিত অভিযোগের কপি (বাঁয়ে) ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগের কপি (ডানে)।
এদিকে আদাবর থানায় করা লিখিত অভিযোগে শিশুটির মা জোবাইদা আলম উল্লেখ করেন, ‘ডা. মনিরুল ইসলামের কাছে আমার মেয়েকে গত এক বছর ধরে রেগুলার (নিয়মিত) চেকআপ করাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি যেই ডা. মনিরুল ইসলামের কথায় তার কাছে ভর্তি করলাম, সেই ডা. মনিরুল ইসলাম শুধু মেয়েকে নামের দেখা দেখে যেত, আমার সঙ্গে গল্পই করে যেত বেশি। অথচ আমি ডা. মনিরুল ইসলামকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম।’
অভিযোগে জোবাইদা বলেন, ‘‘ভর্তির পর থেকে সব মেডিসিন ডিসিশন দেন আরেক চিকিৎসক ডা. ইসরাত জাহান লাকি। এই ডা. ইসরাত জাহান লাকি আমার মেয়েকে ট্রিটমেন্টের জন্য দেখবেন- তা আমাদের জানানো হয়নি এবং অনুমতির প্রয়োজন মনেই করেনি তারা। ইসরাত জাহান লাকি একের পর এক ভুল হাইপাওয়ারের এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন পুশ করেই চলেন সঠিক রোগ নির্ণয় না করে। ছোট্ট শিশু বাচ্চাটাকে নরমাল একটা জ্বরকে হাইপাওয়ারের এন্টিবায়োটিক দিয়ে একের পর এক হাই পাওয়ারের ভুল মেডিসিন, ভুল ইঞ্জেকশন দিতেই থাকেন। একে একে ভুল স্যালাইন, ইঞ্জেকশন দিয়ে আমার মেয়েটার শরীর খারাপ করতে থাকে। একবার বলে তার টাইফয়েড আরেকবার বলে ম্যালেরিয়া। এমনকি আমাদের টেস্টের জন্য এমন বিলও করেছে, যেই টেস্ট করানোই হয়নি।
‘উনাদের (চিকিৎসক) উদ্দেশ্য ছিল বেশি বিল বানানো। এরা জোর করে ৯ সেপ্টেম্বর বাচ্চার বুকে ইনফেকশন আছে বলে পিআইসিইউতে নিয়ে যায়। আমাদের কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়া। অথচ পরবর্তীতে বুকের এক্সরে রিপোর্ট দেখি নরমাল। এরপর মেয়েকে দেখার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও দেখতে দিচ্ছিল না। জোর করে দেখতে চাইলে আমাদেরকে হাজারটা নিয়ম কানুন দেখাচ্ছিল। আমার মেয়ে পিআইসিইউতে রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা অবধি চিৎকার করে কাঁদে। যতবার কান্নাকাটির শব্দ শুনে দেখতে চেয়েছি, ততবার দায়িত্বরতরা বলেছে আমার মেয়ে ঘুমায়। জোর করে ভেতরে ঢুকে দেখি হ্যাঁ আমার মেয়ে কাঁদছে পানির জন্য, তাকে তারা বিভিন্নভাবে অত্যাচার করছে সেজন্য কাঁদছে। একে একে অত্যাচার করে আমার মেয়েকে শেষ অবধি ডাক্তার নামের কসাইরা মেরেই ফেলে। মেরেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, তারা লাইফ সাপোর্ট দিয়ে এক সপ্তাহ রাখার প্ল্যান করে।’’
অভিযোগে জোবাইদা বলেন, ‘তারা (চিকিৎসক) আমাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য একবার ডায়াপার লাগবে বলে, আরেকবার ব্ল্যাড ডোনার লাগবে বলে নাটক করে। ডায়াপার ওদের ফার্মেসি থেকে নিতে বললে তারা আমাদের জানায় ওদের কাছে নেই। ব্ল্যাড না দিয়েও ব্ল্যাডের জন্য ৪০ হাজার টাকা বিল করে। কত কত অত্যাচার করে শেষ অবধি তারা আমার একমাত্র মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল।’