পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়ম-জালিয়াতি বন্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে এ পরীক্ষা আয়োজন করতে চায় সরকার। শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে অনিয়মের সঙ্গে কমবে শিক্ষার্থী হয়রানি ও অর্থ ব্যয়।
এ কারণে স্নাতক পর্যায়ে ১ম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা মেডিকেল কলেজের মতো কেন্দ্রীয়ভাবে নেয়ার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ এবং ভর্তি পদ্ধতির নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে আগামী ৬ ডিসেম্বর সকালে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সভা ডেকেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসেন বুধবার দুপুরে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করতে। এ পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গুচ্ছ পদ্ধতি হতে পারে। বারবার চেষ্টা করেও সবাইকে একক সিদ্ধান্তে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ সুবিধা নিয়ে অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতিসহ নানা ধরনের অনিয়ম করে আসছে।
মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করলে সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় অনেক উপাচার্য পিছিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আগামী মাসে উপাচার্যদের নিয়ে সভা করে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করব।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৬ ডিসেম্বরের সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। সভায় উপস্থিত থাকতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) চেয়ারম্যান, ইউজিসির তিনজন সদস্যসহ মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সব কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকতে বুধবার চিঠি দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলো আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটতে হয়। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। অনেক সময় একই দিনে ভর্তি পরীক্ষা পড়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন কি সকালে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে বিকেলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়, দেড়-দুই মাস সময় নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার এ রেসে টিকতে না পেরে অনেকে ছিটকে পড়েন।
কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা না নেয়ায় একটি আসনের বিপরীতে শতাধিক শিক্ষার্থীকে লড়াই করতে হয়। প্রতিযোগিতায় টিকতে শিক্ষার্থীরা কোচিংমুখী হয়ে পড়ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে পুঁজি করে প্রতিবছর অর্ধ কোটি টাকা কোচিং সেন্টারগুলোর হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষার আয়োজন করা হলে আসন প্রতি প্রতিযোগীর সংখ্যা ১০ জনের নিচে নেমে আসত। অভিভাবকদের হয়রানি ও অর্থ খরচ কমে যেত। কোচিং বাণিজ্যও নিরুৎসাহিত হতো।
২০০৯ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার চিন্তা করে সরকার। তবে উপাচার্যদের কারণে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরা সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ নিলেও সিলেটে স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে তা ভেস্তে যায়।
এরপর ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কয়েকজন উপাচার্যদের বিরোধিতায় এ প্রক্রিয়াও আর এগোতে পারেনি।
সূত্র জানায়, গত বছর নভেম্বর মাসে ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদের কাছে তুলে দেয়ার সময় তিনি শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবের জন্য সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পরে ইউজিসি চেয়ারম্যান এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। মন্ত্রণালয় উপাচার্যদের নিয়ে সভা করার তারিখ নির্ধারণ করলেও তা আর হয়নি।
ইউজিসি সূত্র জানায়, উপাচার্যদের অনাগ্রহের নেপথ্যে রয়েছে ভর্তি ফরমের অর্থ ব্যাণিজ্য। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম চারশত টাকা করে বিক্রি করে আয় করেছে আট কোটি ৫৯ লাখ ৭৭ হাজার ৯০০ টাকা। এর আগের বছর আয় করেছে আট কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
গত বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আয় করেছে সাত কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করে। ফরম বিক্রির ৪০ ভাগ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। বাকি টাকা শিক্ষকরা সম্মানী বাবদ ভাগভাটোয়ারা করে নেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে ৪০ ভাগ টাকাও সঠিকভাবে জমা দেয়া হয় না।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হন শিক্ষার্থীরা। তাদের কষ্ট লাঘবে অনেক আগে থেকেই গুচ্ছ পদ্ধতির কথা বলে আসছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের উদ্যোগ মেনে নিচ্ছে না। আশার কথা হলো, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে রাজি হয়েছেন। কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. আখতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন।