এমনি দিনের একটা স্মৃতি আজও মনে আছে। একদম স্পস্ট। জ্বলজ্বলে। গাড়ি থামবে তো হকার উঠবে না!! ভিক্ষুক উঠবে না!! এটা কল্পনাও করতে ভয় পায় আজব এ শহরের মানুষ। কারওয়ান (অনেকে কাওরান ও বলে থাকে) বাজার এলাকার অদুরে প্যান প্যাসিফিকের পাশে গাড়ি দাড়ানো। হাতিরঝিলের নিঃশ্বাসের গন্ধ নাকে ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছি অভিজাতদের আড্ডাখানা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও এর দিকে।
একজন ভিক্ষুক উঠল বুঝি আমাদের বাসে! লাঠি ভর করে। অন্ধ। স্বাস্থ্য ভালো। পোষাক বলতে লুঙ্গি, রোদে পোড়া খয়েরি রং এর পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি। ভুল প্রমান করলো সে। সে আদতে ভিক্ষার জন্য আসে নি। এসেছিলো কিছু পসরা নিয়ে। কাঠপেন্সিল, সার্পনার আর কলম। সালাম দিলো, সুন্দর ব্যাবহার, স্পস্ট কথা, ভদ্রতা। আমি অন্ধ মানুষ, সংসার আছে, আছে বিবি বাচ্চা, আমাদের আছে ক্ষুধার পেট, দানবের মতো ক্ষুধা, আছে রোগ – শোক। কিছু কাঠপেন্সিল, সার্পনার আর কলম এনেছি, ভালো ব্রান্ড, ভালো পন্য, বেশি কতগুলো নিলে একটু কমিয়েও রাখবো, আপনাদের বাচ্চাদের জন্য বা স্টুডেন্টকে গিফট করার জন্য নিতে পারেন চাইলে। ভিক্ষা নিবো না গো, সম্মানে বাচতে চাই।
আসছে খবর, হবে ক্ষিধের অবসান!
অবাক করা ব্যাপার, কেউ তার সকরুন সুর শুনলো না যেন। আমি চিন্তা করেছি কিনবো, মনছবি দেখেছি আমার স্টুডেন্ট সিহানকে গিফট হিসেবে দেয়া যাবে এ পেনসিল বা কলম, কিন্তু টানাটানির পকেট, মতিঝিল থেকে ৩০ টাকার রিকশা পথ হেটে যেতে হবে। বাসায় ফিরতে হবে আত্মীয়ের থেকে ভাড়ার টাকা চেয়েই।
আহারে দুনিয়া, হায়রে দুনিয়া। হাস্য মুখটা মলিন হলো তার। ব্যাথাতুর অন্তর নিয়েই ফিরে যাচ্ছে অন্ধ মানুষটি। লজ্জা এবং অপরাধবোধ নিয়ে তার ফিরতি পথের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম ক্ষণকাল। ভাবনার কালো ছায়া সে মুখে। এভাবে হচ্ছে না। এভাবে হবে না। নিশ্চয়ই তার সন্তানদুটি অপেক্ষায় আছে, কখন ফিরবে বাবা? কখন আনবে দুটি সস্তা চকলেট। বাবা ফিরবে হয়তো, ফিরবে হতাশা নিয়ে, ফিরবে বাচ্চাদের কাছে একরাশ লজ্জা নিয়ে, হয়তো তাকাতে পারবে না তার বিবির মুখের দিকে, লজ্জায় নির্বাক থাকবে। গুমরে কাঁদবে তার অন্তর। হায়রে সমাজ। নিঠুর সমাজ।
নাহ বেশিক্ষণ না, একটু বাদেই আরেকজন। ইনি একজন মহিলা, মায়ের জাত, এদের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা একটু বেশিই। অন্ধর থেকেও কষ্টেসৃষ্টে বাসে উঠলেন ইনি। বয়স আন্দাজে ৪০। হাতে একটা প্লাস্টিক পলি ফাইল। বেশ কিছু কাগজ তাতে। ইনি নাকি ক্যান্সার রোগী!!! ফাইলই তার প্রমান। কারো মাথায় হাত রাখেন, কারও কাধে, কাউকে আবার আঙুল দিয়ে হাতের ডানায় খোচা দেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন কাঙ্খিত মানুষটির চোখে। চোখে তার আকুল আকুতি। যাত্রীরা এবার নড়েচড়ে বসল। উথলে উঠল অন্তরের সব মায়া। এ যেন যাদু!! ৫, ১০ লেখা ব্যাংক নোট দেখলাম কয়েকজনের হাতে। তাতে এও লেখা আছে “চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে।”
মাত্র দের কি ২ মিনিট। মায়ের কারবার শেষ। এবার তিনি নামবেন। খেয়াল করি এবারও। কিন্তু কিছুটা কি ব্যাতিক্রম হলো!! ওঠা আর নামার মাঝে কিছুটা পার্থক্য দেখলাম যেন!! টাকা পেয়ে কি তার তাকত বেড়ে গেল? টাকার গন্ধই কি তার ক্যান্সারের প্রতিষেধক? তিনি নামলেন। কিছুটা স্বাভাবিক ভাবেই। বাস কিন্তু তেমন আগাচ্ছে না। জানালার কাচ আমার চোখকে আটকাতে পারে নি। আরেকটু কৌতুহল হয়ে। তাকিয়েই থাকি। ফুটপাথে সে। এখন সে হনহন হয়ে হাটছে।
সুকুমার বাবুর একটা কবিতা মনে পড়ল,
চলে হনহন. ছোটে পনপন. ঘোরে বনবন. কাজে ঠনঠন. আহারে জীবন. (রয় বাবুর অনুমতি নিয়ে শেষটুকু আমিই এ্যাড করলাম)
জীবনে অনেক ক্যান্সার রোগী দেখলাম রে খোদা। সুফিয়া বু মরলো এতে (অন্য একদিন শুনাবো তার কথা)। আমার এক প্রিয় মামি হারিয়ে গেলেন এ রোগে। আমাদের মাইনুল ও নেই এর অত্যাচারে। বহু ধরনের ক্যান্সার আছে। আছে সেগুলোর প্রতিষেধকও। কিন্তু আজব প্রতিকারক আজ প্রথম দেখলাম। টাকা। মানিক ভাই তার গানে বলেছিলো “বাস্টার্ড টাকা, ননসেন্স টাকা, কালপ্রিট টাকা।” ওনাকে আমার সত্যবাদীই মনে হচ্ছে আজ।
এখন প্রশ্ন হলো সেই মা এমনটা কেন করলেন? কে শেখালো? কে বাধ্য করলো তাকে? দোষটা কাদের?
আমি যদি বলি দোষটা আমাদেরই, তাহলে কি আপনি রেগে যাবেন!!! আমরাই এটা শেখাচ্ছি, বাধ্য করছি। এমন বললে কি আমাকে ভুল বলবেন!!!
ফ্লাসব্যাকে যান, সেই খেটে খাওয়া ভাইয়ের প্রতি কিন্তু আমরা উদাসিন ছিলাম তখন। তার সৎ চেষ্টাটাকে আমরা মূল্যায়ন করিনি। এটা কি তাকে অভিনয়ের সাথে ভিক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করবে না? সাক্ষী হিসেবে কয়েকটা প্রেশক্রিপশনই তো যথেষ্ট, তাইনা? ভুয়া ডাক্তারের ছড়াছরি আজ, ভুয়া প্রেশক্রিপশন তো দুধভাত।
বয়সের ভারে ন্যূজ মানুষটি, যাকে আমরা বৃদ্ধ বলি, কষ্ট সয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাড়িয়ে যাত্রা তার। তখন আমরা চোখকানা। অথচ একটি সুন্দরী ললনা দাড়িয়ে থাকলে তখন আমাদের চেতনায় হু হু করে বাতাস বয়। বৃদ্ধ দাড়িয়েই যাবে অার ললনা পাবে বসার অধিকার, কেন? জয়তু চেতনা, যয়তু মানব – দানব, যয়তু মনুষ্যত্ব।
অাপনার অন্তর যদি দয়াদ্র হয়, গরীবদের দুঃখগুলোতে যদি আঙুল বুলিয়ে দেখার ইচ্ছা থাকে আপনার, তাহলে আসুন
যোগ দিন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে । Journey To Smile এ
লিখতে পারেন এখানেও। যোগাযোগ করুন আমার সাথে 01521 312023 নাম্বারে। অথবা আমাকে ইনবক্স করুন ফেসবুকে
ধন্যবাদ