ভাষা আন্দোলনে বরিশালের অবিস্মরণীয় অবদান, জানে না বরিশালবাসী

:
: ২ years ago

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকায় হলেও নেতৃত্বে ছিল বরিশালের বিশিষ্টজনদের অবিস্মরণীয় অবদান। সর্বদলীয় ‘রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ’- এর ২৮ সদস্যের মধ্যে আহ্বায়কসহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পদে নেতৃত্ব দেন বরিশালের সন্তান। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকজন রয়েছেন যারা জাতীয়ভাবে আলোচিত এবং সর্বজন শ্রদ্ধেও। কিন্তু তাদের স্মরণে কোনো আয়োজন নেই এই অঞ্চলে। হতবাক করা তথ্য হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনে শহীদদের নাম ছাড়া তরুণ প্রজন্ম জানেই না মাতৃভাষা আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা বরিশালের।

ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা মনে করেন, রাষ্ট্রের উদাসীনতার কারণে স্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছেন জাতিগত মুক্তির সেইসব স্বপ্নদ্রষ্টারা। এ জন্য তরুণ প্রজন্মের যেমন অসচেতনতা রয়েছে তেমনি দায়ী উত্তর প্রজন্মও। তা না হলে কেন ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও জন্মভিটার মানুষ পরিচিত হতে পারল না ভাষা সংগ্রামীদের সঙ্গে? এমনকি ভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়কের স্মৃতিতে নির্মিত তোরণ ভেঙে ফেলার অভিযোগ রয়েছে।

এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কংক্রিটে নির্মিত শহীদ মিনারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে বলেও উদ্বেগ বিশিষ্ট নাগরিকদের। তারা মনে করেন, কংক্রিটে নির্মিত মিনারের চেয়ে মননে নির্মিত শহীদ মিনার দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভাষা সংগ্রামী, প্রেক্ষাপট ও এর সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।

গবেষক ও অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী বলেন, ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। ওই পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলা কসবা গ্রামের কাজী গোলাম মাহবুব। এ ছাড়া শামসুল আলম, শামসুল হক চৌধুরী, আখতার উদ্দিন আহমেদ এবং মুহাম্মদ মুজিবুল হক ছিলেন ওই কর্মী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। যাদের সকলের বাড়িই বরিশালে।

তিনি আরও বলেন, একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…. গানটির গীতিকার আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সুরকার আব্দুল লতিফ এবং শহীদ আলতাফ মাহামুদের বাড়িও বরিশালে। এ ছাড়া আন্দোলনে অনন্য অবদান রাখা দার্শনিক সরদার ফজলুল করিমের বাড়িও বরিশালে। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের সাথে সারাদেশের সাংস্কৃতিক, প্রগতিশীল, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রসমাজ একাত্মতা পোষণ করেছিল। তবে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানে বরিশালের মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

কবি হেনরী স্বপন বলেন, ভাষা আন্দোলনে বরিশালের নেতৃবৃন্দের যে অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে তার কিছুই জানে না নতুন প্রজন্ম। আমি মনে করি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বরিশালের যেসব মানুষ কেন্দ্রীয়ভাবে অবদান রেখেছেন তাদের স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা তাদের নাম ফলক তৈরি করা উচিত ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত এখানকার নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় প্রশাসন, শিল্প-সংস্কৃতির মানুষ তার কিছুই করেনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা; কারণ আজ পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া মানুষদের পরিচয় করাতে পারিনি কিংবা ইতিহাস তুলে ধরতে পারেনি। হেনরী স্বপন মনে করেন, ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া বরিশালের সন্তানদের নিয়ে স্থাপনা নির্মান করা উচিত, যাতে করে এই অঞ্চলের মানুষ ভাষা সংগ্রামীদের সাথে পরিচিত হতে পারেন।

প্রবীন সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন এসএম ইকবাল বলেন, ভাষা আন্দোলনে বরিশালের একটি অনন্য অবদান রয়েছে। ভাষা আন্দোলন সারা বাংলাদেশের আন্দোলন, কিন্তু নেতৃত্বে ছিল বরিশাল। নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তাদের নাম এখন অনেকেই জানেন না। ফলে অনেক ভুল নাম উচ্চারিত হয়। অনেক ভাষা সংগ্রামী দীনহীনভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।

তিনি আরো বলেন, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর গানটি প্রথমে সুর দিলেন আবদুল লতিফ। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফকির বাড়ি রোডস্থ তার দুইতলা টিনের ঘরের দোতলায় বলে সুর দিলেন। সেই টিনের ঘরটি এখনো আছে। এমনকি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি বরিশালেই প্রথম গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব কিছুই সংরক্ষণ কিংবা তাদের এই প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি, এটি অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা। এখনো আব্দুল গাফফার চৌধুরী বেঁচে আছেন, তাকে বরিশালে এনে এই প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস এবং আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের সর্ম্পকে জানানো যেতে পারে।

শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাতি সাইদুর রহমান সোহেল বলেছেন, অমর একুশের গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ আমার পিতার মামা হন। আমরা বর্তমানে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সেই সময়কার টিনের ঘরে বসবাস করি। শুনেছি এই ঘরের দোতলায় বসে গানটির সুর করেছিলেন। ঐতিহাসিক এই ঘরটিকে স্মৃতি হিসেবে অবিকল রেখে দিয়েছি।

সাবেক ছাত্র নেতা শামিল শাহরোখ তমাল বলেন, ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যারা তার মধ্যে পাঁচজন বরিশালের সন্তান। সেই শ্রদ্ধেয় মানুষদের স্মরণ তো পরের কথা, আমরা তাদের চিনিই না। তরুণ প্রজন্ম জানে না, ইতিহাসেও এই মাহান মানুষগুলো অবহেলিত। এই ব্যর্থতা যেমন বরিশালবাসীর তেমনি রাষ্ট্রের, আবার তরুণ প্রজন্মও ব্যর্থতা এড়াতে পারেন না।

বিশিষ্ট গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ভাষা আন্দোলন যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল তা কেবল ১৯৫২ সালে নয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা। এই সূচনাকে যারা তীব্রতর করেছিলেন তার মধ্যে সর্বদলীয় যে সংগ্রাম কমিটি হয়েছিল সেখানে আহ্বায়ক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পদে ছিলেন বরিশালের সন্তান। যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। কিন্তু আমাদের দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই সর্ম্পকে এই প্রজন্মের জানা-শোনা খুবই কম। এমনকি ওই আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের নামের তোরণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এইভাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানাতে যে বিষয়গুলো আমাদের ছিল তা তুলে ধরতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

বিদগ্ধ এই গবেষক মনে করেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য, বাংলা ভাষা আজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাই হয়তো অনেকেই ভাবছেন বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের যে লক্ষ্য ছিল সেটি এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। সেই অপূর্ণতার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আমরা ভুলে গেছি। এসব নিয়ে আমাদের মধ্যে চর্চা নেই। আমি মনে করি ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। পাশাপাশি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে। নয়তো ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে বলে আমরা কখনোই দাবি করতে পারি না।