ভারতের ১ম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু

:
: ৪ years ago

ভারতের স্বাধীনতার পর যে কয়েকজন বাঙালি নয়াদিল্লির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে সফল এবং উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বলা হয় প্রণব মুখার্জিকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিদেশিদের সমর্থন আদায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে যে ভারতীয়রা কড়া নেড়েছিলেন; প্রণব মুখার্জি ছিলেন তাদের অন্যতম। ভারতের সফল এই সাবেক রাষ্ট্রপতি ছিলেন বাঙালি, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসা প্রণব নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দিল্লির রাইসিনা হিলের মসনদে বসেছিলেন প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসেবে।

২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সক্রিয় রাজনীতিতে প্রণবের ভূমিকার অবসান ঘটে। কিন্তু কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্কটের নানা মুহূর্তে বারবারই তার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ চলে এসেছে আলোচনায়। তার সাফল্য সঙ্কীর্ণ বাঙালি পরিচয়ের সীমা ছাড়িয়ে আসলে আরও কতদূর বিস্তৃত হতে পেরেছিল সেটিও প্রমাণ করে।

প্রণবের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের মিরিটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্যও ছিলেন। সেদিক থেকে রাজনীতি প্রণবের উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। যদিও সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতির ছায়া মাড়াননি তিনি।

বরং ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পর মন দিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি পাওয়ায়। তবে আইনজীবীর পেশাকে বেছে নেননি তিনি। ডাক ও তার বিভাগে করণিক এবং হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতা পর্বের পরে ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলার বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় যোগ দেন।

১৯৫৭ সালে শুভ্রাদেবীকে বিয়ের সময় আত্মীয়-পরিজনদের একাংশের আপত্তি উঠলেও তাতে সাড়া দেননি প্রণব। কারণ তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ছিলেন না। প্রণব তাতে তোয়াক্কা করেননি। বিদ্যানগর কলেজে যোগ দেয়ার পরে টানা পাঁচ বছর আমতলায় ছিলেন প্রণব। রিকশায় যাতায়াত করতেন প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরের কলেজে। মুখোপাধ্যায় দম্পতির পছন্দও হয়ে গিয়েছিল জায়গাটি। সেখানে থিতু হওয়ার জন্য জমিও কিনেছিলেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৬ সালে বিদ্যানগর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে, শুরু হওয়া রাজনৈতিক সফর প্রণবকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দূরের অন্য ঠিকানায়।

১৯৬৭ সালের বিধানসভা ভোটে হরেন্দ্রনাথ প্রার্থী হন। প্রণব নির্বাচনী প্রচারে পথে নামেন। দ্রুতই পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের প্রধান তথা রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের নজরে পড়েন প্রণব। প্রণবের বাবা কামদাকিঙ্করের সঙ্গে অজয়ের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। যদিও তাকে কংগ্রেস ছাড়িয়ে নিজের দলে আনতে পারেননি অজয়।

১৯৬৯ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের নানা প্রান্তে প্রচারে পাঠানো হয় প্রণবকে। মেলে রাজ্যসভার সাংসদ পদ। ওই বছর মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বাংলা কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী, নেহরু জমানার প্রতিরক্ষামন্ত্রী কে ভি কৃষ্ণমেননের জয়ের নেপথ্যেও বড় ভূমিকা ছিল প্রণবের।

সংসদীয় রাজনীতির ইনিংস শুরুর পরই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নজরে আসেন প্রণব। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭১ সালে প্যারিসে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভায় যে ভারতীয় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে বিদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল ৩৬ বছরের প্রণব সেই দলে ছিলেন। তখনও তিনি পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসেই ছিলেন।

১৯৭৫ সালে কংগ্রেসের টিকিটে দ্বিতীয়বার রাজ্যসভার সদস্য হন প্রণব মুখার্জি। তার আগে ১৯৭৩ সালে শিল্প প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রবেশ। ততদিনে তার পুরনো দল বাংলা কংগ্রেসও মিশে গেছে কংগ্রেসে।

১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটের কংগ্রেসের ভরাডুবির পর দলের অন্দরে ‘ইন্দিরা হটাও’ স্লোগান জোরদার হয়েছিল। যার জেরে ফের দল ভেঙেছিল। একাধিক নেতা ভিড়েছিলেন বিরোধী শিবিরে। কিন্তু প্রণব সেই স্রোতে শামিল হননি। এমনকি আইনি ঝক্কি এড়াতে কংগ্রেসের একাধিক নেতা যখন বিচারপতি জে সি শাহের কমিশনে হাজির হয়ে জরুরি অবস্থার সব দায় ইন্দিরার কাঁধে চাপিয়েছেন, তখনও দলনেত্রীর প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে প্রণব ছিলেন অটল। সেই আনুগত্যের পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন পরবর্তীকালে।

লোকসভা ভোটে হেরে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পুনর্বাসনের ঘটনা নেহরু কিংবা ইন্দিরার সময় বড় একটা হয়নি। প্রণব এ ক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম। ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটে দেশজুড়ে প্রবল ইন্দিরা হাওয়ার মধ্যেও বোলপুর কেন্দ্রে সিপিএমের কাছে হেরেছিলেন তিনি। প্রণব নিজেই পরে জানিয়েছিলেন, সে সময় ইন্দিরা তাকে লোকসভা ভোটে প্রার্থী হতে নিরুৎসাহিত ছিলেন। কারণ তার তিন বছর আগেই ১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের দুর্গ মালদহে হেরেছিলেন প্রণব।

‘পরামর্শ’ না শোনার জন্য প্রণবকে মৃদু ভর্ৎসনাও করেন দলনেত্রী। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি, রাজ্যসভায় কংগ্রেসের প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালে ফের উত্থান। এবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রণব হলেন ইন্দিরা ক্যাবিনেটের ‘নাম্বার টু’। প্রণবের সময়ই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মনমোহন সিংহ।

ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর দ্রুত কংগ্রেসের অন্দরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন প্রণব। রাজীব জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি করে পাঠানো হয় তাকে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হাইকম্যান্ডের সঙ্গে সংঘাতের জেরে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নতুন দল গড়ে ১৯৮৭ সালের বিধানসভা ভোটে বহু আসনে প্রার্থী দিয়েছিলেন প্রণব। তাদের একজনও জিততে পারেননি। কিন্তু কয়েক ডজন আসনে ভোট কেটে কংগ্রেস প্রার্থীদের হার সুনিশ্চিত করেছিলেন।

অনেকে বলেন, ইন্দিরা নিহত হওয়ার পরে মন্ত্রিসভার দু’নম্বর হিসেবে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ‘ইচ্ছাপ্রকাশ’ করেছিলেন প্রণব। রাজীব বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। যদিও পরবর্তী সময়ে একাধিকবার প্রণব জোর গলায় জানিয়েছেন, ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর রাজীবের পশ্চিমবঙ্গ সফরের সময় এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ পর্বে রাজীব উপলব্ধি করেছিলেন প্রণবের গুরুত্ব। দলে ফিরিয়েছিলেন তাতে। ১৯৮৯ সালের ভোটে কংগ্রেসের হারের পর দলের অন্দরে ফের পুরনো অবস্থানে ফিরতে শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৯১ সালের লোকসভা ভোটপর্বের মাঝেই তামিল জঙ্গিদের মানববোমায় নিহত হন রাজীব।

পি ভি নরসিংহ রাওয়ের আমলে প্রথমে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রণবকে। অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আর্থিক সংস্কার নীতি রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। দু’বছর পরে বাণিজ্য মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে প্রণবকে ক্যাবিনেটে ফিরিয়েছিলেন রাও। ১৯৯৫ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও দিয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ২৩২ থেকে নেমে এসেছিল ১৪০-এ। ভোটে ভরাডুবির দায় নিয়ে নরসিংহ রাও কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পরে তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রণবের নাম উঠে এসেছিল জোরেশোরেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সভাপতি হয়েছিলেন সীতারাম কেসরী। সত্তরের দশকে বিহার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ ছেডে় এআইসিসি-র কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব নেওয়ার পরে ইন্দিরা, রাজীব এবং রাও জমানায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব সামলালেও প্রণবের মতো রাজনৈতিক ওজন কেসরীর ছিল না।

তবুও কেন কেসরীকে উত্তরসূরী বেছেছিলেন রাও? বহু বছর পরে একটি সাক্ষাৎকারে প্রণবের ব্যাখ্যা ছিল, ‘সম্ভবত রাও মনে করেছিলেন, কেসরী সভাপতি হলে বকলমে দলের রাশ তারই হাতে থাকবে।’ যদিও তা হয়নি। সভাপতি হয়েই রাওকে কংগ্রেস সংসদীয় নেতার পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিলেন কেসরী। এমনকী, ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটের টিকিটও দেননি!

১৯৯৮ সালে লোকসভা ভোটের পরে কংগ্রেসের অন্দরে ‘অভ্যুত্থানে’ গদি হারান কেসরী। ‘স্বেচ্ছা নির্বাসনের’ পালা শেষ করে দলের দায়িত্ব নেন সনিয়া গান্ধী। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিরুদ্ধে রাজ্যওয়াড়ি পাল্টা নির্বাচনী সমঝোতা গড়ায় মূল কারিগর ছিলেন প্রণব। আনন্দবাজার লিখছে, ভোটে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের পতনের পর কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হয় ইউপিএ জোটের। আর সেই ভোট প্রণবের জীবনেও এনেছিল নতুন হাওয়া। অধীর চৌধুরীর ‘আমন্ত্রণে’ মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে সেই প্রথমবার জনতার ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হন তিনি।

‘অন্তরাত্মার ডাক’ শুনে সোনিয়া প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণে অপারগতার কথা জানানোর পর আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিল প্রণবের নাম। কিন্তু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয় ‘অরাজনৈতিক’ মনমোহনকে। দু’দশক পরে ফের প্রণব ফিরে যান তার ‘নাম্বার টু’ আসনে। ইউপিএর দু’টি মেয়াদে প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি, নানা গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব এমনকি, ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি রূপায়ণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরে সক্রিয় রাজনীতিকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি।

সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বহু বার বিরোধীদের এমনকি, দলের অন্দরেও সমালোচনার শিকার হয়েছেন প্রণব। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায় নেওয়ার পরেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ায় প্রণবকে খোঁচা দিয়েছিলেন কংগ্রেসে তার পুরনো সহকর্মীরাও। এ ক্ষেত্রেও সৌজন্য মেনেই জবাব দেওয়ার কোনও চেষ্টা করেননি। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সংখ্যাগুরুর আধিপত্য নয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের গরিমা আসলে পরমত সহিষ্ণুতা এবং বিরুদ্ধ যুক্তি তুলে ধরার স্বাধীনতায়। জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে আজ সরকার ও বিরোধীপক্ষের তিক্ততা যখন চরমে, প্রণবের এই শিক্ষাই পাথেয় হতে পারে।