ভর্তুকি বেড়েছে বহুগুণ, লোডশেডিং দিতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারকে লোড-শেডিং দিতে হচ্ছে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের লোড-শেডিং দিতে হবে এবং বিদ্যুতের উৎপাদন সীমিত করতে হবে। কারণ, আমাদের বিদ্যুতের ভর্তুকির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে গেছে।’

 

বুধবার (৬ জুলাই) চুয়েট ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চুয়েট শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ নামে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসভিত্তিক আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ জামাল ডরমিটরি এবং রোজী জামাল ডরমিটরি-ও উদ্বোধন করেন।

প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিদ্যুৎ সংরক্ষণের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময় ভিত্তিক লোড-শেডিংয়ের জন্য একটি রুটিন তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।

 

তিনি বলেন, ‘কোন এলাকায় কত সময় লোড-শেডিং দেওয়া হবে তার একটি রুটিন তৈরি করুন। কারণ, জনগণ যেন সেজন্য প্রস্তুত হতে পারে এবং তাদের দুর্ভোগ কমানো যায়।’

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল, এলএনজি, ডিজেলসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে এবং আমেরিকা ও ইউরোপের রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটছে তা উপলব্ধি করে দেশবাসী সরকারকে এ লক্ষে সহায়তা করবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখার জন্য গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানিতে আমাদেরকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।’

 

বর্তমান বাজেটে ৮৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভর্তুকি না কমালে সরকার টাকা কোথা থেকে পাবে?’

তিনি বলেন, ‘ভর্তুকি ছাড়াও তার সরকার দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য প্রণোদণা প্যাকেজ দিয়েছে, ভর্তুকি মূল্যে প্রয়োজনীয় জিনিস পেতে এক কোটি রেশন কার্ড দিয়েছে এবং বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিচ্ছে, যা অনেক ধনী দেশও করেনি।’

 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সরকারকে কী পরিমাণ ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে তারও একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘যে ফার্নেস অয়েলের মূল্য ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা, সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের পর হয়ে গেছে ১ হাজার ৮০ টাকা। অর্থাৎ ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এলএনজি যেটা মাত্র ১০ মার্কিন ডলারে ক্রয় করা হতো, যুদ্ধের ফলে সেটা এখন ৩৮ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৮০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। আমাদের কয়লাও ১৮৭ মার্কিন ডলার ছিল, এখন ২৭৮ মার্কিন ডলার। বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ। ডিজেলে ছিল ৮০ মার্কিন ডলার ছিল তা এখন ১৩০-এ চলে এসেছে। শোনা যাচ্ছে ৩০০ ডলার পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে। ভোজ্য তেলেরও দাম বাড়ছে। প্রত্যেকটি জিনিস যেগুলো কিনে আনতে হয়, তার দাম অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি ক্রয়ে সরকারের ব্যয় ৫৯ দশমিক ৬০ টাকা। কিন্তু আমরা সেটা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছিলাম মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ টাকায়। যেটা সম্প্রতি ১১ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তারপরও বিশাল অংকের ভর্তুকি রয়ে গেছে সেখানে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৮৪ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা, কিন্তু একক প্রতি পাইকারি মূল্যে আমরা দিচ্ছি ৫ দশমিক ০৮ টাকায়।

‘ফার্নেস ওয়েলের প্রতি একক ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ১৭ দশমিক ৪১ টাকা, সেটাও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকায় দিচ্ছি। ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা সেখানেও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করছি। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৩৭ টাকা, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ০৮ টাকায়। অর্থাৎ সারা বিশ্ব এখন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।’’

সরকার প্রধান সারাদেশে ২৭১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা দেন। যার মধ্যে ২০৫১টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের অধীনে এবং ৬৬৫টি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এমপিও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকার শিক্ষায় বিনিয়োগকে ব্যয়ের পরিবর্তে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেছে। কারণ, তারা বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানভিত্তিক প্রজন্ম তৈরি করতে চায়, যাতে নতুন প্রজন্ম সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে।’

সরকারকে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদাগুলোর জোগান দেওয়ার পর আবার কৃষিতেও ভর্তুকি দিয়ে এত বিশাল অংকের ভর্তুকি আর কতদিন দেওয়া সম্ভব হবে সে প্রশ্নও তুলে সবাইকে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়ী হওয়ার আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘যদিও জাতিসংঘের মহাসচিবের উদ্যোগে একটি চ্যাম্পিয়ন গ্রুপ হয়েছে। সেখানে আমি সদস্য হিসেবে আছি। সেখানে আলোচনা হয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য এবং সার যেন আনতে দেয় সে বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা এবং সুইফট বন্ধ করার কারণে আমরা ডলার দিয়ে রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে জিনিস কিনতে পারছি না। কাজেই ফাইন্যান্সিয়াল ম্যাকানিজম যে কী হবে এটার উত্তর কেউ দিতে পারেনি।’

অতীতে সরকার পরিবর্তন হলেই উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট হওয়ার যে রীতি দেশে প্রচলিত রয়েছে তা যেন আর না হয় সেটাও দেখার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার বিনা অর্থ ব্যয়ে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সাবমেরিন ক্যাবল ‘সি-মি-উই’ এ সংযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁসের অজুহাতে ফিরিয়ে দিয়ে দেশের বিরাট ক্ষতি করে।

‘১৯৯৮ সালে শেখ রেহানা এবং পুত্র ও তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদকে সঙ্গে নিয়ে মালয়েশিয়া সফরকালে মালয়েশিয়ার ‘সাইবারজায়া টেকনোলজি পার্ক’ পরিদর্শনের পর জয় একই আদলে বাংলাদেশেও হাই-টেক পার্ক নির্মাণের প্রস্তাব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় তার তদানিন্তন সরকার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেরও উদ্যোগ নেয়। কিন্তু, দুঃখজনক হলো ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামাত জোট হাই-টেক পার্ক স্থাপন প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। ফলে, বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন- ভারত, মালয়েশিয়া হাই-টেক পার্ক/ সফটওয়ার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হলেও পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ।”

সেই সময়ের আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ছোট বোন রেহানার মেয়ে টিউলিপের নামের সাথে কম্পিউটার কোম্পানির নামের মিল থাকায় এটা তার (বর্তমানে লেবার পার্টির নির্বাচিত এমপি এবং শ্যাডো মিনিস্টার টিউলিপের ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি) কোম্পানি বিবেচনায় দেশের ১০ হাজার স্কুলে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় অর্ধেক দামে নেদারল্যান্ড থেকে কম্পিউটার আমদানির যে চুক্তি করেছিলাম তাও বিএনপি সরকার বাতিল করে দেয়। এজন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৩২ কোটি টাকা জরিমানাও গুণতে হয় সরকারকে।’

সরকার যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছে তার ফলাফল এ দেশের নতুন প্রজন্ম পাবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আজকের উদ্যোক্ত তৈরিতে শেখ কামাল বিজনেস ইউকিউবেটর স্থাপনকেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

সরকার প্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বর্তমানে সারা দেশে ৯২টি হাই-টেক পার্ক/সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক/আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৯টি পার্ক স্থাপনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ৬৪ জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মোবাইল এবং ল্যাপটপ উৎপাদনে সহায়ক ১৫৬ টিরও বেশি যন্ত্রাংশের ওপর ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক হ্রাস করে দিচ্ছি। ফলে, বিশ্বের খ্যাতনামা ব্রান্ডের ১৫টি কোম্পানির মোবাইল ফোন সেট আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে এবং ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আগামীতে গার্মেন্টস পণ্যের সাথে আমাদের ডিজিটাল ডিভাইসও সমানতালে বাংলাদেশে উৎপাদন এবং রপ্তানি হবে। রপ্তানি খাতে আগামীতে এটাই হবে একটি উল্লেখযোগ্য পণ্য যেটা রপ্তানি করে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। আর সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং সমগ্র বাংলাদেশেরই সেভাবে প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কোনভাবেই যেন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে পিছিয়ে না থাকে সেভাবেই আমরা তাদের প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থাট করছি।’

তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত অবকাঠামো আমরা তৈরি করছি তা হবে আগামী প্রজন্মের মেধা, বুদ্ধি, জ্ঞানের বিকাশ কেন্দ্র এবং তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে জাতির স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। জাতির পিতা সেই উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখে যেতে না পারলেও তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণই আমাদের দায়িত্ব।’

অনুষ্ঠানে ‘চুয়েট শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’-এর ওপর একটি অডিও-ভিডিও প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

অনুষ্ঠানে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম।