#

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে আজ (মঙ্গলবার) তার রাজনৈতিক জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় নামছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে দীর্ঘ দেন-দরবার করে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে খসড়া চুক্তি তিনি চূড়ান্ত করেছেন সেটির প্রতি সমর্থন আদায়ে দ্বিতীয়বারের মতো তা মঙ্গলবারই সংসদের সামনে পেশ করার কথা রয়েছে।

চুক্তির ওপর ভোটে হারলে, থেরেসা মে’র সামনে দুটো বিকল্প থাকবে। এক. কোনো চুক্তি ছাড়াই ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া; দুই, জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর জন্য ইইউ এর কাছে আবেদন করা।

আজ এই চুক্তিটি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অনুমোদন না দিলে কোনো চুক্তি ছাড়াই ইইউ থেকে বেরুনোর ব্যাপারে বুধবার সংসদে প্রস্তাব আনা হবে। এ নিয়ে বহু এমপির তীব্র আপত্তি রয়েছে। তারা মনে করেন, ব্রিটেনের অর্থনীতি-রাজনীতির জন্য তা চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে। ব্রিটেনের ব্যবসায়ী মহলেরও সেটাই আশঙ্কা।

এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত হলে বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে প্রস্থানের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবে ভোটাভুটি হওয়ার কথা রয়েছে।

জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে তার প্রথম প্রয়াস চরম ব্যর্থ হয়েছিল। যে ব্যবধানে তার চুক্তিটি তখন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তার নজির ব্রিটিশ সংসদে নেই। তার নিজের রক্ষণশীল দলেরই ১১৮জন এমপি ঐ চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তারপর গত কয়েক সপ্তাহ ইইউ নেতাদের সাথে নতুন দেন-দরবার করে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে চুক্তিটি আবার সংসদে নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী মে।

 

ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের চুক্তি দেশটির পার্লামেন্টে অনুমোদনের বিষয়ে কেন এতোটা চাপে আছেন থেরেসা মে? এর কিছু কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।

প্রথমত : ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে কোন সীমান্ত চৌকি, দেয়াল বা বেড়া- এসব কিছুই নেই। এক দেশের লোক অবাধে যখন-যেভাবে খুশি আরেক দেশে যেতে পারে, অন্য দেশে গিয়ে কাজ করতে পারে।

কিন্তু ব্রিটেন যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে তো ব্রিটেন অন্য দেশ হয়ে গেল। ফ্রি মুভমেন্ট অব পিপলস- যা ইইউএর মূল নীতির অন্যতম স্তম্ভ- তা আর তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। সেক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ইইউর মধ্যে সীমান্ত ফাঁড়ি থাকতে হবে। এক দেশের লোক বা পণ্য আরেক দেশে যেতে হলে কাস্টমস চেকিং পার হতে হবে।

কিন্তু ব্রিটেন হলো একটা দ্বীপপুঞ্জ। ইউরোপ ও ব্রিটেনের মধ্যে আছে সমুদ্র- ইংলিশ চ্যানেল এবং নর্থ সি। এই সাগরই সীমান্ত। কিন্তু একটি-দুটি ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম আছে। যেমন আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড মিলে একটি আলাদা দ্বীপ। উত্তর আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের অংশ। আর আইরিশ প্রজাতন্ত্র একটি পৃথক দেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য। এ দুয়ের মধ্যে আছে স্থল সীমান্ত ।

তাই ব্রেক্সিটের পর এটিই পরিণত হবে ইউরোপ আর ব্রিটেনের স্থল সীমান্তে। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলেই এ সীমান্তে কাস্টমস চৌকি বসাতে হবে। আয়ারল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যে যত মানুষ ও পণ্য এখন মুক্তভাবে চলাচল করে- তখন তা আর থাকবে না। শত শত ট্রাক-বাসকে এখানে থামতে হবে, কাস্টমস চেকিং-এর জন্য লাইন দিতে হবে, পণ্য চলাচলে অনেক সময় ব্যয় হবে, দিতে হবে শুল্ক।

অন্যদিকে- এই দুই আয়ারল্যান্ডের মানুষের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক, অনেক পরিবারেরই দুই শাখা দুদিকে বাস করে। ইইউর অংশ হবার কারণে এতদিন সেখানকার লোকেরা মুক্তভাবে একে অন্যের দেশে গিয়ে চাকরি-বাকরি ব্যবসাবাণিজ্য করতেন। এই সবকিছুর মধ্যেই তখন নানা বাধার দেয়াল উঠে যাবে।

আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সহিংস বিদ্রোহের অবসানের জন্য হওয়া গুড ফ্রাইডে চুক্তিতেও আয়ারল্যান্ডের দুই অংশের যোগাযোগ যেভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে- তাও এতে বিপন্ন হতে পারে। এটা যাতে না হয়- সেজন্যই ব্রেক্সিটের পরের জন্য টেরিজা মে’র পরিকল্পনায় ছিল ‘ব্যাক-স্টপ’ নামে এক ব্যবস্থা।

এতে বলা হয়, দুই আয়ারল্যান্ডের মধ্যে কোন ‘হার্ড বর্ডার’ বা বাস্তব সীমান্ত থাকবে না। মানুষ ও পণ্যের অবাধ চলাচল যথাসম্ভব আগের মতোই থাকবে। তবে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থায় সেই সীমান্ত পিছিয়ে চলে যাবে আইরিশ সাগরে। অর্থাৎ উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে পণ্যবাহী ট্রাক যখন ব্রিটেনের মূলভূমিতে ঢোকার পথে সাগর পার হবে- তখন তার কাস্টমস চেকিং হবে, তার আগে নয়।

অন্যদিকে ব্রিটেন থেকে যখন পণ্যবাহী ট্রাক উত্তর আয়ারল্যান্ডে যাবে- তখন সেই পণ্য ইইউ মানের সাথে সংগতিপূর্ণ কিনা তাও পরীক্ষা করাতে হবে। কিন্তু এর বিরোধীদের আপত্তি হলো- তাহলে তো দেশের দুই অংশের জন্য দু’রকম নিয়ম হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলেও তার অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউর আইনের কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাচ্ছে, এটা হতে পারে না।

থেরেসা মে এখন বলছেন, এ ব্যবস্থা হবে সাময়িক, এবং সে ব্যাপারে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা আদায় করতে পরেছেন যার আইনগত ভিত্তি থাকবে। ব্রিটেনের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ হবে না। ব্যাকস্টপ সন্দিহানরা তাতে ভরসা পাবেন কি না সেটা ভোটাভুটির ফলই বলে দেবে।

এছাড়া, ব্রিটিশ সংসদে বহু এমপি রয়েছেন যারা এই ব্রেক্সিটকেই সমর্থন করেন না। নতুন একটি গণভোট চাইছেন তারা। ব্রেক্সিট বিরোধী এমপিরা প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তিত চুক্তিকেও সমর্থন করবেন না ফলে প্রধানমন্ত্রীর চুক্তি সংসদ পাশ করবে এবং ব্রিটেন ২৯ মার্চ ইইউ জোট থেকে বেরিয়ে তা এখনও অনিশ্চিত।

উত্তর দিন

Please enter your comment!
এখানে আপনার নাম লিখুন