ব্যাংকগুলো বড় ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে মোট ঋণের ৫৭ শতাংশই বড় অংকের ঋণ। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের ৪০ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৬৫ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪৭ শতাংশ এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৭৩ শতাংশ বড় ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। এ প্রবণতা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম মিলনায়তনে ‘ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রম’ শিরোনামের বার্ষিক পর্যালোচনা কর্মশালায় এ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। ভিডিও কনফারেন্সে মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী কার্যালয় এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক (গবেষণা, উন্নয়ন এবং পরামর্শ) ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জ্জীর নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিবেদনে ২০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণকে বড় ঋণ ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১৭ সালে ছোট ও মাঝারি ঋণে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২৭ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণে গেছে ১ শতাংশেরও কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাংকগুলোর ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। এ দুটি বিভাগে রয়েছে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৮৬ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে প্রায় ৬৭ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আর মোট ঋণের ৯০ শতাংশ শহরে এবং মাত্র ১০ শতাংশ গ্রামে বিতরণ করা হয়েছে।
কর্মশালার প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান বলেন, ব্যাংক ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময়ই সজাগ। এর পরও খেলাপি ঋণসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জ্জী বলেন, ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সীমা এবং বড় ঋণের বিষয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে ঋণের গুণগত মান উন্নয়নের বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে।
বিআইবিএমের চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, গ্রামের মানুষ ঋণ কম পাচ্ছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কম হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নীতি নির্ধারকদের চিন্তা করতে হবে।
বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, গ্রাহকদের মানসিকতার পরিবর্তন হলে খেলাপি ঋণ অনেকাংশে কমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি বলেন, কিছু ধূর্ত লোক একই সম্পত্তি বার বার দেখিয়ে ঋণ নেন। এ বিষয়ে বার বার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু যথাযথ সমাধান হয় নি। এখানে নজর দিতে হবে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ঋণ দেওয়ার আগে গ্রাহকদের ৬ মাসের ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখতে হবে। খেলাপী ঋণ তদারকিতে ডাটা ব্যাংক করতে হবে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী বলেন, ব্যাংক জনগণের অর্থ ঋণ দেয়। এ কারণে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। ঋণ নিয়ে গ্রাহকরা কারখানা বানালো না কি দামি পাজেরো জিপ কিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা ব্যাংককে নজরদারি করতে হবে।
এনআরবি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, সবগুলো ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করছে। তবে গুণগত মানের উন্নতি হচ্ছে না।
কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্বে) ড. শাহ মো. আহসান হাবীব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিসের মিলনায়তনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহী অফিসের দুই মহাব্যবস্থাপক নুরুন নাহার এবং এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম।
সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি বিআইবিএমের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্বে) ড. শাহ মো. আহসান হাবীব ঋণ আদায়ে আরো শক্তিশালী আইন প্রণয়ন তার প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।