বেঁচে থাকার এবং ভালো থাকার এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে – ড.আতিউর রহমান

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

করোনার ঝড় যেন থামছেই না। শীত আসছে। সংক্রমণও বাড়ছে। বাড়ছে নানা শংকা। এর মধ্যেও আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য খাতের বেহাল অবস্থা অনেকটা কেটে গেলেও অন্যান্য খাতের সাথে এখাতের সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে। বিদেশ থেকে পরীক্ষার ছাড়পত্র ছাড়া কেউ যেন বিমানে উঠতে না পারে তা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন যাদের করা দরকার তারা যেন কোনো ধরনের ছাড় না পান সেদিকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন তাদেরকেও যেন পরিবার, সমাজ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মনিটর করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শীত কালে করোনা টেস্টের চাহিদা বাড়তে পারে। দরকারি কিটসহ সকল ধরনের প্রস্তুতি আগেভাগেই নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত রোগীদের (বিশেষ করে বয়স্কদের) দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা এবং ডাক্তারদের পরামর্শ মতো চলার প্রশ্নে কোনো অবস্থাতেই গড়িমসি করা যাবে না। হাসপাতালগুলোকেও সেভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সব কিছু করার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেয়া কারো পক্ষেই উচিত হবে না। ‘মাস্ক নেই তো সেবাও নেই’- এই কথা যেন সবাই মানেন। সমাজ ও প্রশাসনকে এজন্যে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব নিতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের অনেকেরই এখনও কাজের সুযোগ মেলেনি। এদের সামাজিক সুরক্ষাসহ কাজের সুযোগ বাড়াতে সংশ্লিষ্টজনদের আরও তৎপর হতে হবে। শিশুদের লেখাপড়ায় ও যত্নের দিকে পরিবারকেই বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে। সবার জন্য নির্ভরযোগ্য টিকা পেতে সরকার কাজ করছেন। এক্ষেত্রে ব্যাক্তিখাতকেও সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে হবে। সবাই মিলেই আমাদের বাঁচতে হবে। এই সংকটকালে সমাজ ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথ আমাদেরকেই খুঁজে নিতে হবে। অন্যকে দোষ দেবার আগে নিজের দিকেই আগে তাকাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাতায়নিকের পত্র’ প্রবন্ধে লিখছিলেন, “জাহাজের খোলের ভিতরটায় যখন জল বোঝাই হয়েছে তখনই জাহাজের বাইরের মার সাংঘাতিক হয়ে ওঠে।
ভিতরকার জলটা যেমন দৃশ্যমান নয়, তার চালচলন তেমন প্রচণ্ড নয়, সে মারে ভারের দ্বারা, আঘাতের দ্বারা নয়, সেজন্যে বাইরের ঢেউয়ের চড়-চাপড়ের উপরেই দোষারোপ করে তৃপ্তি লাভ করা যেতে পারে; কিন্তু হয় মরতে হবে, নয় একদিন এই সুবুদ্ধি মাথায় আসবে যে আসল মরণ ঐ ভেতরকার জলের মধ্যে, ওটাকে যত শীঘ্রই পারা যায় সেঁচে ফেলতে হবে। কাজটা যদি দুঃসাধ্যও হয় তবু এ কথা মনে রাখা চাই যে, সমুদ্র সেঁচে ফেলা সহজ নয়, তার চেয়ে সহজ, খোলের জল সেঁচে ফেলা। এ কথা মনে রাখতে হবে, বাইরের বাধাবিঘ্ন বিরুদ্ধতা চিরদিনই থাকবে, থাকলে ভালো বৈ মন্দ নয়; কিন্তু অন্তরে বাধা থাকলেই বাইরের বাধা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এইজন্যে ভিক্ষার দিকে না তাকিয়ে সাধনার দিকে তাকাতে হবে, তাতে অপমানও যাবে, ফলও পাবে।”

ড.আতিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

আশার কথা বাংলাদেশ ভিক্ষার দিকে না তাকিয়ে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজের মতো করেই স্বউন্নয়নের পথেই হাঁটছে। তা সত্ত্বেও সমাজের অন্দরমহলে অনেক পচা পানি জমে আছে। ধর্ষণ, দুর্নীতিসহ নানা অনাচার ও অসংগতি দেখে তা অনুভব করা যায়। সমাজ ও প্রশাসন-উভয়কেই শক্ত হাতে এই নষ্ট পানি সেঁচে ফেলতে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে নিজেদের মতো করে উন্নয়নের যে কৌশল আমরা গ্রহণ করেছি তাকে আরও পোক্ত ও সক্রিয় করার প্রয়োজন রয়েছে। এই মহামারি আমাদের নতুন করে চলার মতো অনেক পথ নির্দেশ দিয়ে চলেছে। পরিবর্তনের সেই ধারাকে আরও জোরদার করেই আমরা আগামী দিনে আরও ভালো থাকার পথনক্সা তৈরি করতে পারি। সেই পথনক্সার কয়েকটি দিকের কথা উল্লেখ করছি:
  • এক. আমাদের বাঁচার প্রধান অবলম্বন কৃষির দিকে চলমান সমর্থন আরও জোরদার করতে হবে। খাদ্যসহ কৃষির সকল উপখাতে বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
  • দুই. জলবায়ু চ্যালেন্জের শিকার চর, হাওর ও উপকূলের দু:খী মানুষের দিকে সামাজিক সুরক্ষাসহ প্রয়োজনীয় বিশেষ নীতি সমর্থন কাম্য।
  • তিন. সনাতনি জ্বালানি ধীরে ধীরে পরিহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাপক হারে বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
  • চার. নয়া ডিজিটাল জমানায় আইসিটি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে এখাতের রূপান্তর ত্বরান্বিত করতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল স্টার্ট-আপগুলোতে নীতি ও অর্থায়ন সমর্থন ব্যাপক হারে বাড়াতে হবে।
  • পাঁচ. অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে আমাদের অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়াতে হবে। সেজন্যে কর ডিজিটাইজেশন ও অর্থনৈতিক কুটনীতি জোরদার করতে হবে।
  • ছয়. ডিজিটাইজেশন, মানব সম্পদের উন্নয়ন ও সংযোজন এবং উপযুক্ত প্রশাসনিক সংস্কার নিশ্চিত করে আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত দ্রুত বাড়াতে হবে।
  • সাত. অবকাঠামোই পারে প্রবৃদ্ধিকে বেগবান করতে। তাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যে সব মেগা প্রকল্প বেশি বেশি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে সেগুলো আরও দ্রুত বাস্তবয়ন করা যায় কি করে তার কৌশল খঁজে বের করতে হবে।
  • আট. শিক্ষা, দক্ষতাবৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের দিকে বাড়তি নীতি ও বিনিয়োগ সমর্থন দিয়ে মানব সম্পদ উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
  • নয়. ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির চলমান ধারাকে আরও বেগমান করতে হবে।
  • দশ. পুরো সামষ্টিক অর্থনীতিকে সর্বদাই স্থিতিশীল রাখতে হবে। টাকার বিনিময় হার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিরন্তর নজর রাখতে হবে মোট বৈদেশিক দায় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিকে।
  • এগারো. আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টস এবং প্রবাস আয়ের ধারা যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।এ দুটো খাত আমাদের অর্থনীতির ‘লাইফ-লাইন’। তাই এ দুটো খাতের জন্য যে যে নীতি সহায়তা ও কূটনেতিক তৎপরতা দরকার তা যেন সদাই সক্রিয় থাকে।
  • বারো. গত এক দশক ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে বাস্তবমুখী ও উদ্ভাবনীমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করে চলেছে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুবই জরুরি।
চলমান মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সব প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সেগুলো সময় মতো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের ভেতরে ভোগ ও চাহিদা দুইই বাড়বে। আর তাতেই মানুষের আয় রোজগারের সুযোগ বাড়বে। তাই যে কোনো মূল্যে অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে হবে এবং একই সংগে ভাইরাস সংক্রমণের হারকেও বাগে রাখতে হবে। সমাজ, সরকার, ব্যাক্তি খাত মিলে মিশে কাজ করলে নিশ্চয়ই এই সংকটকালেও বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা অক্ষুন্ন থাকবে।

লেখক :

অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।