বিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার যত কারিশমা

:
: ৭ years ago

হেলাল উদ্দিন.

মো: ওয়াহিদুজ্জামান। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও। সহজ ভাষায় প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক প্রধান তিনি। গত বছর অর্থ্যাৎ ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর এই পদে যোগদান করেছিলেন তিনি। সময়ের স্রোতে ইতিমধ্যেই পার করেছেন একটি বছর । গুরুত্বপূর্ন পদে আসীন থাকায় স্বভাবতই প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত এবং নগরবাসীর কাঠগড়ায় আলোচিত হচ্ছে তার এক বছরের আমলনামা। সংশ্লিষ্ট সকলেই হিসাব মিলাচ্ছে চ্যালেঞ্জিং ও ক্ষমতাধর চেয়ারটিতে বসে কোন পাল্লা ভারী করেছেন তিনি। অনুসন্ধান ও তথ্য উপাত্বে উঠে এসেছে তার এক বছরের দায়িত্ব পালনের আদ্যোপান্ত। তবে সব হিসেব নিকাশের আগে একটি তথ্য আগাম জানিয়ে রাখছি, নানা শিরোনামে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবী আদায়ের মুখে আবরুদ্ধ আর রোষানলে পরার ক্ষেত্রে পূর্বের যে কোন প্রধান নির্বাহীর রেকর্ড ভেঙেছেন এই কর্মকর্তা।

এবার ফেরা যাক শুরুর দিকে। উপ-সচিব পদস্থ এই কর্মকর্তা এখানে যোগদানের পূর্বে চাদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। আর চাদপুর গমনের পূর্বে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সবকটি চেয়ারে বসার অভিজ্ঞতা ছিলো দীর্ঘ বছরের। তাই সিটি কর্পোরেশনে পদায়নের খবরে কোন হিসাব না কষে সুপরিচিত বরিশালে গমন আর নতুন কর্মস্থলে যোগদানের দিনক্ষন নির্ধারনেই বেশী ব্যস্ত ছিলেন। তবে তার অজানা ছিলো না নতুন কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন কতটা মসৃণ কিংবা জটিল হবে। তারপরও চ্যালেজ্ঞ গ্রহনে অভ্যস্ত এই কর্মকর্তা যোগদান করলেন যথারীতি হাসি মুখ আর চাঞ্চল্য ভঙ্গিতে। বছরের পর বছর ধরে চলমান উত্তরসূরীদের রেখে যাওয়া চিরন্তন কিছু সংকট নিয়ে শুরু হলো তার নতুন কর্ম যাত্রা। এসব সংকটের মধ্যে প্রধান সংকটটি হলো প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরতদের মাসের পর মাস বেতন-ভাতা বকেয়া থাকা। মূলত পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশনে উত্তীর্ন হবার পর থেকেই শুরু হয় এ সমস্যার। বিগত মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন তার মেয়াদান্তে স্থায়ী কর্মরতদের ৭ এবং অস্থায়ী বা দৈনিক মজুরী ভিত্তিতে কর্মরতদের ৩ মাসের বেতন ভাতা বকেয়া রেখে যান। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত পূর্বের মেয়রের দেখানো পথেই হেটেছেন। পূর্বের ঘরেই আবদ্ধ রেখেছিলেন বকেয়ার পরিমান। প্রধান নির্বাহীর চেয়ারে বকেয়ার এই চিত্রটাই দেখানো হয়েছিলো তাকে। পূর্ব থেকে যারা তাকে কম বেশী চিনতেন জানতেন তারা অন্তত একটি বিষয় ভাল করেই জানতেন দায়িত্ব পালনে কতটা কঠোর তিনি। পরিচিত মহলের মধ্যে আলোচনা ছিলো অনিয়ম আর দূর্নীতিতে পর্যবসিত প্রতিষ্ঠানটিতে কিছু একটা করে দেখাবেন ওয়াহিদুজ্জামান। কয়েকদিনের মাথায়ই স্থানীয় মিডিয়ায় ফাটলেন তিনি। ঘোষনা দিলেন দ্রুত সময়ের মধ্যে বেতন ভাতার বকেয়ার পরিমান কমিয়ে আনার এবং প্রতিষ্ঠানের সকল বিভাগ থেকে অনিয়ম-ঘুষ-দূর্নীতি হ্রাস করে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার। তিনি শ্রেফ জানিয়ে দেন এ দুটিই তার প্রথম কাজ একই সাথে চ্যালেন্স। তার এই ঘোষনা বা বিবৃতি সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ মানুষের কাছে ফাকওয়াজ বুলি রুপেই স্থান পায়। অনেকে আবার এই ঘোষনা কে হাস্যরসের একটি বাক্যেও রুপ দেয়। সমালোচকদের যৌক্তিক বক্তব্য ছিলো যা বিগতরা পারেনি তা আর কারো পক্ষেই করে দেখানো সম্ভব নয়। শুরু হলো প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার চ্যালেন্স বাস্তবায়নের নয়া অধ্যায়।

নতুন এ মিশনে শুরুতেই চমক দেখিয়ে বসলেন তিনি। বিএম কলেজে কয়েক যুগ ধরে বকেয়া থাকা ৮০ লাখ টাকা কর আদায় করলেন তিনি। একটি ভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উভয় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের আন্তরিক মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দেয়া নেয়ার এ পর্ব। বড় অংকের এই অর্থ পেয়ে দিয়ে ফেললেন সকল কর্মরতদের এক মাসের বকেয়া বেতন। এর পর শুরু হয় বকেয়া কর আদায়ের পরবর্তী মিশন। বকেয়া পাওনা আছে এমন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানে পরিশোধের সময় বেধে দিয়ে প্রেরন করা হয় নোটিশ। নোটিশ অমান্যকারীদের সম্পত্তি তথা মালামাল ক্রোকের সর্তকতাও জানিয়ে দেয়া হয় ওই নোটিশে। নগর জুড়ে করা হয় মাইকিং। এছাড়া বকেয়া অর্থ উত্তোলন তথা তাগাদা দেয়ার জন্য করে দেয়া হয় ওয়ার্ড ভিত্তিক কমিটি। অন্যদিকে বিভিন্ন লাইসেন্সের নবায়ন সঠিক সময়ে করার উপরও জোড় দেন তিনি। তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক সাড়া ফেলে। বিগত যে কোন সময়ের চেয়ে আদায় হয় রেকর্ড পরিমান বকেয়া কর। যার প্রমান মিলেছে গত ঈদে। এক সাথে এক মাসের বেতন ও বোনাস দেয়া হয় সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে। যা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসে প্রথম ঘটনার জন্ম দেয়। এর আগে কোন ধর্মীয় উৎসবের আগে হয় শুধু বেতন অথবা শুধু বোনাস দেয়া হত। চ্যালেন্স বাস্তবায়নের মিশনে এক পর্যায়ে অস্থায়ী কর্মরতদের খাতা থেকে বকেয়া শব্দটি সড়িয়ে দিলেন। আর স্থায়ীদের বকেয়া এক মাস কমিয়ে ৬ মাসে নিয়ে আসেন। অগ্রগতির রাস্তা যখন সুগম তখন অপর মিশনটি বাস্তবায়নে নজর দিলেন।

প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ঘুষ দূর্নীতির খাতা বন্ধ করতে প্রথমে মৌখিক ভাবে সবাইকে সর্তক করলেন তিনি। কিন্তু যে পথে হাটতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে ৯০ ভাগেরও বেশী কর্মকর্তা-কর্মচারী,সেই পথ ভুলায় এমন সাধ্য কার। সতর্কতায় কর্নপাত না করে পুরানো চেহারায় চলতে থাকে দাপ্তরিক বিভাগ গুলো। সর্তকতার মেয়াদ যখন শেষ হলো তখনই পরবর্তী ধাপে হাটলেন এই চৌকশ কর্মকর্তা। প্রায় প্রতিদিনই অনিয়ম দূর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৎসনা,শোকজ এমনকি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শুরু করেন মৃদু পানিসমেন্ট ( শাস্তি ) প্রদান । এভাবে চলমান অধ্যায়ে যখন অভ্যন্তরীন পরিবেশ পরিবর্তনের পথে ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শীর্ষ দূর্নীতিবাজ মিলে গঠন করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোধী টিম। এই টিমের মিশন ছিলো কারনে অকারনে ইস্যু তৈরী করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোধী আন্দোলন এবং তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা। মোট কথা তাকে বির্তকিত প্রমানিত করে বদলী বা অপসারন করাটাই ছিলো ওই চক্রের মূল উদ্দেশ্য। কারনটা অতি সহজ সৎ ও দায়িত্বশীল এই প্রধান নির্বাহী কে বিদায় কওে ওদের ঘুষ-দূর্নীীতর খাতা পুনরায় খোলা। যে কারনে সপ্তাহে অন্তত দু’একবার নানা দাবীতে আন্দোলন কর্ম-বিরতির চিত্র দেখা দেয় প্রতিষ্ঠানটিতে। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে যার হাত ধরে পূর্বের বকেয়া বেতন ভাতা পরিশোধ করা হলো তাকেই অবরুদ্ধ করা হয় বকেয়া পরিশোধের দাবিতে। অভিযোগ তোলা হয় বেতন ভাতার টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। যে কারনে বকেয়ার এই চিত্র। আন্দোলনকারীদের নিয়ে বসেন আলোচনায়। তাদের অভিযোগ শুনে ছুড়ে দেন স্বচ্ছতার নতুন এক চ্যালেন্স। এক বাক্যে জানিয়ে দেন নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয়ের সব অর্থ ব্যয় করার কথা বেতন ভাতা পরিশোধে। পূর্বে কি হয়েছে জানি না। এখন থেকে এ নিয়ম শতভাগ কার্যকর হবে। প্রয়োজনে আয় ব্যায়ের হিসাব হিসাব দেয়াপরও ঘোষনা দেন তিনি। এমনকি এই খাতের এক টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা হলে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ারও ঘোষনা দেন তিনি ।

প্রথম মিশনে ব্যর্থ হয়ে চক্রান্তের নয়া মিশনে নামে আবারো ওই চক্রটি। বকেয়া বেতনের পুরানো দাবীর পাশাপাশি অযৌক্তিক খুটিনাটি বিষয় নিয়ে মাঝে মধ্যেই উত্ত্যপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতো তারা। শেষ পর্যন্ত শূন্য হাতে ফিরে নিজ নিজ চেয়ারে অবস্থান নেয় তারা। অন্য দিকে গত মাসে এ বছরের জুন মাসের বেতন ছাড় দিয়ে স্থায়ীদের বকেয়া ৫ মাসে নামিয়ে এনেছেন তিনি। আর যথারীতি বকেয়া শূন্য অস্থায়ীরা। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এই লড়াইয়ের পরও নাগরিক সেবায় একটুও কম যান নি তিনি। দ্রুত নিস্পত্তি করছেন ন্াগরিকদের করা নানা আবেদন। নগরীর যে কোন স্থান থেকে নাগরিক অসুবিদা বা দূর্ভোগের অভিযোগ বা খবর আসলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেন তিনি। আর সরেজমিন পরিদর্শনের সুযোগ পেলে সেটি কোন ভাবেই মিস করেন না তিনি। সকাল থেকে রাত অবদি নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলে তার গাড়ি। আর প্রতিনিয়ত শেষ কর্মী হিসাবে রাত ৮ টা বা তার বেশী সময় পর অফিস ছুটি মেলে তার। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে চমকপ্রদ এই সফলতার নায়ক শুধুই কি প্রধান নির্বাহী। নাকি নেপথ্যের নায়ক সিটি মেয়র আহসান হাবীব কামাল। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সহযোগীতা বা সমর্থন ছাড়া অফিস প্রধানের একক সফলতা অর্জন দুষ্প্রাপ্য নয় কি? সমীকরনটা জটিলতার জালে আবদ্ধ মনে হলেও নিতান্তই সহজ।

সিটি কর্পোরেশন ঘোষনার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩ জন নির্বাচিত মেয়র এবং স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন। তাহলে প্রায় এক যুগ ধরে চলমান বকেয়া বেতন ভাতার পরিমান কেন বর্তমান অবস্থানে আসেনি। কেন সামান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা নিস্পতি পেতে দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হয় না নগরবাসীকে। জবাব যে মেরু থেকেই আসুক কৃতিত্বের পাল্লা কার দিকে ঝুকবে তা সহজেই অনুমেয়। তবে কৃতিত্বের ভাগ অবশ্যই পাবেন মেয়র কামাল। কারন তিনি প্রধান নির্বাহীর উদ্যম আর কর্মস্পৃহার অনুধাবন করে তা বাস্তকে রুপায়িত করার মঞ্চ তৈরী করে দিয়েছেন। গৃহীত পদক্ষেপ তথা উদ্যোগকে দিয়েছেন সমর্থন এবং অন্য দিকে নি:সন্দেহে খোলা রেখেছিলেন সহযোগীতার হাত। এক বছরের নিজ কর্মের মূল্যায়ন জানতে চাইলে এক বাক্যে জানিয়ে দেন এটার অথরীটি নগরবাসী। প্রধান নির্বাহী হিসাবে কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি তার মূল্যায়ন নগরবাসী ও প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরতদের কাছে।