অনলাইন ডেস্ক: বরিশাল সিটি করর্পোরেশনগত ২৩ অক্টোবর বরিশাল সিটি করপোরেশনে (বিসিসি) মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাসের মধ্যেই সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে আর্থিক দুর্নীতি ও অন্যান্য অভিযোগে মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বিকালে করপোরেশনের সাত কর্মকর্তাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়েছে।
ওএসডি করা সাত কর্মকর্তা হলেন– হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মশিউর রহমান, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসমা বেগম রুমি, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মতিউর রহমান, পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা দীপক লাল মৃধা, বাজার সুপারিনটেনডেন্ট নুরুল ইসলাম, পরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেন ও যান্ত্রিক শাখার কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বণিক।
বিসিসির প্রশাসনিক দফতর সূত্র থেকে জানা গেছে, অভিযুক্ত সবার বিরুদ্ধেই রয়েছে পাহাড়সম দুর্নীতির অভিযোগ। তারা সিটি করপোরেশন থেকে দুর্র্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। নগরীতে তাদের রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। যার প্রমাণ পেয়ে তাদের ওএসডি করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে মশিউর রহমান সব আমলেই পার্সেন্টেজ নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ঠিকাদারদের বিল ছাড়াতে মশিউর রহমানকে শতকরা দুই ভাগ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তাকে টাকা না দিয়ে কেউ বিল ছাড়াতে পারেন না। সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের বেতন বকেয়ার পেছনেও বেশি দায়ী ছিলেন মশিউর রহমান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাই তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় বেশি খুশি হয়েছেন কর্মচারীরা।
একাধিক কর্মচারী বলেন, ‘মশিউর রহমান সব আমলে মেয়র ও ঠিকাদারদের খুশি রাখার চেষ্টা করতেন। কর্মচারীদের বেতন আটকে কীভাবে অন্যদের সুবিধা করে দেওয়া যায় সেই হিসাব কষতেন তিনি। বিগত সময়ে যারা মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন তারাও অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন মশিউরের উপর। কারণ মশিউরের কাছেই সব অর্থের হিসাব। মশিউর রহমানের কারণেই আমরা (কর্মচারী) ঠিকমতো বেতন পাইনি।’
মশিউরের পরেই দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসমা বেগম রুমির বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাশাপাশি স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। রুমিকে অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি দিয়েছেন সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল। তার চেয়ে সিনিয়র লোক থাকার পরও তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও তারা কিছু বলতে পারেননি। কারণ কোনও প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে অন্য শাখায় বদলির পাশাপাশি চাকরিচ্যুতির ভয় দেখাতেন আসমা। শুধু তাই নয়, জোর করে ইনস্যুরেন্স করানো হতো কর্মচারীদের। রুমির স্বামী একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ কারণে প্রত্যেক কর্মচারীর ইন্সুরেন্স করা বাধ্যতামূলক ছিল। পুরো সিটি করপোরেশনকে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানি বানিয়েছিলেন আসমা। ২০১৪ সালে বিসিসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল হোসেন অবসরে গেলে আসমাকে ওই পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা দীপক লাল মৃধাকেও দুর্নীতির অভিযোগে ওএসডি করা হয়েছে। দীপক লাল মৃধা বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি পদে আছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওই পদের নাম ভাঙিয়ে তিনি এতদিন যা ইচ্ছে তাই করেছেন। বিগত সময়ে বেতনের জন্য যে আন্দোলন হয়েছে সেখানে দীপকের হাত ছিল। পেছনে থেকে তিনিই কলকাঠি নাড়তেন। গত পাঁচ বছর ৩০ জন কর্মচারীর নামে বেতন উঠিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে দীপকের বিরুদ্ধে। প্রত্যেক কর্মচারীর বেতন সাড়ে ৬ হাজার টাকা। সে হিসাবে (৫ বছরে মেয়র আহসান হাবীব কামাল আমলে)এক কোটি ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন দীপক। প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের আমলেও তিনি এভাবে ভুয়া কর্মচারীদের নামে কোটি টাকা হাতিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হলে হিরণের হাতেপায়ে ধরে সে যাত্রায় বেঁচে যান দীপক।
ওএসডিকৃত কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন হাট-বাজার শাখার সুপারিনটেনডেন্ট নুরুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গত পাঁচ বছরে বাজার শাখা থেকে অনিয়মের মাধ্যমে তিনি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার এ দুর্নীতিতে সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন পরিদর্শক রেজাউল করিম। নুরুল ইসলাম ও রেজাউল মিলেই বাজার শাখাকে দুর্নীতির একটি আখড়া তৈরি করেন। রেজাউলও কয়েক বছরের ব্যবধানে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। রেজাউলকে বাদ দিয়ে কেবল নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় অনেক কর্মচারী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া ওএসডি করা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মতিউর রহমান, পরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেন ও যান্ত্রিক শাখার কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বণিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে আর্থিক দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে বিসিসির নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল হাসান বলেন, হিসাব বিভাগের সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (বাজেট ও অডিট) আক্তারুজ্জামানকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক বিভাগের পরিসংখ্যানবিদ স্বপন কুমার দাসকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে জারিকৃত অফিস আদেশ স্ব স্ব কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, গত ২ ডিসেম্বর বিসিসির চতুর্থ পরিষদের জরুরি সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তা বাস্তবায়ন করা হয়।
উল্লেখ্য, দায়িত্ব গ্রহণকালে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছিলেন তার পরিষদে কোনও দুর্নীতিবাজ থাকতে পারবে না। এমনকি ঠিকাদারি কাজে কোনও পার্সেন্টেজ চলবে না। এ জন্য যা কিছু করা দরকার তিনি করবেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ওই সাত কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হলো।