সাহসী ও প্রতিবাদী এক নারীর নাম মনীষা চক্রবর্ত্তী (২৯)। নারীর প্রতি সহিংসতা, সব ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্য বিলোপের লড়াই করে যাচ্ছেন ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী। শুধু নারীদের অধিকার আদায়ে নয়, তনু হত্যার প্রতিবাদে বরিশালে ছাত্র ধর্মঘটসহ ধারাবাহিক আন্দোলন, সারাদেশে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব-নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন ও শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি সব সময়ই রাজপথে ছিলেন সোচ্চার ও অগ্রণী ভূমিকায়।
মেডিকেলে পড়ালেখা শেষ করে ৩৪তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন পদে নিয়োগ পান মনীষা চক্রবর্ত্তী। যার হাতে ওঠার কথা ছিল স্টেথোস্কোপ-সার্জারির যন্ত্রপাতি, যার থাকার কথা ছিলো হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে রোগী-চিকিৎসা-ওষুধ পথ্যাদি নিয়ে জনগণের সেবায়, সেই মনীষা চক্রবর্তী আজ রাজপথে-রাজনীতির মাঠে। সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে এই চিকিৎসক বিনা পয়সায় গরিব মানুষকে চিকিৎসা দেন, নারী, শিশু ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে থাকেন তিনি। শ্রমিকদের মধ্যে জনপ্রিয় তিনি। শ্রমিক ও বস্তিবাসীর কাছে ‘দিদি’ নামে পরিচিত তিনি। আবার কারো কাছে পরিচিত গরিবের ডাক্তার নামে।
ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তীর জন্ম বরিশাল নগরীর শ্রী নাথ চ্যাটার্জীলেনের পৈত্রিক বাড়িতে। নগরীতেই তার বেড়ে ওঠা। এই চিকিৎসক-রাজনীতিবিদের বাবা আইনজীবী তপন কুমার চক্রবর্ত্তী ছিলেন ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। মা রিনা চক্রবর্ত্তী গৃহিণী। তিন বোনের মধ্যে ডা. মনীষা কনিষ্ঠ।
মনীষা চক্রবর্ত্তীর দাদা বিশিষ্ট আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্ত্তীকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় রাজাকার বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষদের সানিধ্যে বেড়ে ওঠা ডা. মনীষার ছোটবেলা অতিবাহিত হয় ফুপা লেখক ও নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার সংস্পর্শে।
এইচএসসির পর মনীষা ভর্তি হন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় যুক্ত হন বাসদের রাজনীতিতে। তিনি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বরিশালের সদস্য সচিব। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএস পাস করেন। ৩৪তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন পদে নিয়োগ পেলেও সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা, সব ধরনের নিপীড়ন ও বৈষম্য বিলোপ, নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন ও শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি সোচ্চার ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
রাজনীতিতে ৯ বছরের পথচলায় নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে মনীষা চক্রবর্ত্তীকে। বরিশালের রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করা নারী সংখ্যা খুব বেশি নেই। একজন নারী হয়ে রাজপথে আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতালে পিকেটিং অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। প্রথম প্রথম নারী নেতা বলে অনেকেই ব্যঙ্গ করতো। হাসি-তামাশাও করেছে অনেকে। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন মনীষা। কারও সমালোচনাকে পাত্তা দেননি।
প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে হামলা, মামলা ও কারাভোগও করতে হয়েছে ডা. মনীষাকে। ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদের প্রতিবাদে গত বছর ১৯ এপ্রিল শ্রমিকরা বরিশাল শহরে মিছিল বের করেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন মনীষাও। সেদিন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ২৬ এপ্রিল জামিনে কারাগার থেকে ছাড়া পান তিনি। রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে লাঠিপেটা, মারধর, হেনস্তারও শিকার হতে হয়েছে বহুবার। কিন্তু তার অদম্য মনোবল এবং সাহসিকতার কারণে রাজনীতি ছাড়েননি। তিনি পিছপা হননি।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের গত নির্বাচনে প্রথম নারী হিসেবে মেয়র প্রার্থী হন। আর্থিক সঙ্কট তাকে দমাতে পারেনি। ডা. মনীষার নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ হয় জনগণের মাটির ব্যাংকে সঞ্চয় করা টাকা দিয়ে। মেহেনতি মানুষ তাদের মাটির ব্যাংকের সঞ্চয়ী অর্থ তুলে দিয়েছিলেন ডা. মনীষার হাতে। সেটা দিয়েই তিনি লড়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো দলের সঙ্গে।
কথোপকথনে ডা. মনীষার বিভিন্ন গল্প উঠে আসে। তিনি বলেন, প্রাচীনকাল থেকেই সভ্যতা বিকাশে নারীর ভূমিকা অপরিসীম। যুগে যুগে নারীরা সময়ের মাইলফলক হিসেবে অবদান রেখে চলেছেন। সেই নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। নারীর স্বার্থ রক্ষা এবং নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে নারীবান্ধব রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে। শুধু নারীবান্ধব রাষ্ট্রই নয়, নারীবান্ধব সমাজ ও পরিবার গঠন করতে হবে।
মনীষা চক্রবর্ত্তী বলেন, নারীদের বাঁকা চোখে দেখার দিন শেষ। তারা এখন নিজেরা জায়গা করে নিচ্ছেন। নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছেন। নারীরা যথেষ্ট সবল। নারীরা ভাবেন, স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সেটার বাস্তব রূপ দিতে সাহস পান না। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হবে। বাড়াতে হবে মনোবল। লক্ষ্য ছাড়া কোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়।