সেই ২০০৬ সাল। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তানজিল ফেরদাউস। একদিন ক্লাস শেষে বাসায় ফিরছিলেন। তখন চোখ পড়ল স্কুলের মূল ফটকে। দেখেন, ছোট শিশুরা ভেতরে প্রবেশ করছে। ওদের পিঠে ব্যাগ। এরপর প্রায়ই এ দৃশ্য দেখা হয় তার। কৌতূহল বাড়ে তানজিলের। ক্লাস শেষে সবাই বাসায় ফেরে, অথচ শিশুগুলো তখন কেন আসে? জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ঘটাতে এক শিক্ষকের কাছে যান। তিনি জানতে চান, শিশুগুলো অসময়ে কেন আসে। শিক্ষক বলেন, ওরা স্কুলের আয়াদের ছেলেমেয়ে। ক্লাস শেষে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ওদের পড়ায়; যারা স্বেচ্ছায় পড়াতে চায়- শুধু তারাই। নির্ধারিত শিক্ষক নেই। কিছুদিন পর আবার ওই শিক্ষকের কাছে গেলেন তানজিল। এবার জানতে নয়, কিছু জানাতে- ‘আমিও শিশুদের পড়াতে চাই।’
সেই শুরু। স্বেচ্ছায় আলোর পথে যাত্রা। এক হাতে আলো কুড়াতে কুড়াতে, অন্য হাতে আলো ছড়াতে ছড়াতে তানজিলের এগিয়ে চলা। বন্ধুর পথ ধরে আলোর মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ২৪ বছরে তার জন্য সুদূর ওয়াশিংটন থেকে এক খবর এলো।
উদিত সূর্যের মতো উদীয়মান দিনের আলোকবর্তিকা হিসেবে ঘোষিত হয়েছে তার নাম। উদয়ের পথে চট্টগ্রাম থেকে যার অদম্য যাত্রা, সেই পথ গিয়ে মিলেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে। টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘গ্লোবাল এমার্জিং ইয়াং লিডার্স অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে তাকে সম্মানিত করবে।
এবার ১০ জন এ পুরস্কার পাবেন। বাংলাদেশি তানজিল একজন। ৬ এপ্রিল পুরস্কার ঘোষণা হয়। ২ মে ওয়াশিংটন ডিসিতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। সেদিন বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন তানজিল। গর্বে দুলে উঠবে লাল-সবুজের পতাকা, অহঙ্কারে উচ্চারিত হবে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের সাহসী নারীদের অদম্য পথচলার অনুপ্রেরণায় তানজিল ছড়িয়ে যাবেন বিশ্বময়।
চট্টগ্রামের সানশাইন গ্ল্যামার স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ছেন তানজিল। তার এই স্বীকৃতির খবরে বন্ধু-সহপাঠীদের অনেক গর্ব, ‘আমাদের তানজিল যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান তরুণ নেতার পুরস্কার পাচ্ছে!’ এই গর্ব বাংলাদেশেরও, ‘আমাদের মেয়ে এত বড় পুরস্কার পাচ্ছে!’ তানজিলকে অভিনন্দন।
এক যুগের বেশি তিনি কাজ করে যাচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য। নারী অধিকার নিয়েও তিনি সচেষ্ট, সজাগ। যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সংগঠনে। তার এ পথচলায় পরিবারের সমর্থন থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বজন-প্রতিবেশী। কেউ অতি ভালোবেসে মেয়ের ঘরকন্না দেখতে চান। কেউ বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে ছাড়েন না। থামেননি তিনি। কথার কাঁটা বিছানো পথে সচেতনভাবে পা ফেলে এগিয়েছেন। ছুটেছেন স্বপ্নের ডাকে। নারীজনম বলেই ঘরে থাকতে হবে- কখনও মেনে নিতে পারেননি তিনি। এখন সেই স্বজনদের মুখে অহঙ্কারের নাম তানজিল। অবিচল থেকে স্বপ্নজয়ের নাম তানজিল।
দুই বছর ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রোহিঙ্গা শিশুদের জীবনমান উন্নয়নেও কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের একজন অধিকারকর্মী হিসেবে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন।
তানজিলের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘এটা আমার জন্য কত বড় প্রাপ্তি, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে বলতেই হবে, এ অর্জন আমার একার নয়। ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের সব সদস্য এর অংশীদার। সবাই খুবই খুশি, আনন্দিত, উদ্বেলিত।’ ২০১২ সালে ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ৩২ জেলায় সংগঠনটির সদস্য ২৫ হাজারের বেশি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সদস্য দুই সহস্রাধিক।
তানজিলের পথচলায় তার মা ফেরদাউস আরা তাহের সব সময় সাহসী ছায়া দিয়েছেন। ফেরদাউস আরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর। নারী হিসেবে নিজেও দুঃসময় পাড়ি দিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা দিয়েছেন মেয়েকে। তানজিল তার মায়ের মুখে শুনেছেন, ‘যত বাধাই আসুক, নিজের কাজ-স্বপ্নে অটল থাক। কাজ করেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।’ বাবা মো. আবু তাহের এবং বড় দুই ভাইও তাকে উৎসাহ দেন, সাহস জোগান।
তানজিল বলেন, একটি মেয়ে কাজ করছে, এটা কেউই মেনে নিতে চায় না; পারে না। প্রতিবেশী-নিকটাত্মীয়রাই বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পরিবার মেয়েকে সুযোগ দিলেও তারা পরিবারকেও কথা শোনায়। একটু বড় নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথিবীটাকে আপন করে নিয়ে তানজিল দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘পৃথিবীটা সবার। কোনো বাধায় থামিনি, থামব না।’
তানজিল ফেরদাউস এগিয়ে যান আলোর মহাসড়কে। বিশ্বপটে নারীর জয়গানে আপনার নামটি হোক ভাস্বর নক্ষত্র। অন্তহীন ভালোবাসা জানবেন।