বিশ্বকাপের জার্সির যত বিস্ময়কর গল্প

:
: ৬ years ago

হলুদ-নীল দেখলেই বলে দেওয়া যায় এটাই ব্রাজিল আর আকাশি-সাদা দেখলেই আর্জেন্টিনা। তবে এই জার্সির পেছনেও রয়েছে অনেক গল্প, ব্রাজিলের সাদা থেকে হলুদ হবার গল্প, কিংবা মেক্সিকোর দোকান থেকে কিনে আনা জার্সি গায়ে দিয়ে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত গোল দুটি করেছেন ম্যারাডোনা। বিশ্বকাপে দলগুলোর জার্সি নিয়ে এমন আরও চমকপ্রদ গল্প জানাচ্ছেন মৃণাল সাহা


‘ভিভা উরুগুয়ে’

প্রথম বিশ্বকাপের কথা। তখনো দলের পরিচায়ক হিসেবে জার্সি পরেই নামত খেলোয়াড়রা। পেছনে জার্সি নম্বর বা নাম কোনোটাই থাকতো না। সেই বিশ্বকাপে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে বলিভিয়া মাঠে নামার পর দেখা গেল অদ্ভুত এক দৃশ্য। সবার পেছনেই কিছু না কিছু লেখা। বলিভিয়ার খেলোয়াড়দের জার্সিতে একেকটি বর্ণ সেলাই করে বসানো ৷ কারো জার্সিতে লেখা ‘ভি’, কারো জার্সিতে ‘আই’, কারো বা ‘ইউ’। একাদশ একসাথে দাঁড়াতেই সবার কাছে পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা ৷ পুরো বাক্যটা হলো, ‘ভিভা উরুগুয়ে’ বাংলায় ‘উরুগুয়ে চিরজীবী হোক’। মূলত উরুগুয়েতে বসেছে প্রথম বিশ্বকাপ, এ উপলক্ষ্যেই প্রথম ম্যাচে অমন জার্সি পরে নেমেছে বলিভিয়া। পুরো ব্যাপারটা ছিল উরুগুয়েকে বিশ্বকাপের জন্য সম্মান জানানো৷

তাপানুকূল জার্সি
১৯৭০ সালের মেক্সিকোয় বিশ্বকাপ। প্রচণ্ড তাপমাত্রা আর আর্দ্রতার কারণে প্রতিটি দলের খেলাতে ব্যাঘাত ঘটতে শুরু হলো। ইংল্যান্ড অবশ্য তাদের সেই সমস্যার সমাধান নিজেরাই বের করে ফেললো। এমন জার্সি বানিয়ে ফেললো যাতে বাতাস খুব সহজে প্রবেশ করতে পারে। মেক্সিকোর প্রচণ্ড গরম তাপমাত্রায় গাঢ় রঙের চেয়ে হালকা রং বেশি আরামদায়ক, সে হিসেবেই নিজেদের জার্সি নির্বাচন করেছিল ইংলিশরা। আগের বিশ্বকাপ জেতা লাল জার্সি না পরে মেক্সিকোতে তাদের মূল জার্সি হলো সাদা। দ্বিতীয় জার্সি হিসেবে বেছে নিল আকাশি-নীল রঙের, লাল জার্সি হলো তৃতীয় জার্সি। সমস্যাটা হয় চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে। ইংল্যান্ড সে ম্যাচে গায়ে দিল আকাশি-নীল জার্সি, চেকরা সাদা। সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কোচ আলফ রামসে বলেছিলেন, ‘কাছাকাছি রং হওয়ায় ডাগ-আউটে বসে মাঠের রোদের মধ্যে আমি বুঝতে পারছিলাম না কোনটা আমার দলের খেলোয়াড় আর কোনটা প্রতিপক্ষের।’ রামসের চেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছিলেন টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকার আর দর্শকেরা। প্রচন্ড রোদের মাঝে আকাশি-সাদা আর সাদার পার্থক্য করতে পারছিলেন না রঙিন টেলিভিশনের দর্শকেরাই। আর সাদা-কালো টেলিভিশনের দর্শকদের তো বোঝার উপায়ও ছিল না। সেবার একবারই লাল জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিল ইংল্যান্ড। কোয়ার্টার ফাইনালে সেই ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে।

ধার করা জার্সি
১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের কথা। আর্জেন্টিনার মার দেল প্লাতায় ফ্রান্স-হাঙ্গেরি ম্যাচ শুরুর আগে হঠাৎ ফরাসি মিডফিল্ডার অঁরি মিশেলের খেয়াল হলো, হাঙ্গেরির খেলোয়াড়েরা সাদা জার্সি গায়ে ওয়ার্ম-আপ করছে। এই দৃশ্য অধিনায়ককে দেখানোর পরে, অধিনায়ক মারিয়াস ট্রেসর প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকার আন্দ্রাস তোরোসিককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি সাদা পরে খেলবে? সাদা তো আমাদের পরার কথা।’ ‘না, সাদা তো আমাদের পরার কথা’-তোরোসিকের জবাব। দলের তত্ত্বাবধায়ককে ফ্রান্স অধিনায়ক ব্যাপারটা জানালেন। তখনই বের হয়ে এল সত্যটা, ফিফার নির্দেশনায় সেদিন হাঙ্গেরিকেই সাদা পরতে বলা হয়েছে। সে চিঠি ভালোমতো পড়া হয়নি তত্ত্বাবধায়কের। ফ্রান্স আবার আরেক নীল জার্সি রেখে এসেছে মূল ঘাটি বুয়েনস এইরেসে, প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে। ফ্রান্সের কর্মকর্তারা চলে গেলেন স্থানীয় ক্লাব অ্যাটলেটিকো কিম্বারলিতে। তাদের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে এলেন তাদের সবুজ-সাদা জার্সি। তবে সমস্যা রয়েই গেল, মাত্র ১৬টি জার্সি তাদের কাছে রয়েছে, এমনকি সব নম্বরের ধারাবাহিকতাও নেই। সেদিন নিরুপায় হয়ে ফ্রান্স সে জার্সিতেই মাঠে নামল এবং ম্যাচটা জিতল ৩-১ গোলে। মজার ব্যাপার হলো তিন গোলের একটি দিয়েছিলেন ডমিনিক রস্তো, মিডফিল্ডার রস্তোর গায়ের জার্সির নম্বর ছিল ৭, শর্টসের ১৮!

জুভেন্টাসের জন্য
১৯৯০ বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামল কোস্টারিকা, নিজেদের লাল-সাদা জার্সি ছাড়াই। অনেকেই অবাক, এই জার্সিতেই বিশ্বকাপের অভিষেকে জয় পেয়েছে তারা। ‘পয়া’ জার্সি বদলে সাদা-কালোর ডোরাকাটা জার্সি গায়ে দিয়ে মাঠে নামে কোস্টারিকা। কোস্টারিকার সেই দলের সদস্য আলেক্সান্দ্রে গুইমারেজ পরে অবশ্য রহস্যটা ফাঁস করেছেন। ইতালিতে হওয়া সেই বিশ্বকাপে কোস্টারিকার ম্যাচ ছিল তুরিনে। তুরিনের ক্লাব জুভেন্টাসের দর্শকদের সমর্থন পাওয়ার জন্যই কোস্টারিকার খেলোয়াড়দের জুভেন্টাসের জার্সি পরিয়ে মাঠে নামিয়ে দেন কোচ বোরা মিলুটিনোভিচ। আরেকটা উদ্দেশ্যও অবশ্য ছিল, কোস্টারিকার প্রাচীনতম ক্লাব সিএস লা লিবের্তাদোকে শ্রদ্ধা জানানো। হারিয়ে যেতে বসা সেই ক্লাবের জার্সিও ছিল সাদা-কালো।
এত কিছু করেও অবশ্য লাভ হয়নি। সেদিন গ্যালারিতে জয়ের আনন্দ করেছিলেন ব্রাজিল ভক্তরাই, কোস্টারিকা ম্যাচ হেরে যায় ০-১ গোলে। তবে সেবার নকআউট পর্বে পৌছেছিল কোস্টারিকা।