একদিকে সীমাহীন সাগর,অন্যদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট টেংরাগিড়ি। আরেকদিকে ঝাউবনের সবুজ সমীরণ ও তিন নদীর বিশাল জলমোহনা। সাগরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ঝাউগাছগুলো ৩/৪ বছর আগেও। দক্ষিণে অথৈ সাগরের ঢেউ আর ঢেউয়ের সঙ্গে দোল খেতে থাকা মাছ ধরার ট্রলার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
দখিনা হাওয়া পরম আবেশে ঝাউবনকে ছুঁয়ে যেত। খোলা বাতাসের ছোঁয়ায় উড়তে থাকা চুলের মতো দোলতো ঝাউগাছগুলো। জন্ম থেকেই সাগরের হাওয়া গায়ে মেখে বেড়ে ওঠেছিলো এগুলো। সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ ও ঝাউগাছের মাঝখানে শূন্য বালুরাশি। সব মিলিয়ে ছিলো শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত যেন নদ-নদী ও বন-বনানীর অপরূপ সমাহার। এটি মূলত বরগুনার প্রধান তিন নদী পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বরের মোহনায় জেগে ওঠা চর। তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের স্নিগ্ধ বেলাভূমিতে এর অবস্থান।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ জলরাশি শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত। বাতাসের ঝিরিঝিরি শব্দে দোল খায় সবুজ ঝাউবন। বালুময় দীর্ঘ সৈকত আর ঝাউবনের সবুজ সমীকরণের এ দৃশ্যটি যেন প্রাকৃতি প্রেমের একটি উদাহরণ।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা কারণে বিলুপ্তির পথে শুভ সন্ধ্যার সমুদ্র সৈকতের ঝাউবন। ৩/৪ বছর আগেও যেখানে হাজার হাজার ঝাউবন দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে নামে মাত্র কিছু গাছের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যা আছে তাও বিলুপ্তির পথে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে সমুদ্র সৈকতের ১০ হেক্টর ও ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ০৭ হেক্টর জমিতে তারা ঝাউ গাছের চারা রোপন করেছেন। এতে সৈকতে সবুজ বেষ্টনী তৈরী হয়। সবুজের সমারোহে সৈকতে এক মনোরম দৃশ্য ফুটে ওঠে। কিন্তু ২০১৮-২০১৯ সাল থেকে সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটায় শুরু হয় বালুক্ষয়। আর এ অব্যাহত বালুক্ষয়ে ভাঙতে শুরু করে ঝাউবন। এখন মাত্র ৫০ থেকে ৬০ টি ঝাউগাছ আছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগের গাফিলতি, সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির অব্যবস্থাপনা, সৈকত থেকে বিভিন্ন সময়ে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে ঝাউবন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে সৈকতে ঝাউ গাছের অস্তিত্বই থাকবে না।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, যে ঝাউ গাছ গুলোকে কেন্দ্র করে এই সমুদ্র সৈকত গড়ে উঠেছে সেই গাছগুলোই অস্তিত্ব বিলীনের পথে। সমুদ্রের অস্বাভাবিক ঢেউয়ের কারণে অধিকাংশ ঝাউগাছের শিকর থেকে মাটি সরে গিয়ে হেলে পড়ছে। এতে সমুদ্র সৈকতের প্রকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙন ঠেকাতে না পরলে আগামী এক বছরের মধ্যে সমুদ্র সৈকতের পুরো ঝাউবন সমুদ্রে বিলীনের আশঙ্কায় করছেন স্থানীয়রা।
২০১৯ সালে পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছিলো উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ জোছনা উৎসব। ত্রিমোহনার রূপালি জলরাশি ঘেঁষে বিস্তীর্ণ সৈকতে বসে হৈমন্তী পূর্ণিমা উপভোগ করেছেন হাজারও প্রকৃতিপ্রেমী। জোছনাবিলাসীদের জন্য ছিলো গান, কবিতা, পুঁথি, পুতুলনাচ, জাদু প্রদর্শনী, যাত্রাপালা, হয়লা গান, নৃত্য, ফানুস ওড়ানো। জলজোছনায় একাকার হয়েছিলেন সবাই। মুজিববর্ষ উপলক্ষ এর আয়োজন করেছিলো বরগুনা জেলা প্রশাসক। পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় বরগুনার নয়নাভিরাম সৌন্দর্যকে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরাই ছিলো তাদের লক্ষ্য। আর যে ঝাউ গাছ গুলোকে কেন্দ্র করে এই সমুদ্র সৈকত গড়ে উঠেছিলো সেই গাছগুলোই আজ বিলীনের পথে।
এছাড়াও প্রতিদিন শতশত পর্যটক আসতো। এখন আর আসেনা চোঁখে পরার মত পর্যটক সমুদ্রের মূল আকর্ষণ ছিল ঝাউবন। বিভিন্ন দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস ও অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে এখন বিলুপ্তির পথে ঝাউবন।
তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন মো. বাচ্ছু হাওলাদার আমার সংবাদকে বলেন, বন বিভাগের গাফিলতি, সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির অব্যবস্থাপনা, সৈকত থেকে বিভিন্ন সময়ে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে ঝাউবন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে সৈকতে ঝাউ গাছের অস্তিত্বই থাকবে না।
স্থানীয়রা জানান, পর্যটকদের অবহেলা ও সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাগর পাড়ের উদ্ভিদ ও সাগরের জীব বৈচিত্র্য। সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনকারী ঝাউবন সংরক্ষণের দায়িত্ব না নিলে উপকূলীয় এলাকা ও সৈকত বিপন্ন হতে পারে।
ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলা থেকে আসা পর্যটক মো. আরাপ হোসেন টোটন বলেন, সৈকতটি দেখতে খুবই মনমুগ্ধ এখানে এসে আমার খুবই ভালো লেগেছিল। তবে সমুদ্র সৈকতে সারি সারি মরা ঝাউগাছ পড়ে আছে। যেটা দেখতে মোটেও ভালো লাগেনি। দেখে মনে হয়েছে এটি একটি ধ্বংসস্তূপ। এগাছগুলো জীবিত দাড়িয়ে থাকলে আরো ভালো লাগতো।
ঝাউবন ও সৈকত এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ৩/৪ বছর আগেও এখান থেকে আরো এক কিলোমিটার জায়গাঝুড়ে ঝাউবন ছিল পর্যটকরা হেঁটে সৈকতের ঢেউ উপভোগ করতে যেত। কিন্তু এখন ভাঙতে ভাঙতে সমুদ্র বলতে গেলে একেবারে বেড়িবাঁধের কাছে চলে এসেছে।
বরগুনা জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি সোহেল হাফিজ বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা পর্যটন এলাকাগুলো আমাদের সম্পদ। এর ব্যবহারে আমাদের সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে। কোনোভাবে যাতে পরিবেশ দূষণ না হয় সে ব্যাপারে পর্যটকদের সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় পরিবেশ দূষণের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে। ফলে উপকূলীয় এলাকার আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা উপকূলীয় বন বিভাগ পটুয়াখালী মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ঝাউগাছ খুব সল্প গভীরের গাছ তাই সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে ও ঝাউগাছ গুলো বিলীন হচ্ছে।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com