‘ইস, কত দিন পর দেখা’—বলেই চিৎকার করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলেন। যাঁরা চিৎকার করে বলছিলেন ‘কত দিন পর দেখা’, তাঁরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। চোখে না দেখলেও মনের চোখ দিয়ে ঠিকই অন্যজনকে উপলব্ধি করেন তাঁরা। তাঁদের একজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তাসলিমা সুলতানা। আরেকজন হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ঝর্ণা আক্তার।
তাসলিমা ও ঝর্ণা দুই বন্ধু। রাজধানীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। একসময় দুজন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। ব্যস্ততার জন্য অনেক দিন একসঙ্গে হওয়া হয় না। এই দুজনসহ প্রায় ৫০ জন দৃষ্টি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে ইফতারে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ফিজিক্যালি-চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ)। এতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। পিডিএফের স্বেচ্ছাসেবকেরা সারাক্ষণই ব্যস্ত ছিলেন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এবং অন্য অতিথিদের নিয়ে।
বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (ডিইউএএ) ফ্লোরে পিডিএফ এই অন্যরকম ইফতারের আয়োজন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাকিলা আক্তার কথা বলছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আসিফ আলীর সঙ্গে। আসিফ জানালেন, শাকিলার সঙ্গে রাজশাহীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়েছেন তিনি। সেই বন্ধুত্ব এখনো আছে। পিডিএফের আয়োজনে আবার বন্ধুকে কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। ইফতারে অংশ নেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শাহাদাত হোসেনসহ অন্যরা।
পিডিএফের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট মিজানুর রহমান জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী এবং অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলার কাজটি করছে পিডিএফ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ভর্তি হলে তাদের পড়া রেকর্ড করে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলে যাতায়াতে সহায়তা করেন। অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন এবং সেই অনুযায়ী সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেন। পিডিএফের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে চাকরির বাজারের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রস্তুত করা হয়। প্রশিক্ষিত এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চাকরি দিয়ে সহায়তা করে। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বৃত্তিও দেওয়া হয়।
মিজানুর রহমানের স্ত্রী সুরাইয়া আখতার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। পিডিএফের সূত্রেই দৃষ্টিসম্পন্ন মিজানুর রহমানের সঙ্গে সুরাইয়ার পরিচয়। এই দম্পতির বর্তমানে চার বছর বয়সী এক ছেলে আছে। ইফতারে সুরাইয়া তাঁর ছেলে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। মিজানুর রহমান বলেন, এই ইফতারের মূল উদ্দেশ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং সমাজের অন্য শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের মধ্যে মিলন ঘটানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিডিএফের প্রেসিডেন্ট দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাজমুস সাকিব প্রত্যেক টেবিলে গিয়ে অতিথিদের খোঁজ নিচ্ছিলেন। ইফতার অনুষ্ঠানে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল রঞ্জন কর্মকার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেওয়া হচ্ছে।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী দেশে প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিতার্কিকদের নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। তাঁর মতে, বিতর্কে দৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই।