সৌদি আরবের বাণিজ্য ও বিনিয়োগমন্ত্রীর নেতৃত্বে আগামী মাসেই একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসছে। প্রতিনিধিদল একগুচ্ছ বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি নিয়েই আসছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সৌদি বিনিয়োগকারীরা সার, সিমেন্ট, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি এ সফরেই তারা বাংলাদেশের জন্য সৌদি আরবে একটি সার কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দিতে পারেন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিচালক মো. আরিফুল হক স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে সব মন্ত্রণালয়ের অধীন বিনিয়োগসম্ভাব্য প্রকল্পসমূহের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ১৭-১৮ অক্টোবর সৌদি আরব সফরকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের বিষয়ে সৌদি সরকারের সঙ্গে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। এর ধারবাহিকতায় আগামী ১০-১১ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের বাণিজ্য ও বিনিয়োগমন্ত্রী, অর্থনীতি ও উন্নয়নমন্ত্রী, সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) এবং সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের (এসডিএফ) প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশ সফর করবেন।’
‘তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হবে। সৌদি বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয়াবলী বিডা কর্তৃক মনিটরিং করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা রয়েছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘গত ৯ জানুয়ারি একটি প্রস্তুতিমূলক সভা হয়েছে। ওই সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের করণীয় বিষয়াবলী সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করা হয়েছে।’
এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার দুপুর ১২টায় বিডা’র নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিনিয়োগসম্ভাব্য প্রকল্পসমূহের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও বিস্তারিত তথ্যসহ প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সৌদি আরবের বিনিয়োগের বিষয়টি বিডা থেকে কো-অরডিনেট করা হচ্ছে। আমরা তো সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিকমিউনিকেশন এবং তথ্যপ্রযুক্তি, পেট্রোকেমিক্যাল, ওষুধ শিল্পসহ অনেক কিছুতেই গুরুত্ব দিচ্ছি। তাবে তারা কোন সেক্টরে গুরুত্ব দিচ্ছেন সেটাও ভালো করে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। তারা সার কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছে। সেটা বাংলাদেশেও হতে পারে আবার সৌদি আরবেও হতে পারে। এছাড়া তৃতীয় কোনো দেশেও হতে পারে।’
দেশের বাইরে বাংলাদেশের সার কারখানা কীভাবে হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সিম্পল ব্যাপার। সৌদি গ্যাস দিয়ে সৌদি আরবেই যদি ওরা আমাদের জন্য একটি সার কারখানা করে তাহলে আমরা ওখানে সার উৎপাদন করে বাংলাদেশে নিয়ে আসব। তাদের গ্যাস ও অর্থে সৌদি আরবে আমাদের জন্য একটি কারখানা স্থাপন হবে। পরবর্তীতে আমরা অর্থ পরিশোধ করে দিলাম, এভাবেই হবে। এক্ষেত্রে উপকার হবে যে, কারখানায় ব্যবহারের জন্য আমরা ওই দেশের রেটে (মূল্যে) গ্যাস পাব।’
আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা এখন গ্যাস আমদানি করছি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গ্যাসের প্রয়োজন আছে। আমদানি করা গ্যাস দিয়ে দেশের অর্থনীতির পুরোটা মেটানো কঠিন। কাজেই দেশের বাইরে এক বা একাধিক সারের কারখানা হলে আমাদের দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য খুবই সুখকর হবে। বর্তমানে আমরা ২৪ লাখ টনের চেয়েও বেশি সার বিদেশ থেকে আমদানি করি। তাই এ ধরনের ফ্যাসিলিটি এখন আমাদের খুবই দরকার।’
তিনি বলেন, ‘সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে তারা বেশ আগ্রহী। ইতিমধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) স্বাক্ষর হয়েছে। এর আওতায় তারা শাহ সিমেন্টে একটা নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন করবে। আর ছাতক সিমেন্ট যেটা আছে সেটাকে সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করবে। বাংলাদেশে আলফা নার্গ নামের একটি কোম্পানি আছে, ওই কোম্পানি ফেনীতে একটি বড় আকারে সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। তারা রিফাইনারিতে বিনিয়োগ করতে চায়। তাদের একটি কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে রিফাইনারি ডেভেলপমেন্টের ব্যাপার আগ্রহ দেখিয়েছে।’
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশের অবকাঠামোগত বিভিন্ন প্রকল্প আছে, সেগুলোর বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছে। আমরা এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে বড় বড় যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলোর তথ্য চেয়েছি। এসব তথ্য আমরা তাদের নিকট পাঠাব। আশা করছি এবার খুব ভালো একটা আলোচনা হবে। কারণ খুবই উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল আসছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সৌদি উদ্যোক্তাদের জন্য দেশের বিভিন্ন উদীয়মান খাত যেমন- পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিকমিউনিকেশন, তথ্যপ্রযুক্তি, পেট্রোকেমিক্যাল, ওষুধ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত, হালকা প্রকৌশল শিল্প, ব্লু ইকোনমি, গবেষণা, উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, পানি ও সমুদ্র সম্পদসহ অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোগত প্রকল্প; সেবামূলক খাত যেমন- ব্যাংক, অর্থনীতি ও লজিস্টিকস এবং মানবসম্পদ খাতেও বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকা এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রণোদনার সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে অধিক হারে মুনাফা নিয়ে দেশে ফেরার বিষয়টিও উল্লেখ করা হবে। এর মধ্যে থাকছে আইন দ্বারা সুরক্ষিত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), ট্যাক্স হলিডে, যন্ত্রাংশ আমদানিতে স্বল্প শুল্ক প্রদান, বিনা শুল্কে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সুযোগ, রেমিট্যান্স অন রয়্যালটি, শতভাগ ফরেন ইক্যুয়িটির নিশ্চয়তা এবং লাভ ও পুঁজিসহ বিনা বাধায় চলে যাওয়ার সুবিধা।
অন্যান্য সুবিধার মধ্যে উল্লেখ করা হবে- বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক বেতন-ভাতায় সহজে প্রশিক্ষণযোগ্য নিবেদিত প্রাণ জনশক্তি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে স্বল্প ব্যয় এবং আমাদের শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশ সুবিধা। যার মধ্যে রয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ), অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, জাপান ও নিউজিল্যান্ডের বাজারে প্রবেশ সুবিধা।
দেশে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলো (ইপিজেড) শতভাগ রফতানিনির্ভর। সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ টেকসই করার জন্য সরকার এই শিল্পাঞ্চলগুলো গড়ে তুলেছে। এগুলো আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য দেশে দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার কথাও উপস্থাপন করা হবে প্রতিনিধিদলের কাছে।