কিছু মানুষের জন্মই হয় মানুষের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার জন্য। কেউ রণাঙ্গনে, কেউ রাজনীতিতে, কেউ অর্থনীতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান কিংবা সমাজ সেবায়। আবার কেউ নিজেকে বিলিয়ে দেন খেলার ময়দানে। শেষের ক্যাটাগরি হিসেব করলে (শুধুমাত্র ক্রিকেটে) এই জায়গায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়াদের মধ্যে বিরল কৃতিত্বের অধিকারী নিশ্চিত অর্থেই ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক একজন।
খেলার ময়দানে যারা থাকেন, তারা দুটি বিষয়ের সঙ্গে সব সময়ই কম-বেশি পরিচিত। ইন-ফর্ম আর অফ-ফর্ম। ক্যারিয়ারে অফ ফর্ম আসবেই। এটাই নিয়তি। ক্যারিয়ারে অফ ফর্মের দেখা পেয়েছে ডন ব্র্যাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার থেকে শুরু করে সব রথি-মহারথিই। ৩৩ বছর বয়সে অ্যালিস্টার কুকের বিদায় বেলাটা যেভাবে রঙ্গিন হলো সেটা কোনোভাবেই তার ঠিক আগের অবস্থাকে ফোকাস করে না।
আপনি যত বড় ক্রীড়াবীদই হোন না কেন, ক্যারিয়ারে যখন বাজে সময় উপস্থিত হবে, তখন চারদিক থেকেই আক্রান্ত হতে থাকবেন। একজন ক্রীড়াবীদই বুঝতে পারে, তখন তিনি কী সময়টা পার করেন। চারদিক থেকে যখন একের পর এক সামলোচনার তীক্ষ্ণ তীর ছুটে আসবে আপনার দিকে, তখন নিজেকে পৃথিবীতে একেবারে নিঃসঙ্গছাড়া কিছুই মনে হবে না। আপনজনরা পর্যন্ত টিকা-টিপ্পনি কাটতে থাকেন ওই সময়টায়।
অ্যালিস্টার কুক এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পার করেছেন গত কয়েকটি বছর। কেনিংটন ওভালে সেঞ্চুরি দিয়ে হয়তো জীবনের শেষ ইনিংসটাকে সাজিয়েছেন। কিন্তু তার আগে তিন অংকের ঘরে পৌঁছাতে ১৭টি ইনিংস অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। সময়টা হিসেব করলে প্রায় ১০ মাস। গত বছর ডিসেম্বরে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
তার আগেও ১০ ইনিংসে পুরোপুরি ব্যর্থ ছিলেন কুক। অ্যাশেজ সিরিজে একের পর এক তার ব্যর্থতা দলের ওপরও বেশ প্রভাব ফেলছিল। হারছিল একের পর এক। ইংল্যান্ডের সাবেক থেকে বর্তমান- কেউ বাদ যায়নি কুকের সমালোচনায় মেতে ওঠা থেকে। মাইকেল ভন থেকে নাসের হুসেইন- সবাই বলছিল কুককে এবার ছেঁটে ফেলার সময় হয়েছে।
চারদিক থেকে যখন সমালোচনায় বিধ্বস্ত হচ্ছিলেন- তখনই কুক খেলে বসলেন অপরাজিত ২৪৪ রানের এক অতি মানবীয় ইনিংস। সঙ্গে সঙ্গে সমালোচকদের মুখ বন্ধ। অ্যাশেজ সিরিজে ওই একটি ম্যাচই ড্র করতে পেরেছিল ইংল্যান্ড। সেই ২৪৪ রানের পর আবারও কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ওপেনার। এরপর ১৭ ইনিংসে কোনো বড় স্কোর নেই তার ব্যাটে।
সর্বোচ্চ ৭০ রান করেছিলেন একবার লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে। লিডসে একটি ছিল ৪৬ রানের ইনিংস। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে চলতি সিরিজে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন তিনি। প্রথম টেস্টে ১৩ এবং ০ রান। দ্বিতীয় টেস্টের ১ ইনিংসে ব্যাট করেন ২১ রান। তৃতীয় টেস্টে ২৯ ও ১৭ এবং চতুর্থ টেস্টে করলেন ১৭ ও ১২ রান।
এবার যদিও ইংল্যান্ড দল সাফল্য পাচ্ছিল। জিতে চলছিল একের পর এক। যে কারণে অ্যাশেজের চেয়ে সমালোচনার তীরটা একটু কমই এসেছিল কুকের দিকে। তবুও, চতুর্থ টেস্টে ব্যর্থতার পর অ্যালিস্টার কুক ক্রিকেটকে বিদায়ই বলে দিলেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে। জানিয়ে দিলেন কেনিংটন ওভালের পর আর তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই খেলবেন না। অথচ, সমালোচনাটা যদি সেভাবে না হতো, তাহলে আরও অন্তত দুই-তিন বছর দিব্যি খেলে যেতে পারতেন তিনি।
সবার দৃষ্টি ছিল ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টটাকে কীভাবে রাঙিয়ে যান কুক। প্রথম টেস্টে যিনি সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু করেছিলেন, বিদায়ী টেস্টে তিনি কি করেন সেটা দেখার অপেক্ষায় ছিল ওভালে প্রতিপক্ষ ভারতও। ২০০৬ সালে নাগপুরে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬০ রান করেছিলেন কুক। দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন অপরাজিত ১০৪ রান। টেস্ট হয়েছিল ড্র।
ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টেও প্রতিপক্ষ ভারত। প্রথম ইনিংসে করলেন ৭১ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত থাকতে পারলেন না। আউট হয়ে গেলেন। করলেন ১৪৭ রান। ঘটনা প্রায় এক। দুই ইনিংসে একটি হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে একটি করে সেঞ্চুরি। অ্যালিস্টার কুক নিজের ইতিহাসের পাতা যেভাবে খুলেছিলেন সেভাবেই বন্ধ করে গেলেন।
এরই মধ্যে লিখেছেন অনেক হাসি-কান্নার ইতিহাস। মোট এক যুগের ক্যারিয়ার। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮। খেলেছেন ১৬১টি টেস্ট। ইনিংস খেলেছেন ২৯১টি। মোট রান ১২ হাজার ৪৭২। গড় ৪৫.৩৫। সর্বোচ্চ রান ২৯৪। আক্ষেপ, ট্রিপল সেঞ্চুরির কাছে গিয়েও হলো না। সেঞ্চুরি করলেন ৩৩টি আর হাফ সেঞ্চুরি করলেন ৫৭টি। এর মধ্যে ৫টি ডাবল সেঞ্চুরি। ওয়ানডে খেলেছেন ৯২টি। রান করেছেন ৩৬.৪০ গড়ে ৩২০৪। সর্বোচ্চ ইনিংস ১৩৭। ৫টি সেঞ্চুরির সঙ্গে হাফ সেঞ্চুরি ১৯টি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেন কুক। তার দুর্ভাগ্য, একটি বিশ্বকাপও খেলতে পারেননি। টি-টোয়েন্টি খেলেছেন মাত্র ৪টি।
পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, অ্যালিস্টার কুক ছিলেন টেস্ট স্পেশালিস্ট। ওয়ানডে ছাড়ার ৪ বছর পর পর্যন্ত চালিয়ে গেলেন টেস্ট ক্রিকেট। নিজের যা অর্জন, তার সবই ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে। এরই মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক। ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ৫৯ টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেন তিনি। যার মধ্যে জিতেছেন ২৪টি। হেরেছেন ২২টি। ড্র হয়েছে ১৩টি ম্যাচ। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ নেতৃত্ব দেয়ার দিক থেকে কুকের পেছনে রয়েছেন মাইক আথারটন (৫৪ টেস্ট)।
ইংল্যান্ডের ওয়ানডে দলেরও অধিনায়ক ছিলেন অ্যালিস্টার কুক। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৬৯ ম্যাচে। যার মধ্যে জিতেছেন ৩৬টিতে। হেরেছেন ৩০টি এবং টাই করেছেন ১টি ম্যাচ। ফল হয়নি ২ ম্যাচে। ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে ম্যাচে নেতৃত্ব দেয়ার তালিকায় কুক রয়েছেন ২ নম্বরে। এক নম্বরে ইয়ন মরগ্যান।
শুধু নেতৃত্ব দেয়ার দিক থেকেই নয়, অ্যালিস্টার কুক যে ইতিহাস রচনা করে গেছেন সেখানে আদৌ কোনো ইংলিশ ক্রিকেটার পৌঁছাতে পারবে কি না, সন্দেহ। তিনিই কোনো ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম ১৫০-এর বেশি টেস্ট খেলেছেন। বিদায় নিয়েছে সর্বাধিক ১৬১টি টেস্ট খেলে। তার পেছনে ১৪৩ টেস্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন জেমস অ্যান্ডারসন। তিনিও আর কতদিন খেলে যেতে পারেন, যথেষ্ট সন্দেহের বিষয়। হয়তোবা কুকের সর্বোচ্চ টেস্ট খেলার রেকর্ড অক্ষুণ্নই থেকে যাবে। ওয়ানডে খেলার হিসেবে অনেক অনেক পেছনে রয়েছেন কুক।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে অ্যালিস্টার কুক ইংলিশ ক্রিকেটে নিজেকে এমন এক জায়গায় উন্নীত করে রেখেছেন, যেটাকে ছোঁয়া সত্যি সত্যি অন্য কোনো ইংলিশ ক্রিকেটারের পক্ষে আপাতত সম্ভব নয়। কারণ, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ইংল্যান্ড সবচেয়ে পুরনো দল হলেও ১০ হাজার রানের মাইলফলক পার করতে পেরেছেন কেবলমাত্র একজন ইংলিশ ব্যাটসম্যান। তিনি অ্যালিস্টার কুক।
কুকের আগে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের হয়ে সর্বাধিক রান ছিল গ্রাহাম গুচের, ৮ হাজার ৯০০। কুকই সর্বপ্রথম ইংলিশদের হয়ে ১০ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন। বিদায় বেলায় তিনি পার করেছেন ১২ হাজার রানের গণ্ডিও। তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১২ হাজার ৪৭২ রান। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় তিনি রয়েছেন ৫ নম্বরে।
ভারতের বিপক্ষে ওভাল টেস্টেই কুমার সাঙ্গাকারাকে পেছনে ফেলে ৫ম স্থানে উঠে আসেন কুক। সাঙ্গাকারার রান ১২ হাজার ৪০০। ১৪৭ রানের ইনিংস খেলে আরও ৭২ রান বেশি করেছেন এই ইংলিশ ব্যাটসম্যান। একই সঙ্গে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৩টি সেঞ্চুরিরও মালিক কুক। তার পেছনে ২৩ সেঞ্চুরি নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন কেভিন পিটারসেন। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করার দিক থেকে কুকের অবস্থান ১১ নম্বরে।
এমন একজন ব্যাটসম্যান দলে থাকাটাও যেন একটি দলের জন্য বিশাল এক নির্ভরতার বিষয়। মাথার ওপর যেন বড় একটি ছাতা। অ্যালিস্টার কুকের বিদায়ে নিশ্চিত, ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের মাথার ওপর থেকে সেই ছাতাটা সরে যাবে।
১২ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি যা অর্জন করেছেন, তাতে অন্তত ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে তাকে একজন জাতীয় বীর হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। সেই ক্ষণজন্মা ক্রিকেটার অ্যালিস্টার কুক শেষ শটটি খেলে ফেললেন আজ (সোমবার)। ভারতের অভিষিক্ত অফব্রেক বোলার হনুমা বিহারির বলে রিশাভ পান্ত ক্যাচ ধরে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিলেন কুকের পথচলা। বিহারির দিকে তাকিয়ে মাঠ ছাড়তে ছাড়তে কুক হয়তো বলতে পারেন, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা…।’