বিচারক হিসেবে নিজেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেননি শামীমা আফরোজ

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

শামীমা আফরোজ পেশায় জেলা জজ। বাবা মরহুম আব্দুল খালেক, মা মনসুরা বেগম। ১৯৭২ সালের ২৫ মে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার কর্মসূত্রে ৪ বছর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকার সুবাদে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কেটেছে মস্কো এম্বাসি স্কুলে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে এসে কুর্মিটোলার শাহীন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৮৭ সালে এসএসসি পাস করেন। শাহীন কলেজ, ঢাকা থেকে ১৯৮৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৯৪ সালে এলএলবি (সম্মান) এবং ১৯৯৫ সালে এলএলএম পাস করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের রিসার্চ অফিসার হিসেবে কাজ করেন ব্যারিস্টার এম আমীরুল ইসলামের সাথে। সেখানে কাজ করার সময় ১৮তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৮ সালের ২৪ জুন যোগদান করেন। চাকরি জীবনে তিনি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় কাজ করেছেন। বর্তমানে মৌলভীবাজারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারক (জেলা জজ) হিসেবে কর্মরত আছেন। শামীমা আফরোজ জানালেন তার জীবনের গল্প।

ছোটবেলাটা কেটেছে স্বপ্নের মতো। সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার আগে বাবার চাকরিসূত্রে যে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম, সেখানে নিয়মিত ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো। চমৎকার একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে কেটেছে ছোটবেলা। মস্কোয় যাওয়ার পর বিদেশের উন্নত পরিবেশ এবং ডিপ্লোম্যাটিক এরিয়ায় বসবাস করার কারণে বিভিন্ন দেশের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছিল। বিকেলে সবার সাথে খেলাধুলা এবং মাঝে মাঝে ছোটদের সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। তাছাড়া তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল পৃথিবীর শান্তিপূর্ণ দেশের একটি। মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সেখানকার নিরাপদ পরিবেশ আমার খুব মনে পড়ে।

বাবার ছিল চার মেয়ে। ফলে পরিবারের ভেতরে বৈষম্যের কোনো সুযোগই ছিল না। তাছাড়া বাবা ছিলেন সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে। প্রতি রাতে ভাত খাওয়া শেষে দীর্ঘক্ষণ পারিবারিক আড্ডা ছিল আমাদের বড় আকর্ষণ। পারিবারিক আড্ডায়ই সংসারের অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। বাবার মেয়েদের ছিল তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ। ক্যান্টনমেন্টের যে এলাকায় বেড়ে উঠেছি, সেটা ছিল ভীষণ সৌহার্দপূর্ণ। বিকেল বেলা মাঠের কোণায় এলাকার মেয়েদের আড্ডা অথবা ব্যাডমিন্টন খেলা ছিল আমাদের অন্যতম আকর্ষণ।

যখন বাবার বন্ধুরা তাদের মেয়েদের ইন্টারমিডিয়েটের পর বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করতেন; তখন বাবা তার প্রত্যেক মেয়েকে অনার্স, মাস্টার্স পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। তারা সবাই স্বামী-সন্তানসহ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তবে মাঝে মাঝে ছাত্রাবস্থায় আমাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য আত্মীয়দের যে চাপ থাকতো না, তা বলা যাবে না। তবে বাবা-মা সে চাপ দক্ষতার সাথে সামলেছেন।

১৯৮৬ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বাংলা একাডেমির বইমেলায় এসেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যদিয়ে যাওয়ার সময় এর পরিবেশ, ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাধীনতা, আনন্দ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালত্ব আমাকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল। সব সময় মনে হতো, উচ্চশিক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে হবে।

মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। বাবার ক্রমাগত উৎসাহ একটি বড় কারণ।

ক্যারিয়ারে ভালো লাগার মতো অনেক ঘটনা আছে। তবে যে দুটি ঘটনা আমি মনে করতে চাই—তা হলো ২০১৩ সালে দিল্লিতে এবং ২০১৪ সালে নেদারল্যান্ডসের হেগে ইন্টারন্যাশনাল ওমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘গ্লোবাল লিডারশিপ অব ওমেন প্রোগ্রামে’ দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা। দিল্লি কনফারেন্সে প্রতিনিধি দলের পক্ষ হয়ে ‘কিনোট পেপার প্রেজেন্টেশন’র সুযোগ হয়েছিল। আর কাজের চ্যালেঞ্জগুলো আসলে একজন বিচারক হিসেবে আমার যে দায়িত্ব রয়েছে, তার পাশাপাশি একই রকম দায়িত্ব আছে স্ত্রী এবং মা হিসেবে। পরিবার এবং সন্তানদের প্রয়োজনে অনেক সময় কাছে থাকতে পারি না। তাছাড়া হঠাৎ করে দূরের কর্মস্থলে বদলি নারীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মাঝে মাঝে কর্মপরিবেশটাও। ঠিক অনুকূল হয় না। সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয়।

১৯৯৮ সালে আমি যখন বিচার বিভাগে যোগদান করি; তখন নারী বিচারকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০-৬০ জন। সে জায়গায় এখন নারী বিচারকের সংখ্যা প্রায় ৫শ’র মতো। আমাদের সময় নারী বিচারকদের সঙ্গত কারণেই একটু আলাদাভাবে দেখা হতো। কিন্তু বর্তমানে ব্যাপক সংখ্যক নারী বিচারক থাকায় এবং তাদের পারফরমেন্স পুরুষ বিচারকের তুলনায় কোনো অংশে কম না হওয়ায় আলাদাভাবে মূল্যায়নের সুযোগ নেই। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে নারী বিচারকদের কাজকে আলাদাভাবে দেখি না। তবে এটি ঠিক, একজন নারী বিচারককে পুরুষ বিচারকের সমান কাজ করতে হলে তাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। কারণ সংসার সামলানোর দায়িত্বও সে নেয়।

বিচার বিভাগের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে—সহকারী জজ থেকে জেলা জজ পর্যন্ত প্রত্যেকেরই পৃথক কোর্ট, পৃথক চেম্বার, পৃথক এজলাস রয়েছে। নারী বিচারক হিসেবে অফিসে কখনো নিজেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করিনি। তবে কোনো কোনো সময় কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। আমার জানামতে, যথাসম্ভব সেই বিষয়গুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সব সময় যে প্রতিকার পেয়েছি, তা নয়।

যারা বিচারক হতে চান, তাদের মাথায় রাখতে হবে—এটি অন্য কোনো পেশার সাথে তুলনীয় নয়। এটিকে বলা যেতে পারে একটি মিশন অথবা সেবা। ফলে কাজটি করতে হবে খুব ভালোবেসে এবং আন্তরিকতা দিয়ে। যারা এ পরিশ্রমের কাজটিকে ভালোবেসে আসতে পারবেন, তাদেরই এ পেশায় আসা উচিত।

আসলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে—আমি কাজটিকে আরও ভালোবেসে, আরও পরিশ্রম করে করতে চাই। আমার কাছে যারা আস্থা নিয়ে বিচারপ্রার্থী হয়ে আসেন; তাদের কষ্টগুলো যেন আমি ঘোচাতে পারি। দিন শেষে আমাকে যেন কোনো গ্লানি নিয়ে ঘুমাতে না হয়।

দেশ নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। প্রিয় বাংলাদেশ নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ আবাস ভূমি হবে, বাংলাদেশকে নিয়ে এই স্বপ্ন আমি খুব দেখি। তাই মনে হয়, আমাদের দেশে যদি সব কিছু আইন মেনে চলতো! একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ যদি পেতাম! এছাড়া যদি সুযোগ থাকতো—তাহলে একটি বিষয় পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সেটা হচ্ছে—মানুষের মধ্যে ভয়ানক রকমের ইনটলারেন্স বাড়ার কারণে যে অশান্তি চলছে সারা পৃথিবীজুড়ে, সেটি পাল্টে দিতে খুব ইচ্ছে হয়।