বাবা জীবিত নাকি মৃত জানে না আরওয়া

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

সাজেদুল ইসলাম সুমন যখন নিখোঁজ হন তখন মেয়ে আরওয়ার বয়স মাত্র দুই বছর। বর্তমানে আরওয়ার বয়স ৮। ছয় বছরেও বাবার দেখা পায়নি। গুমের সময় মনে দাগ না কাটলেও এখন প্রতিনিয়ত বাবাকেই খুঁজে ফেরে মেয়ে।

২০১৩ সালে ঢাকার নাখালপাড়া থেকে নিখোঁজ হন সুমন। তার বৃদ্ধা মায়ের অপেক্ষা যেন ফুরাই না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মা এখন শয্যাশায়ী। শুধু সুমনের পরিবার নয় আরও অসংখ্য পরিবারের আর্তনাদ, আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিলনায়তন।

গত ৬ বছরে গুম হওয়াদের মধ্যে অন্তত ৪০ পরিবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে প্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে আলোচনা সভায় উপস্থিত হন। গুম হওয়া পরিবারদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেখানে কথা হয় গুম হওয়া পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে।

কারও শিশু সন্তান, কারও বৃদ্ধ বাবা-মা উপস্থিত হন। এসেছেন বোন-ভাইসহ অন্য স্বজনরাও। সবার হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি। দাবি একটাই, গুম হওয়াদের ফিরিয়ে দেয়া পাশাপাশি গুমের মতো চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন বন্ধ করা।

স্বামী বেঁচে আছে নাকি মরে গেছেন, তা তারা জানেন না। বিধবা নাকি সধবাও তা নিশ্চিত নয়। বাবা জীবিত নাকি মৃত অনেক শিশু সন্তানই তা জানে না। একদিন ফিরবে এমন সান্ত্বনাও ফিকে হয়ে আসছে দিন দিন।

গুম হওয়া সুমনের বড় বোন আফরোজা ইসলাম ও মারুফা ইসলাম বলেন, আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, প্রায় ৫ বছর আট মাস পেরিয়ে গেলেও ভাইকে ফিরে পেলাম না।

ওর (সুমনের) সন্তানের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। নিষ্পাপ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিআইডি্, মানবাধিকার কমিশন, পুলিশ, র্যাবসহ এমন কোনো জায়গা নেই যে, আমরা দারস্থ হইনি। কিন্তু কেউ আমাদের সুমনের সন্ধান দিতে পারেনি।

বিএনপি নেতা সুমনের মতোই কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সবুজ ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার গাজীপুর থেকে নিখোঁজ হন। সবুজের মেয়ে সুমাইয়া ফেরদৌসও (১০) বুঝেছে বাবার মতো অভিভাবক শূন্যতার যন্ত্রণা।

গুম হওয়া সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আমি, আমার শাশুড়ি, মুক্তিযোদ্ধা বাবা, দুই সন্তানসহ সবাই অপেক্ষায় আছি, সবুজ একদিন ফিরে আসবে। প্রতিটা মুহূর্ত আমরা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। এ যন্ত্রণা সহিবার নয়। স্বজন হারানোর ব্যথা মাত্র তারাই বুঝে যারা হারিয়েছে।

২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পল্লবী থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তৎকালীন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে (৩১) ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে আর খোঁজ মেলেনি।

 

ছোট ভাই হাসনাইন বলেন, ‘ভাইকে ফিরে পেতে কতো জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু ভাইকে পাইনি। এখন ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নাই। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ, ভাইকে ফিরিয়ে দিন।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৩২ জন গুম হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫৮ জনের সন্ধান এখনও মেলেনি। গুম হওয়ার পর অনেককে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার দেখালেও কারও কারও লাশ উদ্ধার হয়েছে।

২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এরপরের বছর থেকে ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

আলোচনা সভায় গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিবছর এই আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে আমরা মায়ের ডাকের আহ্বানে উপস্থিত হই। প্রতিবছরই আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই্। যারা গুম হয়েছেন তারা যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসে। এখনো আমরা আমাদের হারিয়ে গুম হওয়াদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি।

তারা প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি মানবতার মা। আমাদের সন্তানেরা গুম হওয়ায়, ফিরে না আসায় আপনার হৃদয়ে কি রক্তক্ষরণ হয় না। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছেই অনুরোধ, আপনার একটি সিদ্ধান্তেই একটি অসহায় মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। শিশুরা ফিরে পাবে তার বাবাকে।

গত ৬ বছরে গুম হওয়া অনেকেই এখনো ফিরে না আসায় শোকে পরিবারের অনেকে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। গুম হওয়া মুন্নার বাবা প্রতি বছরই এ দিবসে উপস্থিত হলেও আজ তিনি আসেননি। কারণ তিনি মারা গেছেন। বৃদ্ধা মা মরিয়ম বেগম এখন প্রায় অন্ধ।

পারভেজ হোসেনের বাবাও সন্তানকে ফিরে না পাওয়ার শোকে মারা গেছেন। ছোট্ট হৃদি এখনো বাবার জন্য অপেক্ষায়। গুম হওয়া ছেলে সাইফুর রহমান সজিবের মা রেনু রহমানও না ফেরার দেশে। বাবা শফিকুর রহমান নির্বাক চোখ অদূরে শুধু তাকিয়ে থাকেন।

নিখোঁজ ঝন্টু, হুমায়ুন কবির, শাওন কিংবা তপুদের বাবাও না ফেরার দেশে। তাদের মা’রাও অসুস্থ, কেউ চোখে ঝাপসা দেখেন। অথচ তারা জানেন না সন্তানদের অপরাধ কী। কে বা কারা গুম করেছেন আদরের সন্তানকে। গুম হওয়াদের মধ্যে অনেকে ফিরে আসলেও অধিকাংশের খোঁজ মেলেনি।