বাবা কোলে নেয় না, অভিমান ‘রাজকন্যারঃ বাবা ও মেয়ের হৃদয় বিদারক দৃশ্য

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

‘বন্দি ঘরে কেমন আছ বাবা? আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে চাই। তোমার সঙ্গে ঘুমাতে অনেক ভালো লাগে বাবা। অনেক দিন তোমার সঙ্গে ঘুমাই না। একা একা ঘুমাতে আমার অনেক কষ্ট হয় বাবা।’

জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে বাবাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলছিল সাড়ে তিন বছরের আলিশাবা রহমান ইবতিদা। উত্তরে বাবা বললেন, ‘এইতো সোনামণি। শিগগিরই আমরা একসঙ্গে ঘুমাব মা। তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাব।’

এরই মধ্যে আলিশাবা ও তার বাবার আবেগঘন কথোপকথনের এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বাবা-মেয়ের কথা শুনে অনেকেই অশ্রুসিক্ত হয়েছেন।

আলিশাবার বাবা আব্দুর রহমান মুকুল বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত)। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। পরিবার ও প্রিয়জনদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসার একটি রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন তিনি।

ভিডিওতে দেখা যায়, আলিশাবা তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে। আলিশাবা বাবাকে বলে, ‘বাবা তুমি কেমন আছ? আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে চাই। তোমার সঙ্গে ঘুমাতে অনেক ভালো লাগে বাবা। অনেকদিন তোমার সঙ্গে ঘুমাই না। একা একা ঘুমাতে আমার অনেক কষ্ট হয় বাবা।’

বাবার একাকিত্ব হয়ে থাকা কিংবা দূরে থাকার বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে অতিষ্ঠও সে। তারপরও সুযোগ পেলেই বাবার সেই রুমের জানালার কাছে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার মিছে স্বান্তনা আর প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে অস্থির হয়ে আবার মায়ের কাছে ফিরছে। এক কথায় বাবাকে মিছেমিছি জড়িয়ে ধরতে গিয়ে পাষাণ প্রাচীরে বারবার চোট পেয়ে বুকে চাপা কষ্টগুলো নিয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে তাকে।

এভাবেই দিন যাচ্ছে আলীশাবার। কতদিন এভাবে কাটবে তাও সে জানে না। তবে এটা জানে বাবার বুকে মাথা রেখে আবার শুয়ে থাকবে সে, বাবা কাছে এলে মা ও সে (আলীশাবা) নতুন জামা পরে প্রজাপতি দেখতে যাবেন তারা।

গত ২৯ মে থেকে অবুঝ শিশুকে কোলে নিতে না পেরে মেয়ের মতো বাবা বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রহমান মুকুলেরও রয়েছে অনেক কষ্ট। তারপরও সেগুলো চাপা রেখে দূর থেকেই মেয়েকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন।

মুকুল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন। গত ৩১ মে তার শরীরে কোভিড-১৯ পজেটিভ শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই তিনি নিজেকে বাসার একটি আলাদা কক্ষে হোম আইসোলেশনে অনেকটা নিজেকে বন্দি রেখে চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে স্ত্রী ও সাড়ে তিন বছরের কন্যা সন্তান আলীশাবা বসবাস করলেও করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আলাদা থাকছেন তারা। সাময়িক কষ্ট হলেও আবার সাড়ে তিন বছরের মেয়েকে বুকে নিয়ে যেমন শুয়ে থাকতে চান, তেমনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিতও রাখতে চান পুলিশের এ কর্মকর্তা।

মুকুল বলেন, সুস্থ আছি, করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে সমাজ ও পরিবারের স্বার্থে নিজেকে আলাদা রাখছি। কিন্তু সাড়ে তিন বছরের মেয়েকে তা বোঝাতে পারছি না। সে বুকের ওপর শুয়ে থাকতে চায়, কাছে আসতে চায়। এ বয়সে সে কখনো আমার বুকের ওপর ছাড়া শুয়ে থাকেনি। তাই এ আবদারটাই বেশি। কবে তার কাছে যাবো সে প্রশ্ন বার বার। কেন অফিসে যাচ্ছি না, তাও জিজ্ঞাসা করছে।

তিনি বলেন, আমি চাই সুস্থ হয়ে আবার মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে। মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে আজ আমার মতো বহু পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও যদি সাধারণ মানুষ সচেতন হয়, স্বাভাবিক পৃথিবীতে আমরা সবাই একসঙ্গে আগের মতো মিলেমিশে থাকতে পারি তাহলে এ কষ্ট মুছে যাবে সবার। সবাই স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে এ কামনা করি।

মুকুল বলেন, জীবন খরচায় জনগণকে সচেতন করতে আমাদের এ ত্যাগ স্বার্থক হবে তখনই; যখন প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ ঝুঁকি কমিয়ে সবাইকে নিয়ে আমরা ভালো থাকতে পারবো।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগর ও নাগরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি অজুহাত দেখিয়ে বাইরে বের হওয়া মানুষগুলো ঘরমুখো তথা স্বাস্থ্য সচেতনতা ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে মুকুল মাঠ পর্যায়ে করোনাকালের শুরু থেকেই নিরলসভাবে কাজ করেছেন।