বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল।

সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে তিনি একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মহান শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাসহ বিশ্বের সব ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছি। বাংলাদেশের সঙ্গে ইউনেসকো ২০০০ সাল থেকেই এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করে আসছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- “প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বহুভাষায় জ্ঞানার্জন: সংকট এবং সম্ভাবনা”- যা আমার বিবেচনায় অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত হয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে।

তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের এ দিনে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরো অনেকে। আমি বাংলাসহ বিশ্বের সকল ভাষা-শহিদগণের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। সেই সঙ্গে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসৈনিকদের, যাঁদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের বিনিময়ে আমাদের মা, মাটি ও মানুষের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ বাঙালির গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস যুগে যুগে আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বার বার কারাবরণ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকায় এ খবর পৌঁছামাত্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে। এর কিছুদিন পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিব তার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

বাণীতে সরকারপ্রধান বলেন, ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে এক সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ঘোষণা দেয়, পূর্ব বাংলার জনগণকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে হবে। কিন্তু নাজিমুদ্দিনের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ, তমদুন মজলিস ও অন্যান্য দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবসহ অনেক ভাষাসৈনিক সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৬ই মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ঘেরাও করে, সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকেই আহত হন। জিন্নাহ ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উর্দুর পক্ষে বক্তব্য রাখে এবং ২৪শে মার্চ কার্জন হলে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে।

তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপদান করতে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সফরসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন এবং সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর থেকে গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি পান। ১৯ এপ্রিল আবার গ্রেফতার হয়ে জুলাই মাসে মুক্তি পান। এরপর তিনি ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হলে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তিনজন দূত মারফত খবর পাঠান, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে এবং মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদের সভাস্থল ঘেরাও করতে হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল শেষে এই ঘোষণা জানিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে শেখ মুজিব আমরণ অনশন ঘোষণা করলে ১৬ ফেব্রুয়ারি কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করে।

তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের জন্য নির্ধারিত ছিল। শেখ মুজিবের পরামর্শ ও নির্দেশ অনুযায়ী ঐদিন সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মুসলিম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি এবং সকল প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে এবং সেখানে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে কতগুলো তাজা প্রাণ নিমেষেই ঝরে যায়, অনেকে আহত হন, অনেকে গ্রেফতার হন। প্রাদেশিক পরিষদের কয়েকজন সদস্য অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। নিরুপায় হয়ে সরকার সেনাবাহিনী তলব করে, কার্ফু জারি করে এবং প্রাদেশিক পরিষদে বাংলা ভাষার প্রস্তাব গ্রহণ করে।

শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। আওয়ামী লীগ সদস্যগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এরই মধ্যে ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ভেঙে দেয়। শেখ মুজিবসহ সকল নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হন। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়, প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। সেই সরকারই শহীদ মিনার তৈরি, বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্য-বিজ্ঞানের বই প্রকাশ এবং বাংলা টাইপ-রাইটার উদ্ভাবনের জন্য প্রথম প্রকল্প গ্রহণ করে। দুর্ভাগ্য, ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারির ফলে সেই আকাঙ্ক্ষাগুলো আর পূরণ হয়নি।

তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা সকল দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলায় জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে বক্তৃতা দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্ব সভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমাদের সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে কানাডা প্রবাসী রফিক এবং ছালাম নামে দু’জন বাংলাদেশি কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য মিলে ‘মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদ্‌যাপনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব প্রেরণ করে। জাতিসংঘ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে প্রেরণ করার পরামর্শ দেয়। আমরা দ্রুত মাতৃভাষা সংরক্ষণ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর ইউনেস্কোকে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি পুনরায় প্রেরণ করি। ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছি। বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদা রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। নৃ-গোষ্ঠিদের ভাষা ও বর্ণমালাকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করার জন্য ২০১৭ সাল থেকে তাঁদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন করেছি। এবছর তাঁদের নিজস্ব ভাষায় প্রায় ৩৩ হাজার বই বিতরণ করেছি। আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

শেখ হাসিনা বলেন, ভাষা আন্দোলনে বাঙালি কৃতি সন্তানদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আদর্শকে ধারণ করে গত ১৩ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছি। বাংলাদেশকে আমরা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল-এ পরিণত করেছি। সম্প্রতি আমরা ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছি। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি এবং মুজিববর্ষ উদযাপন করছি। রূপকল্প-২০৪১ অর্জনকে সামনে রেখে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ বাস্তবায়ন করছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অচিরেই আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল ‘সোনার বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করবো।