বাইসাইকেল কিকের আদ্যোপান্ত

:
: ৬ years ago

গত বেশ কিছুদিন ধরে ফুটবল বিশ্বের আলোচনার প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে বাইসাইকেল কিক।

চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে জুভেন্টাসের ঘরের মাঠে জুভেন্টাসের বিপক্ষে ৩-১ স্কোরে জেতে রিয়াল মাদ্রিদ।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো করেন ২টি গোল। এর মধ্যে তার দ্বিতীয় গোলটিই ছিল একটি অনন্য বাইসাইকেল কিক। আর ফুটবল বিশ্ব মাতিয়ে নেয় সেই গোল।

সেই সুবাদেই রোনালদোর ফ্যানরা তো বটেই, তার বিদ্বেষীরাও মেতেছেন রোনালদো বন্দনায়। প্রতিপক্ষ জুভেন্টাসের ফ্যানরা তো সেই মুহূর্তে স্টেডিয়ামেই দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছেন তাকে এবং তার এই সুন্দর গোলকে।

ক্যারিয়ারে এর আগে কখনো প্রতিপক্ষের মাঠে এমন অভ্যর্থনা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি রোনালদোর।

এছাড়াও বিভিন্ন দলের বিভিন্ন খেলোয়াড়, কোচ- এমনকি চিরন্তন প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার বর্তমান ও সাবেক খেলোয়াড়েরাও প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন রোনালদোর স্কিলের।

সেই সাথে ফেসবুক, টুইটার সহ সকল সামাজিক মাধ্যম গুলোতে বাইসাইকেল কিক নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে।

বাইসাইকেল কিক ফুটবলের বিশেষ স্কিলগুলোর মধ্যে অন্যতম।

পুরো শরীর কে বাতাসে ভাসিয়ে পা দিয়ে বল কে শরীরের পিছন দিকে কিক করাই হল বাইসাইকেল কিক। এই কিক টি ওভারহেড কিক বা সিসর কিক নামেও পরিচিত।

এই কিক ডিফেন্স বা অ্যাটাক দুই ধরনের কাজেই ব্যবহৃত হয়।

কিন্তু ফুটবলের সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয়ই হল গোল। তাই বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে গোল করা হলে স্কিল টি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে বহুগুণে।

বাইসাইকেল কিক দেখতে যতটা মনোমুগ্ধকর, তা মাঠে বাস্তবায়ন করতে পারা ঠিক ততটাই কঠিন। বাস্তবায়ন করতে পারার জন্য যথেষ্ট ফিটনেস ও মনোযোগ দরকার হয়।

বাতাসে ভেসে আসা বলকে নিজে বাতাসে ভেসে থেকে উল্টো দিক থেকে কিক করার জন্য টাইমিং, স্কিল দুটোর সমন্বয়ের বিশেষ প্রয়োজন।

উঁচুতে ছুটে আসা বলকে কিক করার জন্য এক পা দিয়ে বাতাসে লাফিয়ে উঠে অন্য পা দিয়ে বলটিকে ঠিক সময়ে কিক করে শরীরের পিছন দিকে পাঠাতে হয়। হাত বাতাসে ভাসিয়ে ব্যালেন্স করতে হয় নিজের শরীরকে।

আবার বলটিকে শুধু কিক করলেই হয়না, বল যেন সঠিক দিকে যায় সেই দিকেও নজর রাখার প্রয়োজন পড়ে। অনেক ফুটবলারের জন্য এই কিকে গোল করা একটি স্বপ্ন পূরণের সমান।

আবার অনেক ফুটবলারই বাইসাইকেল কিকের স্কিল নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। কারণ বাতাসে ভেসে কিক করতে হয় বলে কিকের পর পড়ে গিয়ে ফুটবলারদের ইঞ্জুরড হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

পিছন দিক দিয়ে পড়ে গিয়ে একজনের মাথা বা ঘাড়ে আঘাত লেগে বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। আবার হাস্যকর হলেও সত্য বাইসাইকেল কিক ইঙ্গিত করে যে অন্য একজন তার নিজের কাজটি সঠিকভাবে করতে পারেনি।

অর্থাৎ যেই ক্রস আসার ফলে একজন খেলোয়াড়কে বাইসাইকেল কিক দিয়ে বল জালে জড়াতে হয় সেই ক্রসদাতা ঠিকভাবে ক্রস করতে পারেন নি।

এমনটাই ভাবেন গতি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জার্মান বিজ্ঞানী হারম্যান শোয়্যামার। তিনি বাইসাইকেল কিকে গোল করতে কি প্রয়োজন সে প্রসঙ্গে বলেছেন “প্রবৃত্তি, সাহস এবং একটি খারাপ ক্রস”।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর খেলা যারা নিয়মিত অনুসরণ করে থাকেন, তারাও জানেন বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি এই ধরণের একটি গোল করার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন।

ট্রেইনিং ও প্র্যাকটিস ম্যাচেও চেষ্টা করেছেন। শেষ এল ক্লাসিকোতেও তাকে ডিবক্সের ভেতর বাইসাইকেল কিক নিতে দেখা যায় তবে তিনি বলটি জালে ঢোকাতে ব্যর্থ হন।

তবে সফল হয়েছেন জুভেন্টাসের বিপক্ষের ম্যাচটিতে। বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে জুভেন্টাসের বিপক্ষের ম্যাচের পূর্বে এই নির্দিষ্ট স্কিলে বিশেষ সময় দিয়েছেন ট্রেইনিং এও। তবে অবশ্যই বাইসাইকেল কিকে গোল করা তিনিই প্রথম খেলোয়াড় নন।

উরুগুয়ের লেখক এডুয়ার্ডো গ্যালিয়ানো এর মতে রেমন উনজাগা চিলিয়ান পোর্ট টালকাহুয়ানাতে ১৯১৪ সালে এই স্কিলটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন।

সেখানে উনজাগার এই বাইসাইকেল কিক টির একটি মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে ২০১৪ সালে। মূর্তিটির ভাস্কর হলেন মারিও এ্যাঞ্জেলো।

অপর একটি মতবাদ অনুসারে স্কিল টি প্রথম আবিষ্কৃত হয় পেরুতে ১৮৯২ সালের দিকে।

আর্জেন্টাইন সাংবাদিক জর্জ ব্যারাজ্জার তদন্তানুসারে পেরুর ক্যালাও পোর্টে আফ্রিকান খেলোয়াড় ক্যালাকো ব্রিটিশদের সাথে এক খেলায় এই স্কিলটি উদ্ভাবন করেন।

পরবর্তীতে চিলিয়ানরা পেরু হতে এই স্কিলটি কপি করে। কে সঠিক সেটি শতভাগ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
তবে বাইসাইকেল কিকে গোল করা প্রথম নথিভুক্ত ফুটবলার হলেন ব্রাজিলিয়ান পেলে।

১৯৬৮ সালে তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে গোল করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে আরো অনেকে এই ভাবে গোল করেছেন।

আমেরিকাতে ফুটবল যেটি সকার নামে পরিচিত সেই খেলাও অতটা জনপ্রিয় নয়। তবে ১৯৯৪ সালে আমেরিকান ডিফেন্ডার মার্সেলো বালবো এর বাইসাইকেল কিক পুরো আমেরিকা জুড়ে ফুটবলকেও জনপ্রিয় করে তোলে বলে মনে করা হয়।

আধুনিক ফুটবলে রোনালদিনহো, রিভালদো, জিনেদিন জিদান, মারিও বালোতেল্লি, ওয়েইন রুনি, ইব্রাহিমোভিচ প্রমুখ আরো অনেকেই গোল করেছেন বাই সাইকেল কিকের মাধ্যমে।

ইব্রাহিমোভিচ ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রায় ৩৫ গজেরও বেশি দূরত্ব থেকে বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে বলকে জালে জড়াতে সক্ষম হন।

তার এই গোলটি ২০১৩ সালে পুসকাস এওয়ার্ড জিতে নেয়।

স্ট্রাইকার বা ডিফেন্ডার তো বটেই, বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে গোল করার রেকর্ড আছে গোলকিপারের ও।

২০১৬ সালে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল ক্লাব বারোকার গোলকিপার অস্কারিন মাসুলুকে ওরলান্ডো পাইরেটস এর বিপক্ষে শেষ মিনিটে বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান।

গোলটি ২০১৬ সালের পুসকাস এওয়ার্ডের জন্য নমিনেশনও পেয়েছিল।

এই তালিকায় শেষ পর্যন্ত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নাম লেখালেও এ ধরণের গোল খেলার মাঠে এখনও পাওয়া হয়নি লিওনেল মেসির। যদিও ২০১৪ সালের ফিফা গেমের প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপনে মেসিকে এই কিক নিতে দেখা যায়।

তবে ফুটবল প্রেমীদের মন মাতানো সর্বেশেষ বাইসাইকেল কিকের গোলদাতার নাম যদি ক্রিস্টিয়ানো ভেবে থাকেন তবে ভুল ভাবছেন বৈকি।

এই দলে সর্বশেষ নাম লিখিয়ে ফেলেছেন ক্রিস্টিয়ানোরই প্রথম সন্তান রোনালদো জুনিয়র।

অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে ম্যাচ শেষে বার্নাব্যুতে খেলার ছলেই লুকাসের পাস করা একটি বলকে বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে গোল পোস্টে ঢুকিয়েছে সে।

আর সাথে সাথেই এই গোলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।

৩৩ বছর বয়সী ক্রিস্টিয়ানো হয়তো আর খুব বেশিদিন মাতাতে পারবেন না ফুটবলের মাঠ, তবে নিজেই নিজের রিপ্লেসমেন্ট গড়ে তুলছেন হয়তো।