অনলাইন ডেস্ক :: জাদু কী করে দর্শক-শ্রোতাকে অনুভূতির নতুন এক জগতে নিয়ে যায় তা বুঝতে হলে অবশ্যই বিশ্বনন্দিত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জাদু দেখতে হবে। জাদুকে বিনোদন থেকে শিল্পের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত ও সম্মানিত করেছেন জুয়েল আইচ।
কেবল মাত্র জাদুশিল্পীই নন; একাধারে বাঁশিবাদক, চিত্রশিল্পী, সুবক্তা, লেখক, সমাজসেবী -এমনি বহু গুণের অধিকারী। এত গুণ থাকা স্বত্বেও তার চরিত্রে কোনোপ্রকার অহংকার নেই। এছাড়াও তার আরেকটি পরিচয় রয়েছে- তিনি একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। তার অনন্য শিল্পকর্ম ও উচ্চমানের ব্যক্তিত্বপূর্ণ শিল্পজীবন সবার কাছে দ্যুতিময়।
মঞ্চে জাদু পরিবেশনার সময় দর্শক-শ্রোতাকে তিনি নিয়ে যান ফ্যান্টাসির জগতে, যেখানে সবই রহস্যের, সবই সুন্দর, সবই বিস্ময়কর! আবার কখনো কখনো শিক্ষামূলকও। প্রতিটি পরিবেশনার প্রতিটি মুহূর্তে দর্শকের মনকে আলোড়িত করে তার চমকিত প্রতিভা।
আজ ১০ এপ্রিল বিশ্ববরেণ্য জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জন্মদিন। ১৯৫২ সালের এইদিনে তিনি বরিশাল জেলায়। তার পিতা বি কে আইচ ছিলেন ব্যবসায়ী আর মাতা সরযূ আইচ ছিলেন সুগৃহিণী। জন্ম বরিশালে হলেও জুয়েল আইচের ছেলেবেলা কেটেছে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সমদেকাঠির গ্রামের বাড়িতে। সেই সুবাদে সমদেকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হয়। পরে তিনি পিরোজপুর শহরে চলে যান।
১৯৭১ সালে স্নাতক পরীক্ষা দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি দেশমাতৃকার সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করতে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তাই সে বছর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পরে ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
এরপর শিক্ষকতার ওপর এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর ঢাকাতে, চলচ্চিত্র তৈরির ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। তবে তার লেখাপড়া কিন্তু কখনও থেমে থাকেনি। সম্ভবত ঢাকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটির মালিক জুয়েল আইচ।
শৈশবে তিনি রূপকথা এবং জাদুর গল্প শুনতে খুবই পছন্দ করতেন। মায়ের কাছে রূপকথা এবং জাদুর গল্প শুনতে শুনতে মনের অজান্তেই জাদুবিদ্যার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়। শৈশবে নিজ বাড়ির আঙিনায় এক বেদে জাদুকরের জাদু দেখে বিস্মিত হন জুয়েল আইচ। কাঠের তিনটি বাটির নিচে কাপড়ের তিনটি বল রেখে কি তাজ্জব জাদু দেখালেন তিনি! তার জাদু দেখে অবাক হলেন শিশু জুয়েল।
তখন থেকেই জাদু শেখার বাসনা তার মনের মধ্যে অনবরত ডানা ঝাপটাতে থাকে। কিন্তু বেদে জাদুকরটির তেল চিটচিটে কাপড়ের বল, আর তার অনাহারি রুগ্ন-ভগ্ন শরীর এবং ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যের অসহায়ত্বের যে ছাপ অবয়বে ফুটে উঠেছিল- তা দেখে ওর মতো ম্যাজিশিয়ান হওয়ার আদৌ কোনো ইচ্ছে হল না। তখন জাদুকরদের সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুন।
১৯৬৫ সালে পিরোজপুরে তাঁবু ফেলে বিখ্যাত ‘সাধনা লায়ন সার্কাস’। জাদুশিল্পী হিসেবে এ সার্কাস দলের নিয়মিত পারফর্মার ছিলেন প্রখ্যাত জাদুশিল্পী প্রফেসর আবদুর রশিদ। সিদ্ধহস্ত জাদুশিল্পী প্রফেসর আবদুর রশিদের নিপুণ জাদু দেখে স্তম্ভিত হলেন তিনি। তদুপরি জাদুসম্রাট পিসি সরকারের (সিনিয়র) লেখা ‘ম্যাজিকের খেলা’, জাদুগির আলাদেনের লেখা ‘অভিনব ম্যাজিক’ গ্রন্থ দুটি পড়েও অনুপ্রাণিত হন।
একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও জাদুশিল্পকে পেশা হিসেবে নিয়ে পি সি সরকার দিব্যি জীবনযাপন করছেন জানতে পেরে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হলেন জুয়েল। এ সময়ে তার হাতে পড়ল কবি বন্দে আলী মিঞার রূপকথার একটি বই। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আবুল কাসেমের আঁকা ছবিগুলো বালক জুয়েলের সামনে যেন স্বপ্নকে চোখের সামনে মেলে ধরে।
১৯৭১ সালে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠির সুবিশাল পেয়ারা বাগানের গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে পাক বাহিনী ছিল ভীতসন্ত্রস্থ। জুয়েল আইচ ছিলেন বিশাল বিস্তৃত সেই পেয়ারা বাগানের গেরিলা যুদ্ধের সাহসী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জুয়েল আইচের পিরোজপুরের বাড়ির সব জিনিসপত্র প্রথমে লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় তাঁর ম্যাজিকের সব যন্ত্রপাতি, বাঁশি, ছবি আঁকার ইজেল, রং-তুলি, ক্যানভাস, বইয়ের লাইব্রেরি, যাবতীয় পুরস্কার, নিজের আঁকা সব চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, তিল তিল করে জমানো জীবনের সব সঞ্চয় লোপাট হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাহাদুরপুর শরণার্থী ক্যাম্পের স্কুলে তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনুপ্রেরণা দান এবং শিক্ষকতা করার মাধ্যমে মূলত বিদেশের মাটিতেই তার শিক্ষকতা জীবনের ভিত রচিত হয়। ভারতে অবস্থানকালে কলকাতার ‘মহাজাতি সদনে’ ভারতীয় বিশিষ্ট জাদুশিল্পী ও পি আগরওয়ালের ম্যাজিক শো দেখতে যান জুয়েল আইচ। ম্যাজিক শো শেষ হলে, ম্যাজিশিয়ান ও পি আগরওয়ালের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার জন্য তিনি ঢোকেন সাজঘরে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের জাদুশিল্পী আলাদেন। ওইদিন ম্যাজিশিয়ান ও পি আগরওয়ালের মাধ্যমে জুয়েল আইচ পরিচিত হলেন জাদুগীর আলাদেনের সঙ্গে। সেই থেকেই তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক, যা আমৃত্যু অটুট ছিল।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৭ ডিসেম্বর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই জুয়েল আইচ শিক্ষকতা পেশার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কথা চিন্তা করলেন। ঢাকা শহর ছেড়ে তিনি চলে গেলেন গ্রামে। উদ্দেশ্য গরিবদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে সমুদয়কাঠি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পড়ানোর সময় রাগারাগি না করে সুন্দর সুন্দর গল্প বলে, উপমা দিয়ে, ছবি এঁকে, অভিনয় করে, জাদু দেখিয়ে প্রয়োজনে কৌতুক বলে, নিজের তৈরি নানা রকম খেলনা ও সরঞ্জামের সাহায্যে কিছুটা খেলা এবং কিছুটা কাজের মাধ্যমে শৃঙ্খলাবোধ এবং ছাত্রদের মধ্যে আশা জাগিয়ে তুলতেন।
যার ফলে দূর-দূরান্তের শিক্ষার্থীরা এসে দলে দলে ভর্তি হতে শুরু করে সমুদয়কাঠি হাই স্কুলে। স্কুল ভরে উঠে কানায় কানায়। তখন তিনি গড়ে তুললেন পাবলিক লাইব্রেরি। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও নতুন প্রাণের জোয়ার এলো চারদিকে। এলাকাবাসীর জোর দাবির মুখে মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে হয়।
তখন তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিটুল করের বাড়িতে রিহার্সাল করতেন এবং জাদু নিয়ে গবেষণা ও পড়াশোনা করতেন। ওই বাড়িতেই থাকত তার জাদুর সব সরঞ্জাম ও প্রদর্শনীর উপকরণ। নির্বাচন নিয়ে নিটুলের সঙ্গে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার দ্বন্দ্ব বাঁধলে এক পর্যায়ে ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় নিটুল করের বাড়িঘরসহ আসবাবপত্র। রেহাই পায়নি জুয়েল আইচের জাদুর সরঞ্জাম। কিন্তু হঠাৎ করে একদল দুর্বৃত্ত তার ম্যাজিক সরঞ্জামাদি পুড়িয়ে দেয়। তখন তিনি দ্বিতীয় দফায় নিঃস্ব হয়ে যান। এ সময় তিনি স্কুল শিক্ষকতার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে পুনরায় ম্যাজিক ইনস্ট্র–মেন্ট নতুনভাবে তৈরি করার কাজে মনোযোগী হন এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের আহ্বানে আবার ফিরে আসেন ঢাকায়।
এ দেশের জাদুশিল্পের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। তাই তিনি জাদুশিল্পের পুনর্জাগরণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শুরু করলেন নিরলস সাধনা। তিনি শুধু একজন বিশ্ববিজয়ী জাদুশিল্পীই হতে চাননি। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জাদুর পুনর্জাগরণ চেয়েছেন। একদিকে জাদুর শৈল্পিক উৎকর্ষের জন্য কাজ করেছেন, অন্যদিকে গণচেতনা জাগানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন।
তার প্রথম দিককার দুই ঘণ্টাব্যাপী জাদু প্রদর্শনীর চূড়ান্ত আকর্ষণীয় জাদুটিতে মঞ্চকে ফুলের বাগান বানিয়ে ফেলতেন। আর আহ্বান জানাতেন ‘জাদুশিল্পের পুনর্জাগরণে এগিয়ে আসুন’ ওই বাক্যটি লেখা বিশাল সিল্কের ব্যানার হাওয়া থেকে তৈরি করে শূন্যে তুলে ধরে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বাজাতেন তার মোহনীয় বাঁশিতে। প্রেক্ষাগৃহপূর্ণ দর্শক দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতকে সম্মান প্রদর্শন করতেন। একাত্বতা জানাতেন তার আহ্বানের সঙ্গে। এ জাদুটির মাধ্যমে তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী একক জাদু প্রদর্শনী করেছিলেন টানা ১১ বছর।
১৯৮০ সালে ‘সোসাইটি অব আমেরিকান ম্যাজিশিয়ান’ তাদের আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে তাকে আমন্ত্রণ জানায় সদলবলে জাদু প্রদর্শনের জন্য। ১৯৮১ সালের ২৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে যাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় জাদুর মাধ্যমে তার বিশ্বজয়ের পালা। প্রথম অনুষ্ঠানেই বাজিমাত। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। জাদুশিল্পী হিসেবে জুয়েল আইচ অসংখ্য দেশে ভ্রমণ করেছেন। সব জায়গাতেই তিনি লাখো মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন।
বিশ্ববিখ্যাত জাদু গবেষক ‘জেমস র্যান্ডি’ সারা পৃথিবীর জাদুর ইতিহাসের আদিকাল থেকে আধুনিককালের উল্লেখযোগ্য সব জাদুশিল্পীদের ওপর এক ব্যাপক গবেষণা করেন। অবশেষে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জাদুশিল্পীদের একটি তালিকা করেন। এতে সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছে জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। বিশ্ববিখ্যাত জাদুশিল্পী ডেভিড কপারফিল্ড তার সম্পর্কে বলেন, ‘বন্ধু, জোর কদমে এগিয়ে চলো। ম্যাজিক তোমাকে চায়।’
দেশের প্রায় সব ক’টি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন থেকে তিনি সংবর্ধনা, গোল্ড মেডেল, ট্রফি, ক্রেস্ট, প্লাক, উত্তরীয়, মানপত্র ইত্যাদিতে ভূষিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আজীবন সদস্য তিনি। জাদু শিল্পের বিস্ময় জুয়েল আইচ বাংলাদেশের অহংকার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক মাননীয় রাষ্ট্রপ্রধান, প্রিন্স ও প্রিন্সেসগণও মঞ্চে তাঁর জাদু দেখে বিমোহিত হয়েছেন। অনেকে তাদের প্রাসাদে জুয়েল আইচকে রাজকীয় ভোজে আপ্যায়িত করেছেন। উপহার দিয়েছেন অনেক মূল্যবান উপঢৌকন।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শতাধিক থিয়েটার এবং টেলিভিশনে বহুবার সেসব দেশের মূলস্রোতের দর্শকদের জাদু দেখিয়ে বিমোহিত করেছেন। জুয়েল আইচ ‘জাদুশিল্পে’ একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তার সাহসী ভূমিকায় জাদু এখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত শিল্প।