জীবন সায়াহ্নে এসে প্রাণে বাঁচতে পরিবার নিয়ে নিজের বসতভিটে ছেড়েছেন প্রায় শত বছরের বৃদ্ধ পণ্ডিত নিরঞ্জন চক্রবর্তী। একসময় যিনি ছিলেন এলাকায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক, আজ মৃত্যুর আগে সইতে হলো অপমান। আনোয়ারার জয়কালী হাট সরস্বতী মন্দির সড়ক সংলগ্ন এলাকায় ঘটেছে এ ঘটনা।
সোমবার (২২ এপ্রিল) সরেজমিন দেখা গেছে, বাড়ি ও ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরটি তালাবদ্ধ। এর আগে সেখানে টাঙানো যুবলীগ নেতা নামধারী কামরুল ইসলাম হেলাল (মধু হেলাল), আনোয়ার, মানিক, আবদুর রহিম ও মহিদুল্লাহ নামের ৫ জনের নামফলক সরিয়ে নেয় পুলিশ। প্রতিবেশীরা জানান, এই পরিবারটি ভয়ে শহরে চলে গেছে। তবে কোথায় আছে তা কেউ জানেন না। প্রভাবশালীদের ভয়ে তারা এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজী হননি।
প্রবীণ শিক্ষক নিরঞ্জন চক্রবর্তী আনোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় এবং তৈলারদ্বীপ বারখাইন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর ছেলে প্রণব চক্রবর্তীও তৈলারদ্বীপ বারখাইন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।
প্রণব চক্রবর্তী মুঠোফোনে জানান, হেলাল তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গত ১০ এপ্রিল (বুধবার) সন্ধ্যায় বাড়িতে হানা দেয়। তারা ৭-৮ জনের একটি দল অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে শয্যাশায়ী নিরঞ্জন পণ্ডিতের সামনে ছেলে-মেয়েকে জিম্মি করে। হেলাল ওই জমি ক্রয়সূত্রে নিজেদের দাবি করে জোরপূর্বক আগে থেকে তৈরী করা দলিলে বাবার টিপসই এবং সাক্ষী বানিয়ে তার স্বাক্ষর নেয়। এসময় সঙ্গে নিয়ে আসা হয় উপজেলা ভূমি অফিসের সাব রেজিস্ট্রার অফিসের এক কর্মকর্তাকে। ৮ গণ্ডা জমি ছেড়ে না দিলে তাদের প্রাণে মারার হুমকিও দেয়া হয়।
শিক্ষক প্রণব চক্রবর্তী বলেন, ‘এর আগে আমাকে তুলে নিয়ে গত ৬-৯ এপ্রিল পর্যন্ত হেলালের শহরের বাসায় আটকে রেখে ভয় দেখানো হয়। এসময় আমার মুঠোফোন ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং ডায়েরি পুড়িয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে টাকা নেয়ার দাবি তুলে খালি চেকে স্বাক্ষর দেয়ার চাপও দেয়। বলেছে, ‘বাংলাদেশ তোদের না, ভারতে চলে যা। ৪০ লাখ টাকায় জায়গাটি রেজিস্ট্রেশন করে নিলাম’। গত সপ্তাহে তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ডবলমুরিং থানায় জিডিও করেছি। ভূমিমন্ত্রীর সঙ্গে এলাকাবাসী এবং আমি দেখা করে আবেদন জানিয়েছি। মন্ত্রীর নির্দেশের পরও হেলাল ও তার বাহিনী ধরা পড়েনি। তারা এলাকায় পাহারা বসিয়েছে’।
‘দখলবাজদের কবল থেকে আমার পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করতে ভূমি মন্ত্রীর সহযোগিতা চাই। সারাজীবন শিক্ষকতা করে মানুষ গড়েছি। আজ তার প্রতিদান এভাবেই পেতে হচ্ছে। অপমানিত বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। জীবদ্দশায় তাঁর সম্পত্তি রক্ষা হয়েছে-সেটা যেন তিনি দেখে যেতে পারেন’ বলেন শিক্ষক প্রণব।
স্থানীয়রা জানান, ভূমিদস্যু মধু হেলালের দৃষ্টি পড়ায় আশপাশের ১০-১২টি সংখ্যালঘু পরিবারও এখন আতঙ্কে আছে। বন্ধ হয়ে গেছে কালী মন্দিরে পূজা-অর্চনা। ১২ এপ্রিল (শুক্রবার) থেকে গ্রাম ছেড়েছে ওই পরিবার।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি। ভূমিমন্ত্রীর এলাকায় ভূমিহারা বৃদ্ধ নিরঞ্জন পণ্ডিতকে তার জমি ফিরিয়ে দিয়ে নিরাপদে বসবাসের জন্য সুযোগ দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন তারা।
আনোয়ারা ৭ নম্বর সদর ইউপি চেয়ারম্যান অসীম দেব বলেন, এলাকার একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির জমি দখলের চেষ্টার বিষয়টি নিন্দনীয়। প্রশাসন তাদের সঙ্গে আছে। মন্ত্রীর নির্দেশে থানায় মামলা হয়েছে।
আনোয়ারা থানার ওসি দুলাল মাহমুদ বলেন, ১৮ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) প্রণব চক্রবর্তী এ ব্যাপারে মামলা করেছেন। ৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- কামরুল ইসলাম হেলাল (মধু হেলাল), আনোয়ার, মানিক, আবদুর রহিম, মো. আলী প্রকাশ মহিদুল্লাহ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম ও মহিউদ্দিন। আসামিদের গ্রেফতার করার চেষ্টা চলছে।
আনোয়ারার সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত আছি। যারা অবৈধ দখলের চেষ্টা করছে, তাদের আটক করতে থানা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কোনও অন্যায়কে আমি প্রশ্রয় দেবো না। যারা ন্যায়ের পক্ষে, আমি তাদের সঙ্গেই আছি’।