বাংলাদেশে কেন নদী খনন করছে ভারত?

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

ব্রহ্মপুত্র নদে বন্দর করে রাখা ভারতীয় পাঁচটি জরিপ নৌযানের একটি এসএল লোহিত। এ নৌযানের নাবিক প্রণব পায়েং। ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপথ কর্তৃপক্ষে (আইডব্লিউএআই) যোগদানের পর পায়েংয়ের কেটে গেছে ২৭ বছর। নদীর তীরের চেয়ে মাঝ নদীতেই তার এই ২৭ বছরের অধিকাংশ রাত কেটেছে।

নদ-নদীর নাড়ি-নক্ষত্র পায়েংয়ের নখদর্পণে। ভারতীয় বিখ্যাত গায়ক ভুপেন হাজারিকার ‘মহাবাহু’র (মহৎ) মতোই। আসামের সাদিয়া থেকে ধুবরি পর্যন্ত নদী সম্প্রসারণের কাজ চলছে। রাজ্য পানিসম্পদ বিভাগ স্যাটেলাইটে চিত্র ধারণের পর বলছে, ৮৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী খনন হয়েছে। ধুবরির কাছে নদী প্রশস্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার।

হাউড্রোগ্রাফিক জরিপকারীরা নদীর গভীরতা নির্ধারণ করেন গভীর এবং অগভীর স্থান পরিমাপ করার পর। কিন্তু পায়েং তার নৌ-বিদ্যার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। ভারতীয় এই নৌ কর্মকর্তা অনায়াসেই বলে দিতে পারেন ব্রহ্মপুত্র নদের বৃহত্তম উপনদী সুবানসিরি মুখ, মাজুলির ভেকেলি, ওরাংসহ বিভিন্ন নদ-নদীর কোন অংশের গভীরতা কত।

পায়েংয়ের অভিজ্ঞতা ও তথ্যের ভিত্তিতে হাউড্রোগ্রাফিক জরিপকারীরা নদীর খনন করেছে। গত জুলাইয়ে ভারত সরকার ব্রহ্মপুত্র নদের খননের জন্য প্রায় ৪০০ কোটি রুপি বরাদ্দ দেয়। ইতোমধ্যে চারটি ড্রেজার মেশিন কাজ শুরু করেছে। এছাড়া আরও দুটি মেশিন কাজ শুরুর অপেক্ষায়।

প্রত্যেক ড্রেজার মেশিনে আছে একটি কাটার সাকশন ড্রেজার (সিএসডি), সিএসডিকে পরিচালনার জন্য একটি টাগ মেশিন ও রাতযাপনের জন্য একটি হাউসবোট। প্রত্যেকটি মেশিনের মূল্য প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি রুপি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিআইএ) সঙ্গে দুটি নদী খননে একটি চুক্তি করেছে নয়াদিল্লি। চুক্তি অনুযায়ী যমুনা নদীর (ভারতে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত) সিরাজগঞ্জ অংশ থেকে দইখাওয়া পর্যন্ত (১৭৫ কিলোমিটার) এবং কুশিয়ারা নদীর আশুগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ পর্যন্ত (২৯৫ কিলোমিটার) খনন করবে নয়াদিল্লি।

কুশিয়ারা নদী বাংলাদেশ ও আসামের মধ্যে প্রবাহিত, যা দক্ষিণ আসামের বরাক নদীর একটি শাখা। বাংলাদেশের এই দুই নদী খননে ৩০৫ কোটি রুপি ব্যয় হবে। এর ৮০ শতাংশ দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ভারত; বাকিটা বাংলাদেশের। চলতি বছরের শেষ দিকে এ ব্যাপারে চুক্তি সম্পন্ন হবে দুই দেশের। দুই দেশের কোম্পানিগুলো নদী খনন কাজের নিলামে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। বাংলাদেশে দুই নদীর খনন কাজ শুরু হবে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে। চুক্তি অনুযায়ী, কোম্পানিগুলো দুই নদীর ৪৫ মিটার প্রশস্ত অংশে সর্বনিম্ন আড়াই থেকে তিন মিটার খনন করবে।

দুই দেশের এই নদী খননকাজ শেষে ২০২০ সালের মধ্যভাগে ভারত পশ্চিমবাংলার শিলিগুড়ির ২২ কিলোমিটার করিডোর ব্যবহার করতে পারবে। এ করিডোরের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বাংলাদেশে খনন কাজ শেষ হলে ভারতের বারানসির জাতীয় জলপথ (এনডব্লিউ-১, গঙ্গা), জাতীয় জলপথ-২ ও জাতীয় জলপথ-১৬ বাংলাদেশের চ্যানেল ব্যবহার করে বড় বড় নৌযান ভাসাতে পারবে ভারত।

বাংলাদেশে নদী খননের ব্যাপারে জানতে ভারতের কেন্দ্রীয় সড়ক যোগাযোগ ও নৌমন্ত্রী নিতিন গাদকারির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ইকোনমিক টাইমস ম্যাগাজিন। লিখিত জবাবে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ড্রেজিং সম্পন্ন হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওপর চাপ কমে আসবে।’ তবে বিকল্প এ রুটের ব্যাপারে কৌশলগত গুরুত্বের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন ভারতের এই মন্ত্রী। ভারত বিকল্প রুট নির্মাণ করতে চাচ্ছে বলে জানান তিনি। এবং এটি দ্রুতই করতে চায় ভারত।

তবে এখানে যৌক্তিক একটি বিষয় সামনে চলে আসছে। সেটি হচ্ছে সম্প্রতি ডোকলামে সড়ক সম্প্রসারণের কাজে চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি, যা ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মনে করা হয়। যদিও গত ২৮ আগস্ট ওই অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে দুই দেশ। তবে চলতি সপ্তাহে বেশি কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর এসেছে যে, শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে চুম্বি উপত্যকায় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রায় এক হাজার সদস্য ঘাঁটি গেড়েছে।

তবে দুই দেশের এই নদীপথের অর্থনৈতিক হিসাব-নিকেশও আছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল বলেন, ‘ব্রিটিশরা নদীপথে কার্গো স্টিমারে পেট্রোলিয়াম, কাঠ ও কয়লা দ্রব্য আসাম থেকে সমুদ্রবন্দরে নিয়ে যেত। কিন্তু এসব রুট বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। খনন শেষ হলে সারা বছর ধরে নদীর ব্যবহার করা যাবে। স্থলবেষ্টিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সহজেই সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপিত হবে।’

শিলিগিরি করিডোর ও বিকল্প এ রুটের ফলে জ্বালানি ও পরিবেশের ব্যাপক লাভ যোগ করবে। সড়কে একসঙ্গে ২০০ ট্রাকের বদলে দুই হাজার মেট্রিক টনবাহী কার্গো চলাচল করবে নদীপথে। ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপথ কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, সড়ক ও রেলপথের চেয়ে জলপথের পরিবহন ব্যয় অত্যন্ত সাশ্রয়ী। বর্তমানে গঙ্গার বারানসি থেকে হলদিয়া, ব্রহ্মপুত্রের পান্ডু (গুয়াহাটি) থেকে নিমতি ঘাটে (জোরহাট) চলাচলকারী পর্যটক নৌযানগুলো নতুন পথ পাবে।

বিদ্যমান ভারত-বাংলাদেশের এক হাজার ৬৪৭ কিলোমিটারের প্রটোকল রুট আসামের নগাঁওয়ের শিলঘাটের সঙ্গে কলকাতার মধ্যে এবং কলকাতার সঙ্গে করিমগঞ্জের (দক্ষিণ আসাম) সংযোগ স্থাপন করেছে। নতুন এ প্রোটোকলের আওতায় বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, মংলা, সিরাজগঞ্জ ও আশুগঞ্জে এবং ভারতের কলকাতা, হলদিয়া, করিমগঞ্জ, পান্ডু (গুয়াহাটি) ও শিলঘাটে ভারতীয় মালবাহী জাহাজ নোঙর করতে পারবে।

তবে সমস্যা দেখা দেয় বর্ষাকালের পর যখন পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। এ সময় বড় বড় নৌযান নদীতে চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। যেখানে খনন কাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ভারতের ক্ষমতাসীন জোট সরকার জাহাজ পরিবহন এবং মালবাহী জাহাজের পরিবহন খরচের কার্যকর উপায় হিসেবে জলপথের উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়ায় খনন এবং নৌ-বন্দর স্থাপনের কাজে জড়িত কোম্পানিগুলো জীবনে নতুন একটি ইজারা পেতে পারে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় হলদিয়া থেকে বারানসি পর্যন্ত জাতীয় জলপথ-১’র নির্মাণ কাজ চলমান। ৫ হাজার ৩৬৯ কোটি রুপির এ প্রকল্প। এ প্রকল্প শেষ হলে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টনের বিশাল জাহাজ চলাচল করতে সক্ষম হবে। ২০২২-২৩ সালের মধ্যে ভারতের এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

একই ধরনের প্রকল্প উন্নয়নের কাজ চলছে কাম্বারজুয়া খালে, গোয়ার মান্দবি ও জুয়ারি নদীতে (২৩ কোটি রুপির), কেরালার খালে (১.৬ কোটি রুপির), উত্তর প্রদেশের গন্দক নদীতে, বিহারে (১২.৯১ কোটি রুপির), রূপনারায়ণ নদীতে (২৪ কোটি রুপির), পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন জলপথে (১৮.১ কোটি রুপির)। নদী খনন কাজ শেষ হলে এসব প্রকল্প বিভিন্নভাবে সংযুক্ত হবে।

নদী খননসহ সামুদ্রিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৮১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের বেসরকারি কোম্পানি আর্দেশির বি কার্সেটজি অ্যান্ড সন্স লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট হর্ষবর্ধন ভাটনগর বলেন, নতুন মাত্রার মেশিন কেনার জন্য তারা ইউরোপীয় ও মার্কিন ড্রেজার নির্মাণকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বর্তমানে এ কোম্পানির হাতে পাঁচটি নিজস্ব ড্রেজার আছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা নদী খননের জন্য বড় এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির সুযোগের অপেক্ষায় আছি। নদী খনন কাজে উচ্চ ছাড় দেয়া হবে।’

কাজের ধরন এবং শর্ত জানার পর তার কোম্পানি বাংলাদেশে কাজের দরপত্র নিলামে প্রতিযোগিতা করবে বলে জানান ভাটনগর। উত্থাল ব্রহ্মপুত্র আসামের বার্ষিক বন্যার অন্যতম কারণ, নদী খননের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কী সম্ভব হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ভাটনগর খুব বেশি আশাবাদী নন। তিনি বলেন, সাধারণত নদীর খনন বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নয়। বন্যা ঠেকাতে খননের উপকারিতা ধাপে ধাপে পাওয়া যাবে।

চলতি বছর আসামে চার দফায় বন্যা হয়েছে; এতে প্রাণহানি ঘটেছে প্রায় ১৫০ জনের। বন্যা দূর করতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নদী খননের ওপর জোর দিয়েছেন। সনোয়াল বলেছেন, খননের ফলে বন্যা কমে আসবে। কারণ এর মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।

সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইকোনমিকস টাইমস।