আমরা খালি চোখে দেখি আর জানি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলে না। মুখে বলি, বিশ্বকাপে নেই বাংলাদেশ। আসলে কি তাই? বাছাইপর্বে অংশগ্রহণও তো একরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা।আর সে আলোকে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা ফিফার অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের সাথে বাংলাদেশও বিশ্বকাপ খেলে।
চার বছর পর পর হয় বিশ্বকাপ। তার অন্তত দুই বছর আগে শুরু হয় মহাদেশীয় পর্যায়ে বাছাই পর্ব। ইতিহাস জানাচ্ছে, তিন যুগ ধরে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে দেশ দক্ষিণ এশীয় ফুটবল আসরে সাফল্য পায় না, সে দেশ আর বাছাই পর্বের গন্ডি পাড় হয়ে মূল পর্বে যাবে কি করে? প্রতিবার ঐ বাছাইয়ে অংশ নেয়াই সার হয়। মানে বাছাই থেকেই বিদায় ঘটে। আর সে কারণেই বিশ্বকাপের মূল পর্বে দেখা যায় না বাংলাদেশকে।
কিন্তু জানেন? বাংলাদেশ ফুটবল দল বিশ্বকাপের মূল পর্বে না থাকলেও বাংলাদেশেরই এক দূরন্ত কিশোর থাকছেন এবারের বিশ্বকাপে! কি, অবাক হলেন নিশ্চয়ই! হ্যাঁ, অবাক হবার মত বিষয়ই বটে। বাংলাদেশের এক ১২ বছরের কিশোর আবার বিশ্বকাপে খেলবে কি করে?
একটু গোলমেলেও ঠেকছে তাই না? নাহ, কোনই গোলমেলে ঠেকার কিছু নেই। আবার অবাক হবারও বিষয় নয়। বাংলাদেশের কিশোর রাফি থাকছেন এবার ‘মস্কো বিশ্বকাপে’। পুরো নাম গোলাম রাফি খান।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার মদনগঞ্জের এক দুরন্ত কিশোর এই রাফি। বয়স ১২ পেরোয়নি। সবে ১২তে দিয়েছে এ কিশোর। শিশু বললেও অত্যুক্তি হবে না। আগামী ৭ জুন রাশিয়ার মস্কো যাবে এ কিশোর ফুটবলার।
বিশ্বকাপ তো সব দেশের জাতীয় দল খেলে। সেখানে বাংলাদেশ নেই, তা তো পুরনো খবর। তাহলে রাফি কোথায়, কিসে খেলবে? নিশ্চয়ই খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না?
তাহলে শুনুন, রাফি রাশিয়া যাবে ফিফার ‘ফুটবল ফর ফ্রেন্ডশিপ ’ নামক এক সন্মিলনে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬৪ জন কিশোর ফুটবলারের সাথে থাকবে বাংলাদেশের রাফিও।
গত বছর থেকে রাশিয়ার অভিজাত তেল ও গ্যাস কোম্পানি ‘গ্যাজ প্রম’ প্রথমবারের মত এ উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সালের জুনে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত কনফেডারেশন কাপ থেকেই শুরু ফিফা ও ‘গ্যাজ প্রমে’র এ যৌথ আয়োজন। সেবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিভাবান কিশোর ফুটবলারদের রাশিয়ায় হওয়া কনফেডারেশন কাপ দেখার সুযোগ করে দেয় ‘গ্যাজ প্রম’। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে বাছাই করে একজন মেধাবী কিশোর ফুটবলারকে বেছে নেয়া হয়।
RABBI-Rafi
গত বছর কনফেডারেশন কাপে বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৪ জন কিশোর ফুটবলার অংশ নেয়। তাতেও ছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব। কাকতালীয়ভাবে গত বছর বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিল এই রাফিরই বড় ভাই গোলাম রাব্বি খান রাব্বি।
রাফি আর রাব্বি শুধু ভাই-ই নন, সহোদর। একই পিতা-মাতার সন্তান। আরও অবাক করা তথ্য হলো তারা যমজ ভাই। রাব্বি বড়। আর রাফি ছোট। দুজনার বয়সের পার্থক্য মোটে তিন মিনিট। নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার মদনগঞ্জের মোহাম্মদ বশিরউদ্দীন খান রতনের দুই ছেলে রাব্বি আর রাফি।
ফুটবল খেলেই কাটে প্রায় সারা দিন। দুই ভাই বন্দর এলাকার হাজী ইব্রাহীম আলম চাঁন মডেল স্কুলও কলেজে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। পিতা বশিরউদ্দীন প্রবাস থেকে ফেরার পর তেমন অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। তারপরও ফুটবল অন্তঃপ্রাণ দুই ছেলেকে ফুটবলার বানানোর স্বপ্ন তার মনে।
কিন্তু আর্থিক অসচ্ছ্লতার কারণে এক সময় দুই ছেলেকেই ফুটবল খেলতে নিষেধ করে দেন বাবা। এক পর্যায়ে তাদের বুট ও খেলার সামগ্রীও পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। সেটা গত বছর মানে ২০১৭ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। কিন্তু দুই ভাই গোপনে ফুটবল চর্চা আর অনুশীলন চালিয়ে যায়।
বাবাকে না জানিয়ে গত বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহে মার কাছ থেকে নামমাত্র বাস ভাড়া (৩০ টাকা) নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থেকে চলে আসে ঢাকা মতিঝিল আরামবাগ বাফুফের টার্ফে। সেখানে বাফুফের উদ্যোগে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চল থেকে উন্মুক্ত ট্রায়াল হয়। ২০০ কিশোরের মধ্যে বাছাই হয়। যেখানে ৫০ জন বয়সের কারণে এমনিতেই বাদ পড়ে যায়। আর দেড়শো জনের ট্রায়ালে বড় ভাই রাব্বি প্রথম হয়। আর ছোট ভাই রাফি পায় ষষ্ঠ স্থান।
যেহেতু একজনকে নেয়া হবে। তাই রাব্বি সেই ট্রায়ালে প্রথম হয়ে কনফেডারেশন কাপের সময় রাশিয়া যাবার জন্য মনোনীত হয়। এরপর জার্মানি ও চিলির মধ্যে কনফেডারেশন কাপের ফাইনালটি মাঠে বসেই দেখেছে রাব্বি। ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনার সাথে হাত মেলানোর সুযোগ না হলেও ম্যারাডোনাকে হাত মেলানো দূরত্বেই দেখে অভিভূত রাব্বি। স্মৃতিচারণ করে বলছিল, ‘ম্যারাডোনাকে দেখে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। খুব ভালো লেগেছিল।’
আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী ম্যারাডোনাকে দেখার স্মৃতি এতটাই মনে দাগ কেটে আছে, তার প্রমাণ ঐ দিন ম্যারাডোনা যে কালো রংয়ের কমপ্লিট স্যুট পড়েছিলেন, সেটাও গড়গড় করে বলে দিলেন রাব্বি।
এবার তার ছোট ভাই রাফি যাচ্ছে বিশ্বকাপ চলাকালীন ফিফার ফুটবল ফর ফ্রেন্ডশিপে। বাংলাদেশের ২০০ কিশোর ফুটবলারের মধ্যে বাছাই হয়। তাতে রাব্বির ছোট ভাই রাফি এবার প্রথম হয়ে বাংলাদশ থেকে ফিফা ফুটবল ফর ফ্রেন্ডশিপের জন্য মনোনীত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৬৮ জন কিশোর ফুটবলার থাকবে সেখানে। মস্কো ও অন্যান্য শহরে তারা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলবে।
প্রসঙ্গতঃ বিশ্বকাপ দেখা এবং বিশ্বকাপ চলাকালীন যে সব শহরে খেলা হবে, সেই সব শহর ও মাঠেও তাদের বিচরণ থাকবে। রাফি মাঠে বসে ১৪ জুন স্বাগতিক রাশিয়া আর সৌদি আরব বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ সরাসরি দেখার সুযোগও পাবে।
সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ২০০ শিশু ও কিশোরের মধ্যে একই পরিবারের দুই জমজ ভাইয়ের পর পর দুই বছর ট্রায়ালে প্রথম হয়ে রাশিয়া যাওয়া। তাও তারা কোনো কোচিং একাডেমির ছাত্র না। বিকেএসপি কিংবা অন্য কোন জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রও নয়। অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে ওঠা অস্বচ্ছল পিতার সন্তান। মেধা আর চেষ্টা গুণে ১২ বছরের নিচে বাংলাদেশের শিশু ও কিশোরদের মধ্যে ট্রায়ালে প্রথম হয়ে বিশ্ব ফুটবলের দুটি বড় আসরে অংশগ্রহণ! ভাবা যায়!
এ যে কল্পলোকের কাহিনীকেও হার মানায়।