বরিশাল-৫ আসনে বিএনপির ঘাটিতে জয় চায় আওয়ামী লীগ

:
: ৬ years ago

বরিশাল মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ড এবং সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে বরিশাল-৫ আসনকে বলা হয় দক্ষিণের রাজনীতির সদর দফতর। আসনটি সব রাজনৈতিক দলের প্রথম টার্গেট হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সব নির্বাচনেই এ আসনে জয়লাভ করছে বিএনপি।
শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনই নয়, সিটি নির্বাচনেও বেশিরভাগ সময় জয় পায় বিএনপিই। মাঝে একবার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন জয়লাভ করেন। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির দলীয় কোন্দলের সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছিলেন হিরন। সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রায় সোয়া লাখ ভোট পেয়ে মেয়র হন আওয়ামী লীগের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এ বিজয় নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বরিশাল-৫ আসনটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বড় দু’দলই।

২০০৮ সালের নির্বাচন ছাড়া নব্বইয়ের পট পরিবর্তনের পর প্রতিটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে অন্তত ৫০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড রয়েছে বিএনপির। ১৯৯১ সালের ভোটে এমপি হন প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি বিএনপির আবদুর রহমান বিশ্বাস। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ছেড়ে দেয়া আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার। ’৯৬ সালে এমপি হন আবদুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে নাসিম বিশ্বাস। ১৯৯৮ সালে তার আকস্মিক মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে আবার এমপি হন সরোয়ার। ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনেও এমপি হন সরোয়ার। ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪২ ভোটার অধ্যুষিত এ এলাকায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে সরোয়ার ১ লাখ ৫ হাজার ৬৯৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের জাহিদ ফারুক

শামীম পান ৯৯ হাজার ৩৯৩ ভোট। তৎকালীন মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক প্রয়াত শওকত হোসেন হিরনের কারিশমার কারণেই ভোটের ব্যবধান কমাতে পেরেছিল আ’লীগ। সবশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে শওকত হোসেন হিরন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন। পরে তার আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হন তার স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ। আগামী নির্বাচনেও তিনি দলের মনোনয়ন চাচ্ছেন। তিনি ছাড়াও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হচ্ছেন- সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল, মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য রেলওয়ে শ্রমিক লীগের উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন রিপন।

২০১৪ সালে হিরনের মৃত্যুর পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রয়াত মেয়রের স্ত্রী জেবুন্নেসার মধ্যে হিরনকে খুঁজে ফিরলেও সময়ের ধারাবাহিকতায় কিছু আশাহত হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে হিরন আগলে রেখেছিলেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি। সেই হিরন অনুসারীরা আশাহত হয়ে ধীরে ধীরে ভিড় জমান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি পদে থাকা এমপি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছায়াতলে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী বলেন, ‘হিরনের বলয় টিকিয়ে রাখতে জেবুন্নেসা শুধু ব্যর্থই হননি, তিনি নিজেও হাত মিলিয়েছেন হাসানাত আবদুল্লাহর সঙ্গে। ফলে বরিশালের আওয়ামী লীগ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় হিরন অনুসারীদের অস্তিত্ব। পরিস্থিতি এমন যে হিরনের কথা বলার মতো এখন আর কেউ নেই এখানে।’ এসব বিষয় নিয়ে আলাপকালে জেবুন্নেসা বলেন, ‘আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আমার রাজনৈতিক অভিভাবক। তার পরামর্শ নিয়েই আমি আমার কর্মকাণ্ড চালাই। এক্ষেত্রে হিরন সাহেবের সঙ্গে তার সম্পর্ক কি ছিল না ছিল তা আমার জানা নেই।’

আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী মাহবুব উদ্দিন বীর বিক্রম এর আগে একাধিকবার দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করলেও জিততে পারেননি কখনোই। জানতে চাইলে মাহবুব উদ্দিন বলেন, ‘বরিশালের সাধারণ মানুষ আমাকে চেনেন-জানেন। তারা চান যে আগামী নির্বাচনে আমি সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করি। বাকি সিদ্ধান্ত দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।’ দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও রাজনীতিতে ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসেবে পরিচিত সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘বংশানুক্রমিকভাবে আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান আমি। আমার অতীত, বর্তমান এবং দলের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার বিশ্লেষণ করে জননেত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন তাই মাথা পেতে নেব।’ দলের আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, ‘আমি কাজ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্যে। আওয়মী লীগ সে কাজের প্ল্যাটফর্ম। সোনার বাংলা নির্মাণের ক্ষুদ্র কর্মী ছাড়া আমি নিজেকে আর কিছুই মনে করি না।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন রিপন বলেন, ‘সবাই এমপি-মন্ত্রী হয়ে উন্নয়ন করার প্রতিশ্রুতি দেন। আমি কোনো কিছু হওয়ার আগেই লক্ষাধিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। মনোনয়ন দেয়া-না দেয়া নেত্রীর ব্যাপার। আমি আমার সেবামূলক কাজ চালিয়ে যাব।’ তার নিজের একটি সামাজিক সংগঠন রয়েছে। সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামের সংগঠনের মাধ্যমে তিনি মানুষের চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানমূলক অর্থ সহায়তা করছেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খানিকটা ভালো অবস্থানে বিএনপি। একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী নির্বাচন করতে চাইলেও এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার। তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন সরোয়ার। গোপন চুক্তির বিনিময়ে মাঠ ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এরকম পরিস্থিতিতে তার মনোনয়ন নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে ধানের শীষ তার হাতেই উঠবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা।

নির্বাচন নিয়ে কথা হয় মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বরিশাল বিএনপির ঘাঁটি। সিটি নির্বাচনে চুরি নয় ডাকাতি করে আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব দলের প্রার্থীর একযোগে নির্বাচন বর্জন। জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে দল যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই মাথা পেতে নেব।’ সরোয়ার ছাড়াও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হচ্ছেন- সদ্য সাবেক সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামাল, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন এবং বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চান।

জানতে চাইলে শিরিন বলেন, ‘দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। এর আগেও চেয়েছি। বাকি সিদ্ধান্ত দেবে দল।’ এবায়েদুল হক চান বলেন, ‘মনোনয়ন চাই সেটাই তো স্বাভাবিক। জনগণের জন্যে রাজনীতি করি। জনগণের জন্য কাজ করার সুযোগ তৈরি করতেই তো নির্বাচনে অংশ নেয়া। বাকি সিদ্ধান্ত দেবে দল।’ এছাড়া মাওলানা সৈয়দ ফয়জুল করিমের নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইকবাল হোসেন তাপসের নাম। সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ব্যাপক আলোচিত হওয়া তাপস ভোটের মাঠে ফ্যাক্টর হতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে। নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রশ্নে তাপস বলেন, ‘পল্লীবন্ধু এরশাদের সিদ্ধান্তই এক্ষেত্রে আমার কাছে সব। বরিশালের মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। তাদের সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চাই। আর সেজন্যেই থাকব নির্বাচনী মাঠে। বাকি সিদ্ধান্ত নেবেন কেন্দ্রীয় নেতারা।’